রোদচশমা
শ্বেতা ভট্টাচার্য্য
^^^^^^^^^^^^^^
লাঞ্চব্রেকে ফাস্টফুড খেতে খেতে আজকাল বাড়ির
মাছ-ভাতের কথা খুব মনে পড়ে সৃজনীর। পাতলা মাছের ঝোল আর গন্ধরাজ লেবু। কতদিন খায় না সে! নিজের মনেই হাসে...স্বপ্নগুলো ছোটো হ'তে হ'তে কোথায় এসে ঠেকেছে। কম বয়সে পৃথিবীকে প্রসারিত করার যে ব্যাকুল স্বপ্ন আর চেষ্টা ছিল,আজ তাকে সংকুচিত করতে চাইছে প্রাণপণে। অবশ্য এক অর্থে সংকুচিত তো কবেই হয়ে গেছে! কতদিন দুপুরে ভাতঘুমে তলিয়ে যায় না! আয়েশ করে ব্যালকনিতে বসে চায়ে চুমুক দেওয়া হয় না কত বিকেল। বিকেলগুলো মাথা খু্ঁড়ে মরে কংক্রিটের দেওয়ালে। সে জীবন্মৃত হয়ে থাকে কিউবিকলের ভেতরে, কম্পিউটারে মাথা গুঁজে। গ্রুপ মিটিংগুলোয় কত বড়ো বড়ো কথা আলোচনা হয়... সংঘবদ্ধতা...
আরো কত সব গালভারী কথা। সৃজনী বোঝে...এ হ'ল কাঁঠালের আমসত্ত্ব। একদিকে সংঘবদ্ধকাজের প্রেরণা,অপরদিকে বিচ্ছিন্নকরণের প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা।প্রচ্ছন্ন আর থাকে কই? সবই তো দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট হয়ে পড়ে।
সৃজনী কাজ করতে চেয়েছিল গভীর আন্তরিকতা আর ভালোবাসা নিয়ে। কাজ আজও করছে,বরং বেশীই করছে...কিন্তু ভালোবেসে নয়,যান্ত্রিকভাবে। কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা আজও সমান রয়েছে, শুধু ভালোবাসাটাই মন থেকে উবে গেছে। আজকাল মুক্তির জন্য ছটফট করে। কিন্তু কী আশ্চর্য! শিকল কাটতেই বা পারে কই? এখনও কী অবচেতনে সবকিছু বদলে যাবে এই আশা কাজ করে? এখনও কী স্বপ্ন দেখে?
সাইমন এণ্ড থমসন কোম্পানিতে বছর দশেক হ'ল কাজ করছে সৃজনী। সৃজনী চ্যাটার্জী। এমনিতে শান্ত আর হাসিখুশী মেয়ে সে। সৃজনীর চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্য সব্বাইকে টানে...তা হ'ল তার সততা আর কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। সাদামাটা চেহারার এই শ্যামলা মেয়েটির মধ্যে রয়েছে প্রখর ব্যক্তিত্ব।ভাঙবে তবু মচকাবে না।
মা অরুণা চ্যাটার্জী আর বাবা প্রলয় চ্যাটার্জী দু'জনেই পেশায় ছিলেন শিক্ষক। সম্প্রতি দু'জনেই অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কাজপাগল প্রলয়বাবু বসে বসে সময় নষ্ট করার মানুষ নন। কিছু না কিছু সমাজসেবামূলক কাজ তিনি করেই চলেছেন সবসময়। আগেও করতেন,তখন সময় কম পেতেন।এখন তো অখণ্ড অবসর। কাজপাগল বাবার কাজপাগল মেয়ে...এই সৃজনী।
সৃজনী শৈশব থেকেই লক্ষ্য করে এসেছে বাবা-মায়ের ভাবনা-চিন্তাগুলো যেন আর সবার মতো নয়। কোথায় যেন একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সমঝোতা কিংবা আপোষ তাদের চরিত্রে একদমই নেই। কঠোর অথচ শিশুর মতো সরল... দু'টো মানুষেরই কাজের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতা। মানুষের প্রতি বিশ্বাসও তাদের প্রবল। কারো বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে অরুণা দেবীর একই কথা..."অবিশ্বাস করে ঠকার চাইতে বিশ্বাস করে হারানো ভালো"... কত লোক যে কতরকমভাবে তার বাবাকে ঠকিয়েছে! কিন্তু বাবা সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কখনও মনে রাখেন নি সে সব কথা। সেসব নিয়ে মা কখনো বাবার দিকে অভিযোগের তীর ছোঁড়েননি। মা বলতেন...বিবেক হ'ল জুতোর তলার পেরেকের মতো। তুই হাঁটবি ঠিকই, এগিয়েও যাবি, শান্তি পাবি না। জুতোর তলার পেরেক থেকে থেকে রক্তাক্ত করবে।
বাবা প্রচুর বই পড়তেন। বলতেন...শোন,আর একটু সহজ করে বলি। মিষ্টি খেয়ে যদি হাত না ধুয়ে ফেলিস, কী হবে? .... হাত চটচট করবে।
...বিবেকও হ'ল তেমনি।হাতে লেপটে থাকা মিষ্টির রস। সারাজীবন বুকের ভেতর চটচট করে।
বায়োলজির ক্লাসে মেরুদণ্ডী প্রাণীর কথা উঠলেই বাবা-মায়ের মুখ দু'টো সৃজনীর চোখের সামনে ভেসে উঠতো বরাবর।
এ হেন বাবা-মায়ের মেয়ে সৃজনী। স্কুলে-কলেজে বাবা-মায়ের জন্য তো বটেই, নিজের স্বভাব এবং ব্যবহারের জন্যও সবার কাছে ভালোবাসা পেয়ে এসেছে। বন্ধু-বান্ধব,প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক -শিক্ষিকা সবার কাছে সৃজনী ছিল এক দৃষ্টান্ত। বন্ধুরা সৃজনী বলতে অজ্ঞান ছিল। শত্রুরাও কী এক অদৃশ্য জাদুতে খুব তাড়াতাড়ি বন্ধু হয়ে যেত ।
বছর দশেক আগে পড়াশোনা শেষ করে সৃজনী এই নামকরা কোম্পানিতে চাকরি নেয়। তার ওপরওয়ালা বিজনবাবু সৃজনীকে বড়ো স্নেহ করতেন। ওর কাজ এবং ব্যবহারে তিনি খুব সন্তুষ্টও ছিলেন। এই অল্প সময়ে সৃজনীর বেশ কয়েকবার প্রমোশনও হয়েছে। সহকর্মীরাও কর্মনিষ্ঠ সৃজনীর ব্যবহারে মুগ্ধ। অফিসে গরিমা এবং সারা...এই দু'টি অবাঙালী মেয়ে সৃজনীর খুব অন্তরঙ্গ। কম-বেশী সবার সাথেই ওর সুসম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু একমাত্র এদের সাথেই ওর সখ্যতা বেশী। যদিও সৃজনীর সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করতো না। কিন্তু কারো কারো ব্যবহারে সে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বুঝতে পারতো --এরা তার কর্মোন্নতিতে ইর্ষাবোধ করে। তার ক্ষতি চায়। কিন্তু সুযোগ পায় না।চারদিকে সর্বক্ষণ ফিসফিস করে একটা দমবন্ধ করা ঘিনঘিনে পরিবেশ। পিতৃতুল্য,স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী বিজন বাবুর কারণে অবয়বটা স্পষ্ট চেহারা ধারণ করতে পারে না।
চাকরি পাওয়ার একবছর পরেই সৃজনী বিয়ে করে
রৌনককে। পাঁচ বছরের একটি ছেলেও রয়েছে ওদের। বিজনবাবু সপরিবারে এসে আশীর্বাদ করেও গিয়েছিলেন। অফিসের অন্যান্যরাও আপ্যায়িত হয়েছিল তার বিয়েতে। স্বামী রৌনক শহরতলির এক কলেজের অধ্যাপক। তবে রৌনকের পৈতৃক বাড়ি শহরের কেন্দ্রস্থলে। শৈশবে রৌনক পিতাকে হারায়।মা বিজয়াদেবীই তার একমাত্র অবলম্বন।স্বামী-পুত্র-শাশুড়িকে নিয়ে সৃজনীর সুখের সংসার।আর অফিস যেন তার দ্বিতীয় সংসার। পিতাসমান বিজনবাবু আর দুই সহকর্মী সারা,গরিমা... সৃজনীর একমুঠো শ্বাসবায়ু।
দিব্যি চলছিল সব।সৃজনী ভেবেছিল এমনই বুঝি চলবে। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের আগে বিজনবাবুর প্রমোশন হ'ল। তিনি বদলি হয়ে পুরোনো অফিস থেকে গুরগাঁও চলে গেলেন। বিজনবাবুর বিদায়ের দিন একত্রিশ বছরের সৃজনীর চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। এটা নিয়েও বেশ কিছুদিন আড়ালে-আবডালে হাসি-তামাশা চলল। কিছুদিনের মধ্যে বিজনবাবুর জায়গায় এলেন সুশোভন ভাদুড়ী।পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি বয়স, খুব বেশী রকম পরিপাটি। চেহারায় কীসের যেন অভাব!
সুশোভনবাবু প্রথম থেকেই কী এক দুর্বোধ্য কারণে সৃজনীর কাজে ক্রমাগত খু্ঁত ধরে চলতে লাগলেন। সৃজনীর কোনো কাজেই তিনি সন্তুষ্ট নন। সৃজনী এখন অফিসে- বাড়িতে সর্বত্র ল্যাপটপ আর কম্পিউটারে মুখ গুঁজে বসে থাকে। টিনটিন আর রৌনককে আগের মতো সময় দিতে পারে না। শাশুড়ি -মায়ের কাজেও আর সাহায্য করা হয় না।বাবা-মায়ের নিয়মিত খোঁজ নেওয়াও হয়ে ওঠে না।কতদিন সে সোনাডাঙ্গায় মায়ের কাছে যায় না। অথচ রৌনকের বাড়ি থেকে তার বাপের বাড়ি আর কতদূর? সময়ের যে বড়ো অভাব তার!
অফিসের রাহাদা আর ত্রিদিবদা বরাবরই অসম্ভব রকমের ফাঁকিবাজ। বিজনবাবু এতকাল সমস্ত কাজ বুঝে নিয়ে তবে তাদের ছুটি দিতেন। আজকাল রাহাদা আর ত্রিদিবদা সময়ের তোয়াক্কা মাত্র করে না। ছুটির আগেই বেরিয়ে যায়। সারাক্ষণ ভাদুড়ীবাবুর সামনে হাত কচলেই যাচ্ছে আর মুখে হেঁ হেঁ দেঁতো হাসি। আত্মসম্মানবোধটুকুও নেই।লজ্জা তো নেইই। সৃজনী দেখতে পায় কবে যেন সব্বাই একটানে মুখোশ খুলে ফেলেছে। সবাই ভাদুড়ীর সামনে হেঁ হেঁ করছে। গরিমা,সারা এবং আরো দু'জন বাচ্চা মেয়ে চুপিচুপি সৃজনীর কাছে অনেক অভিযোগ করে। তবে সামনাসামনি প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না,পাছে চাকরিটা চলে যায়।বাড়ির সমস্ত আর্থিক দায়িত্ব যে তাদের ঘাড়ে!
গরিমার স্বামী ছোটোখাটো একটা ব্যবসা করে। তার দুই ছেলে-মেয়ে---দু'জনেই নার্সারিতে পড়ে। সারা বিধবা মাকে নিয়ে গড়িয়ায় থাকে। সারার একমাত্র ভাই এইমসে পড়ছে। ওদের অবস্থা সৃজনী বোঝে।সৃজনী প্রতিবাদ করেই বা কী পাচ্ছে। যে শ্রাবস্তী এত বছর ধরে কোনো প্রমোশন পায় নি, সে এখন সৃজনীকে টপকে গেছে। আর সৃজনী যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। বিজনবাবু থাকাকালীন প্রত্যেককে অনুমতি নিয়ে বিজনবাবুর ঘরে ঢুকতে হ'ত। সৃজনীও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বাড়তি সুবিধা সে-ও কখনও পায় নি। তবে যোগ্য সম্মানটুকু পেয়েছে। এখন রাহাদা, ত্রিদিবদা আর শ্রাবস্তীর... ভাদুড়ীর চেম্বারে অবারিত দ্বার। বিধিনিষেধ বাদবাকীদের জন্য।
অফিস ছুটি হয় সন্ধ্যা ছটায়। সবার কাজও শেষ হয়ে যায়। সৃজনীর কাজ আর শেষ হয় না। ছুটির পরেও বেয়ারা দীনদয়াল তার টেবিলে গুচ্ছের ফাইল এনে হাজির করে।ভাদুড়ী এসে জানায়.....
কাজগুলো আজই শেষ করে রাখবেন।...
রাত দশটা বেজে যায়। দীনদয়াল বসে বসে ঘুমে ঢোলে। তার আটান্ন বছরের হৃদয় পিতৃস্নেহে উদ্বেল হয়ে ওঠে। সৃজনীকে বলে
...দিদি বাড়ি চলে যাও। এগুলো ভাদুড়ীবাবুর কাজ।সময় মতো শেষ না হ'লে ওনাকে জবাবদিহি করতে হবে; তোমাকে নয়।
সৃজনী জানে জবাবদিহি তাকেই করতে হবে।
অগত্যা প্রতিরাতে কাজের পাহাড় মাথায় নিয়ে সে বাড়ি ফেরে । ফিরেই ল্যাপটপ খুলে বসে। ছেলে আশেপাশে ঘুরঘুর করে। সৃজনী ব্যাগ থেকে চকোলেট কিংবা খেলনা বের করে দেয়। এর বেশী সময় বা যত্ন কোনোটাই দিতে পারে না। রাধিকা এসে চা দিয়ে যায়। সেই চা পড়েই থাকে। শাশুড়িমা নাতিকে খাইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঘুম পাড়ান।সেকেলে মানুষ,সবকিছু বোঝেন না। সৃজনীর বাবামায়ের কাছে অভিযোগের পাহাড় হাজির করেন। বাবা-মাও সৃজনীকে উপদেশে উপদেশে জর্জরিত করে তোলেন। এই বাবা-মাকে সৃজনীর অপরিচিত লাগে। সৃজনী যে কত অসহায় কেউ অনুভব করে না। রৌনক সৃজনীর কাজের চাপ দেখে কষ্ট পায়। চুপ করে কর্মক্লান্ত মেয়েটিকে দেখে।
স্ত্রীর জন্য গর্বে আর মমতায় বুক ভরে ওঠে। যতটা পারে রৌনক টিনটিনকে সময় দেয়।মায়ের কাজে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্য ঝলমলে মেয়েটি দিনে দিনে কৃশকায় হয়ে ওঠে। প্রতিদিন ভোর চারটায় তার কাজ শেষ হয়। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুতে যায় যখন,তার পরিচিত পৃথিবী ঘুমিয়ে কাদা। ঘুমন্ত রৌনককে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে সে-ও চেতনার জগৎ থেকে হারিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সে আর কতক্ষণ...সাতটার মধ্যে উঠে আবার তৈরী হতে হয় তাকে। সকাল আটটার মধ্যে সাইমন এণ্ড থমসনের রামপুর ব্রাঞ্চ অফিসে সৃজনীকে পৌঁছতেই হবে। সবাইকে নয়....সৃজনী, গরিমা, সারা, দীনদয়াল আরও গুটিকয়েক সহকর্মীকে । বাকিদের অঢেল ছাড়। শ্রাবস্তীর প্রায়ই ওয়ার্ক ফর্ম হোমের অর্ডার থাকে। তখন ভাদুড়ীও অফিসে আসেন না। রাহাদা আর ত্রিদিবদারও অনেক ছুটি। কিন্তু এই মুষ্টিমেয় ক'জনের কোনো ছাড় নেই। তাদের তেলের ভাঁড়ারে যে মা ভবানী...
শত পিষলেও তেল বেরোয় না,পেষার চেষ্টাও তারা করে না। সৃজনী কোনো মূল্যে অযাচিত সুযোগ নিতে রাজী নয়। কিন্তু মনেপ্রাণে আশা করে...অফিস আবার আগের মতো চলুক। সবার জন্য একই নিয়ম হোক।কাজের স্বীকৃতি পাক যোগ্য লোকেরা।
প্রখর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি উজ্জ্বল মেয়ে দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে। অথচ সৃজনী এ অবস্থায়ও আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি রাখছে না। কাজগুলো সে ঠিকঠাক করে যাচ্ছে। সে বোঝে ভাদুড়ী নিজের কাজগুলো সৃজনীকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে; কাজ সম্পর্কে ভাদুড়ী তেমন সড়গড়ও নয়। প্রতিবাদ করতে গেলে বা ভুল দেখিয়ে দিলে বিস্তর আইনি কচকচানি শুনতে হয়। নয় তো চেয়ার বদলে দেয়ার হুমকি। দিনে দিনে অবসাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। রৌনকের বুকে মাথা রেখে কাঁদার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না সে।
আজকাল ছুটির দিনগুলোতেও মাঝে মাঝে অফিসে যেতে হয়। অফিসে সবাই আগের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে এটা দরকার হ'ত না। কিন্তু কাজ তো করে মাত্র কয়েকজন। কেউ করে আন্তরিকতায়,কেউ বা করে ভয়ে। বিভিন্ন অর্ডার সঠিক সময়ে পাশ না হ'লে রামপুরের অফিস উঠে যেতে কতক্ষণ? রৌনকের কলেজ,পৈতৃকবাড়ি সবই তো এই শহরে! সৃজনীকে যদি রামপুরের বাইরে যেতে হয়! তখন? একা একা সে কীভাবে থাকবে রৌনক আর টিনটিনকে ছেড়ে? বাবা-মাকেও তো একা ফেলে যেতে পারবে না। নতুন চাকরি পেতে হ'লে পড়াশুনাও তো করা চাই, সময় কোথায় সৃজনীর?
শ্রাবণমাস পড়েছে। আজ সৃজনীর বিবাহ-বার্ষিকী। দশ বছর পূর্ণ হ'ল তাদের যৌথ-জীবনের। বিকেলে বাবা-মা আসবে। গরিমা
-সারা আর দীনদয়ালকেও নেমতন্ন করেছে সৃজনী।আর ওদিকে আসবে রৌনকের স্কুলকলেজের ক'জন বন্ধুবান্ধব। আগের দিন মাঝরাত থেকে অঝোরে বৃষ্টি আরম্ভ হ'ল। রাস্তা-ঘাট জলের তলায় ; রৌনকদের একতলার গ্যারাজ ঘরেও জল ঢুকেছে।সেদিনই একটা নতুন অর্ডার পাশ করার কথা।
রৌনক বলল... আজ নাই বা গেলে,ছুটি নিয়ে নাও।মিস্টার ভাদুড়ীকে ফোনে জানিও দাও না!
শাশুড়ি মা-ও আপত্তি করলেন। ছেলেও মাকে জাপটে ধরল। ক্লান্ত-অবসন্ন সৃজনীরও মন চাইছিল না যেতে। কিন্তু উপায় নেই।
----তুমি তো সবই জানো রৌনক ....
গ্যারাজে থইথই জল। গাড়ির ইঞ্জিনেও জল ঢুকে যাবে হয়ত। রৌনককে অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তারও উপায় নেই সৃজনীকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসে। অগত্যা ঝড়জল মাথায় নিয়ে সৃজনী একাই বেরিয়ে পড়ল। কোনোরকমে একটা বাস পাওয়া গেল। কিছুদূর গিয়ে বাস আর এগোতে পারছে না। রাস্তা তো নয় যেন নদী! টানা রিক্সা,অটো আবার রিক্সা...এই করে করে যখন সে অফিসে পৌঁছোলো ততক্ষণে দুপুর একটা বেজে গেছে। অফিসবাড়িটায় কয়েকজন মাত্র কর্মী উপস্থিত হ'তে পেরেছে। গরিমা,সারা, বেয়ারা দীনদয়াল আর সৃজনী নিজে। তিনটের মধ্যে সব ডিল রেডী রাখতে হ'বে। সৃজনী কাজ আরম্ভ করে দিল। বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটর রাখার ঘরে জল ঢুকেছে। ভাদুড়ী তখনও অনুপস্থিত। ঠিক তিনটের সময় তিনি এলেন। এসেই সৃজনীকে তলব করলেন....সব রেডী?
.... কেন? কী করেন আপনারা?
....আজ তো দেখেছেন স্যার রাস্তা-ঘাটের অবস্থা! সকাল পাঁচটায় অম্বুরা-র অর্ডারটা রেডী হ'ল সবে।
ঝড়-জলে নেট কাজ করছিল না। এদিকে বিদ্যুতের
যা হাল!
.... আমাকে কাজ শেখাতে আসবেন না......
আজ আর সৃজনী নিজেকে সংযত রাখতে পারল না....কী ভেবেছেন আপনি আমাদের?
আজ যেন সৃজনীর মুখ দিয়ে যুক্তি আর অভিযোগের ছররা বেরিয়ে আসছে। প্রত্যেকটা গুলি ভাদুড়ীকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। তারপর সৃজনীর আর কিছু মনে নেই.....
যখন চোখ মেলল...চোখের সামনে কিছু পরিচিত মুখ।টিনটিন,রৌনক,মা-বাবা,শাশুড়িমা,গরিমা, সারা আর দীনদয়ালদা...সারা ঘরে কেমন একটা ঝাঁঝালো গন্ধ।মাথার কাছে সাদা গাউন পরিহিত অপরিচিত এক মহিলা। স্টেথো গলায় এক সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে।শান্ত গলায় ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন...কেমন বোধ করছেন এখন?
টিনটিনের গলার স্বর যেন কতদূর থেকে ভেসে ভেসে আসছে....মা, তুমি আর অফিসে যাবে না মা। আমার কোনো খেলনা চাই না। আমি শুধু তোমাকে চাই.....
রৌনকের মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধীরে ধীরে।
রৌনক আর বাবা-মায়ের মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ।
দীনদয়ালদার চোখে জল। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সারা। হঠাৎ গরিমা বলে ওঠে..." সৃজনী, দীনদয়ালদা ভাদুড়ীকে কী বলেছে জানিস? দিদির যদি কিছু হয় আপনাকে দেখে নেব...."
"ভাদুড়ীর মুখটা যদি দেখতিস!"....সারা হা হা করে হেসে ওঠে...
"রাস্তার জল কি নেমে গেছে? টিনটিন রাস্তা পার হ'তে পারবে তো? "....সৃজনীর গলায় তখন প্রবল উৎকণ্ঠা!