রাবণের ধারার মতো
রাবণের ধারার মতো
শ্রুতি দত্ত রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সন্ধে
সাড়ে সাতটা বাজে। এইমাত্র টি.কে.বি.র ইংলিশ অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের
প্রাইভেটের ক্লাস শেষ হল। অঙ্কুরের আজ আর বন্ধুদের সঙ্গে পড়ার পর গুলতানি
মারতে ইচ্ছে করল না। সাইকেলে উঠে সোজা রওনা দিল। শ্রাবণের মেঘে আকাশ কালো
হয়ে আছে। যখন তখন মুষলধারে নেমে পড়তে পারে জলধারা। বড় রাস্তা দিয়ে
খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকে একটা ছোট গলি। আপনমনে সাইকেল চালাতে চালাতে সেই ছোট
গলিটার সামনে এসে অঙ্কুরের কি যে হল। বড় রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়ল গলিতে।
হঠাৎই ঝুপ করে লোডশেডিং।অন্ধকার যেন এবার আরও জমাট বেঁধে এল। ডুয়ার্সের
ছোট মফস্বল শহরের এটাই দস্তুর। সামান্য বাতাস কিংবা বৃষ্টির পূর্বাভাস হলেই
বিদ্যুত পরিষেবায় ছেদ পড়ে। আর একবার ছেদ পড়লে ঘন্টা দুই তিনের আগে ফেরে
না।
ছোট গলি দিয়ে সাবধানে প্যাডেল করতে করতে
অঙ্কুর অনুভব করল হালকা একটা জলো বাতাস ওর মুখমন্ডলকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।নাকে
ভেসে আসছে ভেজা ভেজা বুনো একটা গন্ধ। তার মানে কাছেই কোথাও বৃষ্টি পড়া
শুরু হয়ে গেছে। সাইকেল থামিয়ে ব্যাগ থেকে ছাতা বের করল অঙ্কুর।পুরোপুরি
খোলার আগেই বড় বড় ফোঁটায় হুড়মুড়িয়ে মাটিতে নেমে এল শ্রাবণের
বারিধারা।
এমন প্রবল জলের
ধারা আটকানোর ক্ষমতা কি মহেন্দ্র দত্তের ছাতার কম্ম? তবুও ঘাড়ের উপর ফেলে
রেখে মোহাবিষ্টের মত সাইকেল চালাচ্ছিল অঙ্কুর। এবার আরেকবার ডানদিকে বেঁকে
বাঁদিকে ঘুরলেই বাড়িটা চোখে পড়বে।
অন্ধকারে
ঝুপ ঝুপ বৃষ্টিতে ভিজছে টিনের চালওয়ালা কাঠামো। আশেপাশের দুই-তিনটে
বাড়িতে ইতিমধ্যেই জ্বলে উঠেছে কেরোসিনের ল্যাম্প অথবা মোমবাতি। জানালা
দরজার ফাঁকফোকর কিংবা ঘুলঘুলি দিয়ে বেড়িয়ে আসছে মৃদু আলোর রশ্মি। একতলা
বাড়িটার পাশে চৌকো এক টুকরো জমি। বর্ষার জমা জলে পরিপূর্ণ। সেই জলে জমে
উঠেছে ব্যাঙেদের ফুলশয্যা। আনন্দ ধ্বনিত হচ্ছে ওদের ডাকে। বৃষ্টির
রুনুঝুনু, ব্যাঙেদের গান, টিনের চালে বৃষ্টির ধারাপাত সবকিছু ছাপিয়ে বন্ধ
দরজার ওপার থেকে ভেসে আসছে এক সুরেলা মিষ্টি গলা। শ্রাবণ সন্ধ্যায় জলো
হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে মিঠেল সুর,...."আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণ সখা
বন্ধু হে আমার....."
অঙ্কুর ছাতা বন্ধ
করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। ঝম ঝম বৃষ্টিতে এক মুহূর্তে পুরোপুরিই ভিজে গেল
শরীর। আর মন ভিজে উঠল গানের সুরে। অন্ধকারে সাইকেল থামিয়ে শরীর মন সবটা
জুড়ে ভিজতে লাগল সে।
(২)
দুম
দুম। বাইরের ঘরের কাঠের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে না? তানপুরাটা নামিয়ে
রাখল দোলনচাঁপা। এই ধুম বৃষ্টিতে, লোডশেডিং এর মধ্যে কে এল? মায়ের পেছন
পেছন মোমবাতির স্ট্যান্ডটা নিয়ে দরজার দিকে এগোল দোলনচাঁপা। দরজা খুলতেই
বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিল ওর মুখ।
"তুই! এই বৃষ্টিতে! ভিজে একদম চুপচুপে হয়ে গেছিস তো?" অবাক হয়ে বলে উঠল দোলন।
"আরে ওকে আগে ভেতরে আসতে দে...." মা পাশ থেকে বলে উঠলেন।
"না
না,এই ভেজা শরীরে আর ঢুকব না।আজ ভুল করে ছাতাটা বাড়িতেই ফেলে এসেছি।
স্যারের বাড়িতে টিউশনে এসেছিলাম। বেড়িয়েই যে এমন হবে বুঝিনি রে। তারপর
মনে হল তোর বাড়ি এদিকে।একটা ছাতা ধার দিবি? কাল কলেজে ফেরত পাবি।"
"সে হবে এখন। তুমি আগে ঘরে ঢুকে অন্তত মাথাটা মোছ। কিরে দোলন....যা, তাড়াতাড়ি একটা গামছা আন।"
মাথা মুছতে মুছতে গামছার আড়ালে দোলনচাঁপাকে দেখছিল অঙ্কুর। একটা দুধ
সাদা রঙের চুড়িদার পড়েছে মেয়েটা। সঙ্গে গাঢ় সবুজ ওড়না। খোলা চুলের
সামনের দিকে আর মুখমন্ডলে ছাঁটের বৃষ্টির জলকণা লেগে আছে। মোমবাতির তিরতিরে
অথচ মোলায়েম আলোতে বৃষ্টিস্নাত দোলনচাঁপা ফুলের মতই স্নিগ্ধ সুন্দর
লাগছে রক্ত মাংসের দোলনচাঁপাকে।অঙ্কুরের চোখে ঘোর লেগে গেল। বুকের মধ্যে
তখন ভরা তিস্তার ছলাৎ ছল। মন গাইছে, "এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর
বরিষায়....."
(৩)
আবহাওয়াটা
আজ বড় গুমোট হয়ে আছে।আকাশ মেঘলা সকাল থেকেই। একটু আগেই দোলনচাঁপাকে ওরা
নিয়ে গেছে। এই ভ্যাপসা গরমে ধূপকাঠির উগ্র গন্ধ উঠোনের বাতাস আরও ভারী করে
তুলেছে। খোলা আকাশের নীচে একটা মোড়ায় চুপচাপ বসে ছিল অঙ্কুর। পুত্রবধূ
মৌমিতা বার দুই তিন অনুরোধ করে গেছে ঘরে যাবার। তারপর কি ভেবে বেশ কিছুক্ষণ
আর কাছে আসছে না। হয়তো জীবনসঙ্গী চলে যাবার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠার
জন্য কিছুটা ব্যক্তিগত পরিসর দিচ্ছে বৃদ্ধ শ্বশুরকে।
অঙ্কুরের শুকনো নিস্পৃহ দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে অতীত ভিড় করে
আসছে।কলেজের সহপাঠীকে কোন এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় নতুন রূপে আবিষ্কার করার পর
থেকে সহধর্মিনী হিসেবে এতগুলো বছর একসাথে কাটানো। আটত্রিশ বছরের বিবাহিত
জীবনে কত স্মৃতি। এ বাড়ির প্রতিটি আনাচে কানাচে যার হাতের ছোঁয়া এখনও
লেগে আছে, একমুহূর্তে সে কেমন অতীত হয়ে গেল। ভাবতে ভাবতে চোখ জ্বালা করছিল
অঙ্কুরের। কতক্ষণ একভাবে বসেছিল কে জানে। সম্বিত ফিরল গায়ে বৃষ্টির জল
পড়ায়। ধূপকাঠির গন্ধ চলে গিয়ে ভেজা বাতাসে উঠোনের এককোণ থেকে ভেসে আসছে
দোলনচাঁপা ফুলের গন্ধ।
ফুলের বাগান করার শখ
ছিল দোলনচাঁপার। জবা, গোলাপ, অপরাজিতা, নয়নতারা -সব নিজের হাতে
লাগিয়েছিল।পাকস্থলীতে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর কোথা থেকে জোগাড় করেছিল
দোলনচাঁপার আদা। প্রায়ই বলত,"আমি যখন থাকব না, বর্ষার সন্ধ্যায় উঠোন আলো
করে ফুটে থাকবে ওরা। আর তোমাকে একা ভিজতে হবে না।"
ঝাপসা দৃষ্টিতে অঙ্কুর দেখল সত্যিই আজ আরও একবার ভিজে
যাচ্ছে অঙ্কুর নিজে আর দোলনচাঁপা। ঠিক যেমন ভিজত যৌবনের উচ্ছ্বল দিনগুলোতে।
কখনও এক সাইকেলে একই ছাতার তলায়, কখনও বা পর্দা ফেলা রিকশায়, কখনও নদীর
ধারে খোলা আকাশের নীচে। এমনই বর্ষণ মুখরিত কত কত শ্রাবণ বেলায়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴