সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
27-November,2022 - Sunday ✍️ By- সুদর্শন ব্রহ্মচারী 176

রুমঝুম কে লাগে বরষণ বদরিয়া

রুমঝুম কে লাগে বরষণ বদরিয়া
সুদর্শন ব্রহ্মচারী 
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঢেলে কালো মেঘ উড়ে গেল। বিষণ্ণতার সুরে পুনর্ভবা বইছে। দু পাড়ের শিরিষ, বাবলা, বাঁশবন আর অর্জুন, কদম্ব, জারুলের ওপর দিয়ে বাদল হাওয়া বইছে। সোঁদা গন্ধ। আমার মন উড়ে উড়ে দু দেশের সীমান্তে ওয়াচ টাওয়ারে থিতু হল। এক ঝাঁক সাদা বক উড়ে গেল। সেদিক থেকে নীলচে ধূসর মেঘ আসছে আর লাল রঙের জামা গায়ে একটা লোক প্রাণপণে সাইকেল চালিয়ে ছুটে ছুটে আসছে। মাধব বলছে, লোকটা বড় উতলা। 
কেন মন হচ্ছে? 
জোর বৃষ্টির ভয় পাচ্ছে।
এমনও তো হতে পারে কারও সাথে ভিজবার তাড়া।  
হুঁ! নদী শুকিয়ে গেছে। অত রোমান্স পাবে কোথায়? 
নেই কেন? প্রকৃতি তো সেই একই রকম আছে। এখনও মেঘ উঠছে, ঝড় উঠছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে। কিসের অভাব বল তো? 
তুই যেমন! নদি আর নারী শুকিয়ে গেলে ভরাভাদ্রেও নৌকা ভাসে না। ছাড়, অত ভেবে লাভ নাই। বরং নদী দেখ। 
যতদূর চোখ যায় সবুজ মাঠ আর বনভূমির গা ঘেঁষে নদীটা সমুদ্রের বেলাভূমির মতো শুয়ে আছে। দৃশ্যটা আমার প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। মন বলছে, তেমন শ্রাবণ কেন চারিদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে না? একটা সময় তো এই পুনর্ভবায় স্নান করে মানুষ পুন্য খুঁজত? মাধব বলছে, নদীটাকে তো মানুষই মেরে ফেলল। 
কী করে?
ওপারে জল চুরি আর এপারে বালি চুরি। পাড়ের গাছ তো কবেই শেষ।   
এমন পুকুর চুরির কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। আনমনে পায়চারি করতে করতে বৃদ্ধ হয়ে পড়ছি। বাঁশের লাঠি হাতে এক বৃদ্ধ একপাল গরু নিয়ে নদীর সেতু পেরিয়ে এল। জিজ্ঞেস করলাম, এদিকে বন্যা হয়?
হবে না? জল ছাড়লে যাবে কী করে? নদী তো বুড়া।   
লোকটা বোধ হয় আমার অজ্ঞতা বুঝে ফিকফিক করে হেসে চলে গেল। আমিও হাসছি। প্রতি বছর বর্ষা আসে। বিচ্ছিন্নতার সুর কষ্ট দেয়। তবুও বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা না দেখলে মন ভরে না। তাই ভরা শ্রাবণের খোঁজে নদীর কাছে এসেছি।  
পায়ের কাছে ধনচে, ধুতুরা, আকন্দ, কচু আর ঘাস-আগাছায় হলুদ, সাদা, নীল ফুল। আমার ইচ্ছে করছে হাওয়ার মত সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই। মাধব ছবি তুলছে। নদীর ওপারে জমির আল ক্রমশ অজগরের মতো এঁকেবেঁকে সবুজ ঘাসের গালিচা আর জল মাটি কাদার আলপনা ছুঁয়ে হারিয়ে গেছে। সেতুর ওপর দুটো ছেলে দৌঁড়চ্ছে। কড়কড় করে মেঘ ডেকে উঠল। মাঠের ওপর বিদ্যুল্লতা। ধূসর মেঘের পেট চিরে সাদা মেঘ ঢুকে পড়ছে। কাক পক্ষীদের বাড়ি ফেরার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। শ্রাবণ ধারায় ভেসে ভেসে আমার তো সমুদ্র ছুঁতে ইচ্ছে করছে। বড় বড় ফোঁটা নেমে এল। এক ছুটে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। মাধব বলছে, এদিকের কেউ কি আমাদের স্কুলে পড়ত?
মনে পড়ছে না।  
গরম গরম তেলেভাজা আর চা হলে জমে যেত।     
আকাশ ভেঙে উপরঝান্তে বৃষ্টি নামল। বাঁধের নীচে টিনের চালা দেখে দৌঁড়ে ঢুকে পড়লাম। মাটির দেওয়াল। দরজা হাট করে খোলা। ঘরে কোন মানুষ নেই। দুয়ারে জামা কাপড় ঝুলছে। দেওয়াল ঘেঁষে বস্তা বস্তা মালপত্র আর কাঠের জ্বালানী। উঠোনের বাঁদিকে কাঁঠাল গাছ। ডানদিকে কামরাঙ্গা। তার পিছনে পুকুর। সেদিকে ব্যাঙ ডাকছে। উঠোনের শেষ মাথায় খড়ের চালাঘর। তার পিছনে ফাঁকা মাঠ। টুপটাপ কামরাঙ্গা পড়ছে। টিনের চালায় জোর শব্দ। কদম ফুলের গন্ধে শ্রাবণের বাংলা ঘিরে ধরছে। নেশা জড়ানো ভালোলাগায় এলিয়ে পড়ছি। মাধব দু’হাত ভিজিয়ে চাটছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী বয়েস কমে গেল?  
ঈশাণকোণে কালোমেঘ উঠলেই স্কুল ছুটি। ভিজে ভিজে ফুটবল খেলা। আহা কী দিন ছিল!  
আর সেই বটের ঝুরি ধরে দোল খাওয়া? 
আচ্ছা প্রায় একশ কিলোমিটার তো এলাম, রাস্তায় তেমন বড় গাছ নাই কেন?       
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে- মূর্খেরও মূর্খ বড় নেতা। ফল আর কী ভালো হবে?      
হাওয়া ঘুরছে। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগছে। কাঠের স্তুপ থেকে একটা সাপ দ্রুতগতি নদীর মতো ছুটে গেল। মাধব বিজ্ঞের মতোন বলল, এটার বিষ নেই, দাঁড়াশ, তবে কাছাকাছি জাত সাপ আছে। ভয়ে ভয়ে আধ শুকনো কাপড় সরিয়ে লাফ দিয়ে দুয়ারের অন্যপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেদিকে পুকুর। পুকুরের ওপরটা অন্ধকার। উঠোন বেয়ে জল নদীর মতো গড়িয়ে যাচ্ছে। আমার তো নৌকোর মতো ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে। ছোটবেলায় এমন বৃষ্টি হলে কাগজের নৌকো ভাসিয়ে দিতাম। মাধব বলল, এরকম ঢালতে থাকলে নদী উপচে পড়বে।  
বন্যার কথা উঠলেই আমার ভেতর থেকে পুরুষ পুরুষ গন্ধ বেরিয়ে আসে। ভর যুবতীর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াই। সে এক অন্য লড়াই। যেদিকে খুশি ভেসে যাবার জন্য প্রস্তুত। মাধব বলছে, অনেকদিন বাদে বাদে নদী আবার নিজের পথে ফিরে আসে। 
ততদিন কি বিচ্ছেদের সুর বাজে?
হা-হা-হা! হড়পা বান দেখেছিস?
না।
ঠাকুমা বলত, হড়পা বানের সেই জোর। নদী ফুলে ফেঁপে রজকিনীর মতো চন্ডীদাসের হাত ধরে ছুটবে। বাঁকে বাঁকে দহ খুঁড়ে চিহ্ন রেখে যাবে। 
টিনের চালা যেন ফেটে যাবে। মাঠে জল থৈ থৈ। মাধব বলল, সেতুটা ভেঙে গেলে ফিরব কী করে? 
কেন ডুবে যাবে বলছিস?
শুনছিলাম ঠিকাদার লোহার রড কেটে নিয়ে ইউক্যালিপ্টাস গাছের ডগা ভরে দিয়েছে। থামগুলো ফাঁপা যে।
শ্রাবণ বৃষ্টির রোমান্স কেটে গেল। বড় দুশ্চিন্তা চারিদিক ভাসবে। মানুষ গরু ছাগল ক্ষেত ভেসে যাবে। সে বলছে, মোদ্দা কথা আমাদের যাই হোক না কেন আবার একদিন টেন্ডার হবে, ঠিকাদারদের সঙ্গে ক্লাবের বোঝাপড়া হবে, নেতাদের পকেটে বখরার ভাগ পৌঁছে যাবে, আবার একটা খোঁড়া সেতু হবে। 
হা-হা-হা! নদি আবার দুকূল ভাঙবে।   
কিন্তু বর্ষাটা যে আর আগের মতো আর আসছে না। 
এই তো ঢালছে। কেমন ঝমঝম আওয়াজ। 
বৃষ্টির ধারা ধূসর পর্দার মতোন কাঁপছে। দেখতে দেখতে আমাদের বয়েস কমে গেল। আমি বৃষ্টি ধরে খাচ্ছি।  মাধব গলা ছেড়ে গাইছে, “পিয়া নেহি ঘর আয়ে...।” মেঘ রাগ– যেমন পরিবেশ তেমন সুর। প্রাণের মধ্যে শ্রাবণ গুড়গুড় করছে। সব ভুলে আমিও গুনগুন করছি। কতক্ষণ যে কেটে গেল হিসেব নেই। কদম গাছের মাথায় বিদ্যুতের ঝলক দেখে মাধব চেঁচিয়ে উঠল, ঐ দেখ তোমার কালিন্দি, কদম্ব, গোষ্ঠের দল। 
বাঁশির সুর চাই তো।    
পুকুর পাড়ে দেখ গরুর পিছনে কে আসছে। আহা বরিষণ মাঝে কী সুন্দর শ্রীমতী!  
সত্যি সত্যি আমার বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে করছে। পুকুর পাড়ে এক মহিলা দু হাতে ভেজা বুক আড়াল করে এগিয়ে আসছে। আমার ইচ্ছে করছে তার হাত দুটোকে ঠেলে সরিয়ে দিই। মাধবকে বলছি, স্কুলে কি এরকম কেউ ছিল? 
হয়ত ছিল। ভেবে লাভ নাই। 
গন্ডাখানেক আঁকা বাঁকা রেখায় তাকে এঁকে ফেললাম। লালে সবুজে মাখামাখি এলোকেশী দোলনায় দুলছে। তার সারা গায়ে শ্রাবণের ধারা বিঁধছে। বুকের ওপর দিয়ে চুলধোয়া জল গড়িয়ে নামছে। মাধব রসিয়ে রসিয়ে বলছে, ভালো গতর দেখলেই তোর চেনা চেনা লাগে। হা-হা-হা! 
কী করব বর্ষা নামলেই কেমন যেন উশখুশ করে।   
মহিলাটি চপলা কিশোরীর মতো দৌড়ে গোয়ালঘরে ঢুকে গেল। চোখের ওপর শূন্য অবয়বের মতো সে কলকল করছে। মাধব বলছে, সব গরু গোঠে ফিরলেই শান্ত হয়ে যায়। ব্যতিক্রম হবে কেন? 
ঘরে লোক নাই, চল পালিয়ে যাই।
ভিজব নাকি? তাছাড়া এতক্ষণ কি বাড়ি পাহারা দিইনি?  
তোর কি কেস না খেলে চলছে না? 
বৃষ্টি থামুক, আলাপ করে যাব। নইলে ভুল ভাবতেও তো পারে।
প্রতিটি ক্ষণ যেন মহাকাল। মহিলার মুখটা কল্পনা করে ভাবছি সে বেরিয়ে এলে সত্যি কথাটা বলব। কিন্তু কী ভাবে? মাধব জিজ্ঞেস করছে, কী বলব? হঠাত বৃষ্টি এল। সঙ্গে ছাতা নাই। তাই–      
মহিলাটি একদৌড়েই ঘরে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কাঠের দরজাটাও সপাটেই বন্ধ হয়ে গেল। শ্রাবণের চিৎকার ছাপিয়ে হাজার বছরের নির্জনতা বকবক করছে। শুধু শুধু মনে হচ্ছে মহিলা জানালা খুলে জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের বাড়ি কোথায়? আমি বলব বৃষ্টি আমাদের টেনে এনেছে। আমি কল্পনায় দেখছি সে লোহার রেলিং ধরে ঠোঁট টিপে হাসছে। আমি হুড়মুড় করে ভাঙছি। মাঝখানে আদিম কামনার বারিধারা। মাধব গুনগুন করছে, “রুমঝুম কে লাগে ...; রুমঝুম কে লাগে বরষণ বদরিয়া... রুমঝুম কে...।” আনমনে বললাম, চল মাধব কেটে পড়ি।   
যেই না পা বাড়িয়েছি পিছন থেকে মহিলা ডাকল, মাধবদা বাইরে কেন? ভেতরে আসুন। 
স্বর্গীয় ডাক। পূর্ণিমার চাঁদের মতো স্নিগ্ধ হাসিমুখ। থমকে দাঁড়িয়েছি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মাধব তো তো করে বলল, কে বলতো? 
চিনতে পারেননি? আমি তো শ্রাবণী।  
আমি দৌড়ে গিয়ে কামরাঙ্গা কুড়িয়ে খেতে শুরু করলাম। গাল বেয়ে রস ঝরছে। শ্রাবণী আঁতকে উঠল, এ মা! ভিজে যাবেন যে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri