ছেলেটা ফুটফুটে। ছেলেটার দিদিও। ওদের দুজনকে নিয়ে মা বাবার বিশেষ চিন্তা কখনোই থাকেনা। তবে পরিবারে গুরুজন মানে দাদু, ঠাকুমা এঁদের মত একজন দুজন আত্মীয়ের অভাববোধ করে ঐ ছেলে মেয়ের মা। ওর নাম বিনি। উত্তরের ডুয়ার্সের এ শহরে চাকরীসূত্রেই আসা। আর চাকরীর পাঁচ ছ মাস যেতে না যেতেই এখানেই বিয়ে। তারপর ভাড়াবাড়ী। দু ভাই এর সংসারে থাকতে থাকতেই গভর্মেন্ট কোয়ার্টার পেয়ে উঠে আসা। আর সেখানেইতো বিনির ডল পুতুলের মত এক মেয়ে হল, নাম রাখল তুলতুল। বিনির
নিজেরই পঁচিশ, এখনো শরীর থেকে ইউনিভার্সিটি, কলেজ গন্ধ যায়নি তার আবার মা হওয়া। কিন্তু ভারী আনন্দ। খোলা হাওয়া আর উদার আকাশের দিকে তাকালে যেমন মন রোদ্দুর হয়ে যায় ঠিক তেমন। মাঝে মাঝে মা বাবার জন
্য দু:খ দু:খ মনটাও ঐ জ
্যান্ত পুতুল পেয়ে আনন্দে ভরে গেছে। স্কুলে অজস্র ছাত্রীরা ওর বন্ধু, আর বাড়ী ফিরে ঐ ঝাঁপিয়ে কোলে এসে ওঠা প্রিয় পুতুল তুলতুল ওর সোনার মেয়ে। আলোর মেয়ে। মনে মনে নিজের গড়ে ওঠার সঙ্গে মিলিয়ে মেয়েকে নিয়ে ভাবে।কত ছোটতেই সুর আর কবিতার ছন্দ ওর শরীর জুড়ে। অনায়াসে সুর আসে পাখির মত। স্কুল স্কুল...বয়স তিন হল কি হলনা মায়ের স্কুলের পাশে শিশুনিকেতনে ভর্তি হল তুলতুল। ওর এক পোষাকি নাম হল স্কুলের খাতায় 'প্রজ্ঞাপারমিতা'। আহা! অতবড় নাম ধরে ডাকতে সকলের বয়েই গেছে। কেউ বলে প্রজ্ঞা,কেউ তুলি। ও মার সঙ্গে রিক্সায় স্কুলে যায়। মা ওকে নামিয়ে দিয়ে নিজের স্কুলে ঢোকে।...ইতিমধ
্যে বেশ পুরস্কার টুরস্কার পেয়ে গেছে তুলি।নাচ, গান, কবিতায়। ক্লাসেও 'প্রমিসিং'বলেছেন ক্লাস মিস। বিনির যেন দুখানা ডানা নয়, চারটে ডানা।নিজের গানের ঘরে অদ্ভুত পুতুল, নড়াচড়া করা পুতুল বড় হয়। ..এবার তুলতুলের এক ছোট্ট ভাই এল, বুমবুম। বিনির খাটুনী বাড়লেও আনন্দ আর আনন্দ। ঘর ভরে থাকে ওর। তবে তুলি যেন একটানে বড় হয়ে যায়। তাকে শুনতে হয়,বড় হয়েছ, তোমার কি এটা করা সাজে! ভাই শিখে নেবে। একটু আধটু শাসন তর্জন ও করে ফেলে বিনি। পরে কষ্ট পায় রাতের নির্জনে। তুলি ঘুমিয়ে পড়লে চুলে বিলি কাটে। বুমবুম বড় মার কাছ ঘেঁষা। আর দুজনেই বড় যত্নের। যত কাজই থাক, দুজনকে দশটার মধ
্যে স্নান করিয়ে খাওয়ার ব
্যবস্থা করে বাড়ী থেকে বেরোয় বিনি। দুপুরের মাসী ঘরে এলে তবেই বিনি স্কুলে বেরোয়। তুলিকেও তৈরি করে, সঙ্গে নিয়ে যায়। এভাবেই বেশ গানে গল্পে খেলায় কাজে আর জ
্যান্ত পুতুল নাড়াচাড়ায় বিনির কাটছিল বেশ। হঠাৎ নতুন বাড়ী একটা তৈরি করতে হল। কোয়ার্টারের স
্যাঁতসেঁতে ঘরে বিনির শ্বাসকষ্ট হল যে! সঙ্গে বুমবুমের ও। তাই ওদের বাবা তিলক বহু চেষ্টায় জমি দেখে নিল। আর বাড়ীটাও থাকার মত তৈরি হল ধীরে। দুবছরের বুমবুম আর সাড়ে ছ বছরের তুলতুলকে নিয়ে উঠে এল বিনি, তিলকের হাত ধরে অন
্যপাড়ায়। বেশ বনেদি পাড়াটি। সামনেই কালীবাড়ী। আর শহরের মধ
্যিখানে। তবে তুলতুলের পুরোনো বন্ধুদের ছেড়ে আসতে ভারী কষ্ট হল। এখানে অবশ
্য খুব কম সময়েই বন্ধু হল অনেক। মিমি, বুড়ি, সুমি আরো কত। ওদিকে বিনি পড়ল বিপাকে। সেই আগের মাসীকে তো এ নতুন বাড়িতে কাজে আনা গেলনা। হাউসিংএর কাছে তিস্তার ঐ পাড়ে তার বাড়ী। খেত, ধান এসব নিয়ে ঐ মাসীর খুব দূরে কাজের বাড়ীতে আসা অসুবিধে। অবশ
্য কারো জন
্য তো সময় আটকে থাকেনা। পেয়ে গেল আর এক মেয়ে নিনিকে। ও ছেলের দেখাশোনা করত ভালো।
কিই যে হালকা পাখির মত লেগেছিল সেদিন বিনির। তুলতুলকেও টেষ্ট করানো হল। কিছুই পাওয়া গেলনা। সেদিন সকলে চাপমুক্ত হয়ে চেন্নাইয়ের মেরিন সী বিচে অদ্ভুত আনন্দে কাটল।পরদিন সাইড সিন। তার পরদিন বিনিদের পাঁচজনের টিম গাঙচিলের মতো উড়েই চলল উটির দিকে। আনন্দে খোলা হাওয়ায় হালক মনেও বিনি কেঁপে ওঠে, ভাগ্যিস শিলিগুড়ির ঐ ওভার কনফিডেন্ট ডাক্তারী সিদ্ধান্ত কাটাতে পেরেছিল, তাহলে যে কি হত....ফুৎকারে ঐ কালো কুৎসিত ভাবনাকে দূরে আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে উটির রাস্তায় গাড়ীর ভিতরেই তুলতুল আর বুমবুমকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বিনি। জানলার কাচের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে রোদ্দুর তখন খুশি মাখিয়ে দিচ্ছে।