রঙ-বেরঙের টুপি ও জয় গোঁসাই
সুমনা ঘোষ দস্তিদার
------------------------------------------------
শহরের
বি.এড কলেজের দেওয়াল ঘেঁষে যে বিরাট মাঠ, প্রতি বর্ষায় সেখানে সার্কাসের
তাঁবু পড়ে। বাঘ, সিংহের গর্জন। পাখির কিচির মিচির। বড় গর্তে জল ঢেলে
জলহস্তীর থাকার ব্যবস্থাও হয়। সুন্দরী মেয়েদের হাসি আর কম উচ্চতার
জোকারদের কিছু হাল্কা কথাবার্তা কানে আসে দিনভর। দেওয়ালের মাঝে যে
ফাঁকফোকর, তাতে কলেজের ট্রেনিরা চোখ রাখত প্রায়শই। ওদের নিয়ে কুহু ছিল
সবচেয়ে বেশি উত্তজিত। টুকটাক কথায় কথায় শুরু হয়ে, আলাপ জমে উঠল বেশ।
কিছুদিনেই কাছের বন্ধু হয়ে উঠল সার্কাস দলেরই এক ছেলে ইন্দ্র। মাঝেমধ্যেই
ক্লাসের ফাঁকে দোতলায় উঠে যায় কুহু, ইন্দ্র দাঁড়িয়ে থাকে তাঁবুর লম্বা এক
বাঁশে হেলান দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখ রাখত ওরা। ফিরতি পথে সবার
চোখ এড়িয়ে টুক করে ছিঁড়ে নিত কলেজ বাগান থেকে রঙিন কোন ফুল। দেওয়াল টপকে
ফুল পরত গিয়ে ওপারে। সে ফুল কুড়িয়ে সযত্নে বুক পকেটে সাজিয়ে রাখত ইন্দ্র।
শ্যামলা, পান পাতার মত মুখ, মায়াবী কাজল পরা দুই চোখ কুহুর। ইন্দ্র মাঝে
মধ্যেই বলত,"দিদিমণি, আর একবার হাসুন না প্লিজ! হাসলে আপনাকে কী সুন্দর যে
দেখায়!" কথা শুনে লজ্জায় গজদাঁতে মিষ্টি হেসে, লম্বা বেনী দুলিয়ে, কাঁধ
ঝাঁকিয়ে হাসত কুহু।
এইতো সেদিন কলেজে না গিয়ে,
তিথির সঙ্গে সার্কাসে পরপর দুটো শো দেখেছে ওরা। মাত্র আড়াই ফুট উচ্চতা।
ঢোলা রঙ বেরঙের শার্ট প্যান্ট পরা ইন্দ্রর মাথায় লম্বা এক টুপি। ছোট্ট
বলিষ্ঠ শরীরটাকে দুমড়েমুচড়ে সাহসে ভর করে ভয়াবহ কত খেলাই না সে দেখাচ্ছিল!
কখনও ভয়ে চোখ বন্ধ করে তিথির হাত খামচে ধরেছে কুহু। আবার কখনও ওর হাবভাবে
হেসে লুটিয়ে পড়েছে।
দর্শন নিয়ে স্নাতক করা ইন্দ্র অত
বছরেও কলেজে, অপমান, ঠাট্টা, বিদ্রূপ, রসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি।
দিনের পর দিন ভিজে যেত রাতের বালিশ। এ চেহারা, এ উচ্চতার জন্য তো ও দায়ি
নয়! কেউই দায়ি নয়! তবুও মেধাবী ইন্দ্রকে হেনস্থা হতে হত ঘরে বাইরে
প্রতিনিয়ত। পড়া ছেড়ে সার্কাস দলে নাম লেখায়। নিজেকে তৈরি করে। এখন দর্শকদের
হাততালির আওয়াজটুকু নিয়ে ও ঘুমোতে যায়। পছন্দের গান শোনে। সঙ্গে থাকে
কবিতার বই। বেশ রাত হলে কুহুকে ফোনে এসব কথাই বলে ইন্দ্র । জীবনের পাওয়া,
না পাওয়ার গল্প। সে চাঁদের রাতে যখন আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল,
কোথায় যেন বউ কথা কও ডেকে উঠেল, সেদিন ইন্দ্র বলেছিল, "দিদিমণি জয়
গোঁসাইয়ের কবিতা শুনবেন?" সে রাতে বৃষ্টি কখন থেমেছিল জানেনা ওরা কেউই। বছর
ঘুরেছে, কিছু নতুন বইয়ের মোড়ক, চকোলেটের মোড়ক, কিছু শুকনো ফুল, কখনও
ইন্দ্রের দেওয়া পেনের কালি ফুরিয়ে যাওয়া রিফিল হাওয়ায় ঘুরপাক খেয়েছে, ধুলোয়
মাখামাখি হয়ে পথে গড়িয়েছে। বর্ষাবরণ উৎসবে কলজে আসবে কুহু। ফিরতি পথে
ইন্দ্রের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবে, এমন আব্দারই করেছে কুহু। ইন্দ্রের মুঠো
ভর্তি কুহুর প্রিয় বকুল, আর আফফাফ সেই বিখ্যাত আতর। কুহু আর তিথি এল। হাতে
কদম ফুল, ঘন নীল শাড়ি পরনে। কপালে লাল টিপ। কুহুকে দেবী মনে হচ্ছিল
ইন্দ্রর। চোখ নামিয়ে বড় জারুল গাছের নিচে ইন্দ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে কার্ড
এগিয়ে ধরে কুহু। একটু ঝুঁকে কাঁধ নামিয়ে কুহু বলে, "আমি কিন্তু কোন অজুহাত
শুনতে চাইনা। বোশেখের পাঁচ। যেখানেই থাক, ওদিন আমি আমার বাড়িতে তোমায় দেখতে
চাই, ব্যস।" খুব জোরে অনেকটা বাতাস বুকে টেনে নেবার চেষ্টা করল ইন্দ্র।
কত্ত ওপরের এই রিং থেকে ওই রিংয়ে হাত ছেড়ে ঝুলে কত খেলা দেখিয়েছে, ঝাঁপিয়ে
পড়েছে নিচে, তবু তো এমন তোলপাড় করেনি বুক! এ বাদল দিনের এমন আঁধারের চাইতেও
ঘন আঁধার নামছে তার চোখে! হিম শীতল এক স্রোত প্রতি রক্ত বিন্দুকে ছুঁয়ে
ছুঁয়ে যাচ্ছে যেন! কুহুর চোখের দিকে তাকাতে হলে তাকে মাথা পেছনে হেলিয়ে
অনেকটা উঁচুতে তাকাতে হয়। ইন্দ্র তাকাল। হাতে ইশারা করে সম্মতি জানাল।
কিছু শুকনো বাতাস আর তীব্র শব্দ বুক বেয়ে গলায় আটকে গেছে। কুহু হেসে লম্বা
বেনী দুলিয়ে কিছু ঝরে পড়া জারুল মাড়িয়ে চলে গেল। তিথির চোখের জল গাল বেয়ে
বুক ছুঁল। ও বলল, 'বকুল দিলেনা কুহুকে? ওই আতর? আনলে কেন তবে? "ইন্দ্র জোর
করে মিথ্যে হাসি টেনে বলল, 'ওর চুলে ফুল ছড়িয়ে দেব, গালে আতর ছোঁয়াব, সে
উচ্চতা যে আমার নেই রে, আমার হাত যে ওর গাল পর্যন্ত পৌঁছোয় না...।' ঘরে
ফিরে জয় গোঁসাইয়ের খুলে রাখা বই সরিয়ে, আবার রেখেদিল রং বেরঙের জোকারের
টুপি। সে রাতে তুমুল বৃষ্টি নামলে খোলা মাঠে একা ভিজেছিল সে...