লুপ্ত নদী
লুপ্ত নদী
মধুপর্ণা রায়
-----------------
মেঘ করুক, না করুক.... ওকে মনে পড়ে। মাঝে কয়েকটা বছর ওসব স্মৃতিকে গাঢ় তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দেওয়া গিয়েছিল। গিয়েছিল কারণ, যে চারাগাছটা পুঁতেছিল ও, সেটাতে জল আর সার দিতে দিতে তার পাতায় ভরা ছবিতে ও অবসেসড থাকতে পারছিল অদ্ভুত আয়াসে। এখন আর সেটা হচ্ছে না। ও চাইছেও না। যদিও মিথ্যেকে আসলে সকলেই ভালোবাসে। মিথ্যের মাটিতে একটা বাড়ি আছে। ঘর আছে। মশারির রঙ নীল। আর ওইরকম একটা গাছ। পাতার জালের ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া আকাশ। বিশ্বাস এবং গৌরবের সমতুল্য স্নেহ। এসবই ছিল। কারণ, ও রেখেছিল। তবে এখন অবশিষ্টাংশ হিসেবে কী কী পড়ে আছে ও আর চোখ মেলে দেখছেই না। আসছে- যাচ্ছে। কাজকর্মও করছে। ব্যস।
মেঘ না করলেও তাই ওকে মনে করতে ইচ্ছে হয়। যেন দীর্ঘ বা অ-দীর্ঘ জীবনের একটা সঞ্চয় তো বটে! কৈশোর প্রেম। তারুণ্যে সামান্য রঙ হারাচ্ছিল। তবে ফ্যাকাসে হয়নি। যৌবনে মনে হল - সব ভুল! ভেবেছিল, দক্ষিণের জানলায় কেউ টোকা দিল বুঝি! যার অপেক্ষা ছিল অনন্ত ভরে। ভুল দিকের জানলায় টোকা। তাকেই দক্ষিণ ভেবে ফেলাও আসলে জীবনেরই গল্প। এমন করে থেমে ঠেকে দিন তো যায়ই.... মহাবিশ্বের প্রবাহ কারই বা ব্যক্তিগত ঝড়ে জলে এতটুকু থেমেছে! ইন্দ্রানীও এক পরমাণু। আজকাল প্যালপিটেশন হঠাৎ জানান দেয় হৃদয় এক যন্ত্র, এবং সে চলছে। এই এতখানি ভেবে তারপর ইন্দ্রানী হাসল। আয়নায় সে হাসি দেখল সে। হাসি অবশ্য আছে। শুধু জল আধার পায়নি বলে লুপ্ত হয়ে গেছে নদী। বহু বছর আর কাঁদেনি ইন্দ্রানী।
আচমকা অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায় জীবনে। মেঘ না করা দিনেও যাকে মনে পড়ে তারই সঙ্গে আজ লং ড্রাইভে যাচ্ছে ইন্দ্রানী। পেছনের সিটেই বসতে যাচ্ছিল। অভিরূপ অবাক চোখে সামনে বসতে বলল। তারপর এই লম্বা সফর। পুরনো প্রেমিক। ইন্দ্রাণী হতে চাইছিল নতুন প্রেমিকা। অথচ...
-- তোমার আঙুলের নীলাটা?
অভিরূপ হাসল। -- বৌ খুলে দিল। নীলা নাকি সকলের সহ্য হয় না।
-- সেই আগের মতো জোরে বাইক চালাও?
-- কী মনে হচ্ছে?
-- চালাও না। সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছ।
অভিরূপ একটু হাসল।
-- বৌ কেমন? সুন্দর?
-- ভালোই। খুব ভালো রাঁধে।
-- রাঁধুনি নাকি তোমার?
-- নাহ। বৌ।
গাড়ি পার্ক করল অভিরূপ।
-- নামো।
-- কোন জায়গা?
-- জেনে কী হবে?
-- আচ্ছা। অজানাই থাক।
স্বচ্ছ জলে ছোটো ছোটো মাছেরা ঝাঁক বেঁধে এ-মোড় থেকে ও-মোড়ে অভিমুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।
-- কী দেখছ?
এই প্রথম নিজে থেকে কিছু জানতে চাইল অভিরূপ।
-- মাছেরা ঝট করে ঘুরে যায়। বাঁক নিয়ে নেয়। দেখছি তাই।
ইন্দ্রানী ওর হাতে তাস তুলে দিচ্ছে। অভিরূপ চাইলেই খেলতে পারে। অথচ খেলল না। এমন করেই তো একদিন খুবই আচমকা ওদের সম্পর্ক বাঁক নিয়েছিল!
এর পর যেন নিথর নৈঃশব্দ। কেউই আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। ওর বরের কথা কিচ্ছু জানতে চায়নি অভিরূপ। সিগারেট খেত খুব। খাচ্ছে না। ইন্দ্রানী তবু কথা খুঁজে পেল।
-- সিগারেট খাও না এখন?
-- নাহ। ছেড়ে দিয়েছি। অনেক দূরের আবছা পাহাড়ের ঢেউ। সেদিকে তাকিয়ে আছে অভিরূপ।
-- কেন? বৌয়ের বারণ?
-- নিজেই ছেড়েছি। বুকে একটা ব্যথা হচ্ছিল। ভাবলাম, বাঁচা জরুরী। পরিবার আছে। দায়িত্ব আছে।
বুকের ভেতর ধাক্কা দিল কিছু! ইন্দ্রাণী ওকে দেখছিল। কত দায়িত্বশীল মানুষ! সিগারেট এত প্রিয় সঙ্গী ছিল!
--তোমার ইশু? ইন্দ্রানী জানতে চাইল।
-- আমার দুই মেয়ে।
-- আমার কথা জানতে চাইলে না?
-- জানি তো। এক ছেলে না?
-- কী করে জানলে?!
ইন্দ্রানীর বুকের তলে আলতো ঢেউ দিল। খোঁজ রেখেছিল তবে!
-- কে যেন কবে একবার বলেছিল। ঠিক মনে নেই। ঠিক বলেছি কি?
-- এত উদাসীন ভাবে কেন কথা বলছ? মনখারাপ? ইন্দ্রানী ঘুরতে চাইছে। ঘুরে ঘুরে শুরুর কাছাকাছি গেলে যদি কান্নার নদীটা ফিরে পায়, তবে বাঁচে সে।
-- কিসের মনখারাপ?! ধুস! আমি সবসময় বিন্দাস থাকি। চল! ওঠা যাক। ঘড়ি দেখল অভিরূপ।
-- আর দেরি করা যাবে না। ঘন্টা দেড়েকের ফিরতি পথ। ওঠ।
ফিরতি পথে গান চালিয়ে দিল। "তোমায় নতুন করে পাব বলে"...... ইন্দ্রানী গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছে।
-- চা খাবে?
ইন্দ্রানী দেখল ঝুপড়ি দোকান। সে একসময় খুব বায়না করত - ঝুপড়ি দোকানে চা খাব। আমাকে নিয়ে চল প্লিজ। তাহলে কিছুই আসলে ভোলেনি অভিরূপ! পুরনো কিছু কিছু ঝালিয়ে নিয়ে শুধু একবার কাঁদতে চাইছিল ইন্দ্রানী। কান্না যে কেন আসে না আর! অথচ অভিরূপ তাকে ডাকতই ছিঁচকাঁদুনে নেকি।
বলল-- তোমার মনে আছে তাহলে!
-- ওই টুকটাক। খাবে নাকি বল। বেশি দেরি করা যাবে না।
-- খাব না।
-- বেশ।
এমন আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিক থেকে গেল এতটা পথ। ছুঁল না কেউ কাউকে। অভিরূপ দেখল, তেমনই আহ্লাদী আছে ইন্দ্রাণী। সুখী তাহলে। ইন্দ্রাণী লুপ্ত নদী খুঁজে খুঁজে পেল না। ওরা ফিরে গেল। যেখানে যার যাবার।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴