মানবের সে সন্তান
মালবিকা মালবিকা
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
হলুদ
আলোটা গুটি গুটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। শ্রীময়ীর চোখ দুটো ভয়ে বেরিয়ে আসতে
চাইল। ন্যাশন্যাল হাই ওয়ে, চৌরাস্তা। আশেপাশে লোক বসতির কোন চিহ্ন নেই। বড়
বড় ট্রাক, লরি, তুমুল বৃষ্টির ধোঁয়ায় অদৃশ্য থেকে অদৃশ্যের দিকে চলে
যাচ্ছে। রাস্তার এপারে ওপারে অস্থায়ী ঝুপড়ি ঝুপড়ি দোকানগুলো পর্যন্ত
বৃষ্টিতে ঢেকে গেছে। শ্রীময়ী একা দাঁড়িয়ে আছে হাই ওয়ের ধারে চৌরাস্তায়,
চরাচর মুছে দেয়া বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। হলুদ আলোটা আরও কাছে এগিয়ে এল।
শ্রীময়ীর
খুব শীত করছে। হাত-পা-শরীর সব আলগা হয়ে যাচ্ছে। হলুদ আলো এক্কেবারে তার
সামনে এসে স্থির হয়ে গেল। হাতে ধরা ছাতাটা আলগা হয়ে বৃষ্টির দাপটে দূরে
গিয়ে পড়ল। দুটো রোমশ হাত তার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে! অন্ধকার ....ভয়ানক
অন্ধকার! পৃথিবীর শেষ আলোটাও যেন এই মুহূর্তে নিভে গেল ...!
.......চোখ খুলুন! উঠুন ! কী মুশকিল! আরে আমি !
রোমশ হাত তবে এখনও তার আশেপাশেই আছে! শ্রীময়ী থরথর করে কাঁপছে।
.....ম্যাডাম..আমি। আপনার কোন ভয় নেই। মনে একটু সাহস আনুন। আপনি নিরাপদ।
....গলার স্বর তো চেনা নয়! তবে, রোমশ হাতকে আর অতটা ভয়ানক মনে হচ্ছে না! তার হাত দুটো যেন বড় আশ্বাসে ধরে রেখেছে।
শ্রীময়ীর নিশ্বাস ছন্দে ফিরছিল। চোখ খুলে তাকাতেই আবার সব অন্ধকার।
.....উফ্ফ্! আমিও তেমনি আহাম্মক! ..বলে হেলমেট টা খুলে ফেললেন।
.....কি চিনতে পারলেন?
শ্রীময়ী একটু সময় নিল। খুব যে পরিচিত তা নয়! সোজা হয়ে দাঁড়াল সে।
.....আসলে আমি।
.....আপনি
ভয় পেয়েছিলেন। এই তুমুল বৃষ্টিতে, জনমানবহীন রাস্তায়, এই রাতে আপনি একা
দাঁড়িয়ে আছেন! তাতে আপনি যদি ভয় না পান সেটা কি খুব স্বাভাবিক হত? কিন্তু
এবার একটু শক্ত হয়ে দাঁড়ান, ছাতাটা তুলে নিয়ে আসি।
এতক্ষণে শ্রীময়ীর মনে হল তীব্র বৃষ্টি ফোঁটা শরীরে এসে বিঁধছে।
.....আপনি আমার মোটর বাইকে যেতে পারবেন তো? এছাড়া তো অন্য উপায়ও দেখছি না! আর কোন টোটো পাবেন বলে তো মনে হচ্ছেনা!
.....না , না ! ছিঃ ছিঃ, আমি আপনার সাথেই যাবো।
.....সব সংশয় দূর হয়েছে তো? এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও আর নিরাপদ নয়!
শ্রীময়ী লজ্জা পেল। ভরসা করল।
অফিস
থেকে বেরিয়েই শ্রীময়ী বুঝেছিল, আজ দুর্ভোগ আছে। অফিস গলিটায় হাঁটুর ওপর
পর্যন্ত জল! দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই। কটা বাস যে ছাড়তে হবে ভিড়ের জন্যে! রাত
বাড়ছে। বাসটা জল ঠেলে চলছেও ধীর গতিতে। দক্ষিণেশ্বর পেরোতেই আবার বৃষ্টি
ঝেঁপে। শ্রীময়ীর মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে গত সপ্তাহেই খবরের কাগজে বেরোনো
খবরটা। এই রাস্তার ধারেই বনের মধ্যে পড়েছিল মেয়েটির খুবলে খাওয়া দেহ!
শ্রীময়ী তবুও সাহস হারাল না। নির্দিষ্ট জায়গায় নেমেই, দাঁড়িয়ে থাকা
বাসগুলোর দিকে ছুটে গেল। একজন বলল
...লাস্ট বাস চলে গেছে।
লোকটির থেকে একটু দূরত্ব রেখে শ্রীময়ী দাঁড়িয়ে রইল টোটোর অপেক্ষায়।
.....ওই
তো একটা টোটো আসছে! অলরেডি চারজন প্যাসেঞ্জার! সে পৌঁছানোর আগেই ওই লোকটা
গিয়ে তাতে বসে পড়ল। তবুও সে টোটোর সামনে দাঁড়িয়ে রইল আশা নিয়ে, কেউ একজন
বলবে
...'আপনি চলে যান। আমি পরের টোটো ধরে নেবো।'
এবার শ্রীময়ীর খুব অসহায় বোধ হল। এমন কেউ নেই যাকে ফোন করে আসতে বলবে! এত বৃষ্টিতে আসতে বলেই বা কি করে!
......আপনি ঠিক আছেন তো? এসেই গেছি প্রায় আপনার বাড়ির মোড়।
শ্রীময়ী
কাউকে বিব্রত করতে চায় না। তার জন্যে এ মানুষটি অসুবিধেয় পড়লেন নিশ্চই, এ
ভাবনা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। পরিচিত হবার তো সুযোগই হয়নি, এমনকি আলাপও
হয়নি। বাসে শুধু মাত্র কিছুটা পথ একসাথে যাওয়া। এক মোড় থেকে আর এক মোড়ে সে
নেমে যায়, অন্য রুটের বাস ধরে। মানুষটি চলে যান ওই বাসেই। দেখেছে শুধু
এতটুকুই। তবে বেশ কয়েক দিন ইদানিং দেখতে পায়নি ! এবার বুঝল তার কারণ, মোটর
বাইকে যাওয়া আসা করছেন।
.....ম্যাডাম আপনি এখানেই নামবেন তো ?
শ্রীময়ী নেমে এল। ধন্যবাদ নয়, আনত হয়ে নীরবে বারবার প্রণাম জানিয়েছিল মানবের সে সন্তানকে।