রাজেশ্বরী, রাজেশ্বরী
রাজেশ্বরী, রাজেশ্বরী
অমিত কুমার দে
--------------------------
তোমার জন্য আমার সুচে ভরালাম
অনেকগুলো নদী
রাজেশ্বরী, একটা শাড়ি বুনব!
আমার চর্যাপদ বুকে জড়িয়ে
নালন্দার পাঠঘর থেকে বেরিয়ে আসছ তুমি
নকশাআঁকা মাটির ঘড়ায় কত রোদ
জলের মতো রোদ, জ্যোৎস্নার মতো রোদ
রোদে রোদে পা ধুয়ে নিচ্ছ তুমি
সাদা সাদা আঙুলকে বেড় দিয়ে
বাতাস পরাচ্ছে ভোরের কাছে কেনা রোদআলতা!
তোমাকে পাবার আগে
গৌতম বুদ্ধকে আমার কবিতা শোনাচ্ছিলাম
বোধিবৃক্ষের নীচে বসে।
আসলে প্রতিটি কবিতার জন্মের আগে
ছয়টি দাঁত যুক্ত এক সাদা হাতি
আমার হৃদপিণ্ডে ঘুরে বেড়ায়
আমার নগরবাস হয়ে ওঠে কপিলাবস্তু
ডুয়ার্সের জঙ্গল নিমেষে পাল্টে যায়
সব শালগাছ শান্ত সমাহিত হয়ে বলে :
জন্মাও জন্মাও...
কবিতাজন্মের আঁতুড়ঘরে
চাপড়ামারিও হয়ে ওঠে লুম্বিনী
গরুমারা জলদাপাড়া হয়ে ওঠে লুম্বিনী
স্বয়ংসম্পূর্ণ চিলাপাতাও হয়ে ওঠে লুম্বিনী
এমনকি খুট্টিমারি জঙ্গলও নাম বদলায়
কোনো কোনো পূর্ণিমায় শালবনের ভেতর
যে সব অক্ষর জন্মায়, যে সব বাক্য জন্মায়
তাদের কাছে আমি মায়া হই, মায়াবী হই!
তোমার জন্য সুচে ভরালাম তিস্তা
তোমার জন্য সুচে ভরালাম কালজানি
কোদালবস্তির ধানক্ষেত
আঠাশবস্তির হলুদ সর্ষেজমি
কালাপানি নদীটার খয়েরজঙ্গল
লাভার পাইনবন অহলদাড়ার সান্তালার মরশুম
মিরিকগামী চাবাগান আর লেপচাখার আকাশ
সব এনে বুনে ফেলছি জলঢাকার মিহিন সুতোয়!
তুমি বৌদ্ধিক নালন্দার পাঠঘর থেকে
আমার জন্য আনকোরা ব্যাকরণ নিয়ে বেরিয়ে আসছ
রাজেশ্বরী, আমাকে শান্তিপাঠ দাও শান্তিজল দাও।
বিন্দুগামী রাস্তার বোগেনভেলিয়া গাছটার
সমস্ত ফুল, সমস্ত পাহাড়ি অর্কিড
পিপিংখোলার ঝাঁকবাঁধা প্রজাপতি
গাড়ুচিড়ার নীল পাহাড় আর খোলাবুক জয়ন্তীর বালু
গেঁথে নিচ্ছি ডিমডিমার জলে
হান্টাপাড়ার এক বাউদিয়া বিকেল
যত্নে সেলাই করি বর্ষাউন্মাদ সেই হাউরির স্রোতে!
বুকে ধরে রেখো প্রাচীন চর্যাপদ
কিছুটা বুঝতে পারি, কিছু কিছু না বোঝাই থাক
বুক পাতি, খালি পায়ে নেমে এসো আমার অরণ্যে!
দুহাতে বজ্র-বিদ্যুত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গারো-দেব ‘গোয়েরা’
লক্ষ্মীপূর্ণিমায় ঢাকা ধানের গোলা নিয়ে বসে আছেন ‘রোক্কিমা’
তুমি এখানে এসে বসলেই লেপচাদের গ্রামে ‘নামবুন উৎসব’
ড্রুকপার ‘ডোকো’ ভরে উঠবে কমলার ঘ্রাণে
রাভা বনবসতিতে মেয়েরা পা মেলাবে ‘নাকচেং রেণী’ নাচে
টোটোদের ‘নাকো-শা’য় জ্বলে উঠবে রোদবাতি
ওমচু উৎসবের ডাক এসে পৌঁছবে আমাদের ডাকবাক্সে
আমার কবিতার ভেতর ঢুকে পড়বে মাড়ুয়ার তৈরি ‘ইউ’!
তোমাকে এক নদী দুই নদী হাজার নদী পার করাচ্ছি
মোষবাথানের টুংটাং এনে রাখছি তোমার উঠোনে
বার্ধক্যকে শস্যক্ষেতের ভেতরে লুকিয়ে রেখে
কাঁঠাল কাঠ দিয়ে একটা নতুন দোতারা বানাবেন নরেন রায়
আমরা দুজন তাঁর পায়ের কাছে বসব বলে
কাঠের পিঁড়ি এনে রেখেছে গামহারি গাছ
দরিয়া বাজাতে গেলে কাঁদতে হয় মেয়ে
তাই কোনো নিঝুমের কাছে
এসো আজ কান্না শিখে নিই!
একশো বছরের ওপার থেকে
জেগে উঠুক সেই সব বৃষ্টির পথ
ছাঁট দিয়ে ঢেকে যাক অলৌকিক মাষানমন্দির
গরুর গাড়ির সঙ্গে মিশে যাক আমাদের সহজ সরল!
ঠোঁটের ওপরে রেখো প্রেম-প্রেম সান্ধ্যভাষাগুলো
আর কারো পাঠ নয়, আর কারো স্পর্শটুকু নয়
অদ্বিতীয় অভিধান আমার কাছেই থাক গচ্ছিত গোপন!
তোমার প্রজ্ঞার কাছে নতজানু হোক উদ্ধত বাইসন
জঙ্গল ফুঁড়ে বের হয়ে আসা অতিকায় দাঁতাল
তোমার কাছ থেকে জেনে নিক বৌদ্ধ গুম্ফার আখ্যান
তারপর আমাদের চিরায়ত মাধুকরী
তোমাকে গেরুয়া পরাব মেয়ে
চুলে দেব সন্ন্যাসী জঙ্গুলে ফুল
তোমার শরীরে দেব শালগাছ থেকে নেওয়া
ধুনোর সুবাস
আমি তো বনের কাছেই থাকি, তুমি কেন বন্য হবে না?
সিন্ধুসারস হয়ে উড়ে যাচ্ছি তোমার সাকিনে
সন্ধে নামার আগে তুমি মানে ময়ূরের ডাক
আমি মানে চিলৌনি গাছের ডালে একা হতবাক
ঘরছাড়া বেখাপ্পা ধনেশ পাখি
ভুলে গেছি কোথায় ছিলাম কিংবা কোনখানে থাকি
খুঁটে খুঁটে খেয়ে যাই নিজের পড়ন্ত বেলা
নিজের অসমাপ্ত আর অনেক করুণ
নিজেই কখনো যেন ব্যাধ হই
করাতে গাছকে কাটি, ধনুকে চরাই তির
তোমাকে না পেলে নিজে বড়ো অস্থির
নিজের তিরেই নিজে অরণ্যে খুন!
রাজেশ্বরী, তবু তোমার জন্যই গড়ে রাখি এই তাঁতঘর
এখানে ছাউনি নেই, নেই কোনো ছাদ
আমাদের জীবনের গোপন সংবাদ
জেনে গেছে মহাকাল, জেনে গেছে নিমগ্ন ঝড়
কখনো শ্বাপদসংকুল, কখনো বা ভয়ার্ত খাদ
আমি যদি বুনো হই, যদি হই মাড়ুয়ার মদ
তবুও মুঠোতে রেখো আমি নামে এক চর্যাপদ!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴