মা-ভাষার ক্রন্দন
মা-ভাষার ক্রন্দন
দীপ্তি রায়
============
“দিনযাপনের ভাষা সর্বত্রই মাতৃভাষা।” অত্যন্ত মনোগ্রাহী কথা। কিন্তু গভীর জিজ্ঞাসারও জন্ম দেয় -এই মা কোন্ মা -ভাষা-মা, না দেশ-মা। দেশ-মা বলতে বুঝি শাসক-শক্তি যে ভাষায় কোন ভূখণ্ড শাসন করে। ভাষা মা একটি শিশু জন্মানোর পর মায়ের কোলে-পিঠে লালন-পালন হতে হতে মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা শুনে, বুঝে সে অনায়াসে রপ্ত করে সেই ভাষা। এ. কে. রামানুজ আবার ভিন্ন দিক থেকে দু’রকম ভাষার কথা বলেছেন। পিতৃভাষা ও মাতৃভাষা। শেখা ভাষা হলো পিতৃভাষা। মাতৃভাষা
প্রণালীবদ্ধভাবে শিখতে হয়না, যা জন্ম মুহূর্ত থেকে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আয়ত্ব করি। কবি কমল দাস লিখেছেন, “I am Indian …/I speak three languages, written/Two, dream in one.” এই স্বপ্ন দেখার ভাষাই প্রকৃত অর্থে মা-ভাষা।
ভারতভর্ষের যেকোনো প্রান্ত ভূখণ্ডে বসবাস করে, মাতৃভাষা ব্যবহার ও চর্চা করে ভারতীয়ত্ব পরিচয় রক্ষায় কোনো বাধা থাকার কথা নয়। বিপত্তির কালো মেঘ তখনই ঘণীভূত হয় যখন মা-ভাষা দেশভাষার অধিকার অর্জনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। হয়তো এই আশঙ্কা থেকেই দেশভাষার সঙ্গে মা-ভাষার চোরা লড়াই ছিলো, আছে, থাকবে। পৃথিবীর সর্বমোট (প্রায় সাত হাজার) মাতৃভাষার প্রায় অর্ধকেরও বেশি আজ বিলুপ্তির পথে। কেন্দ্র ও প্রান্তভাষার লড়াই ভাষা বিলুপ্তির একটি অনুকারণ মাত্র।
মাতৃভাষার প্রতি অনিবার্য অনিহা, কেন্দ্রভাষিকের প্রান্তভাষিকের প্রতি অবজ্ঞা, তাদের আচার-সংস্কার-সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ, বিদ্রুপাত্মক মনোভাব, বৃহৎ শিক্ষাঙ্গন, কর্মসংস্থানের জগতে তথ্য প্রযুক্তি, অনলাইন অ্যাকসেসের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা ভাষা বিলুপ্তির নানাবিধ কারণের কয়েকটি।
“Languages have no existence without people.” ডেভিট ক্রিস্টালের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে সংকটের আরও গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে। মানুষ ছাড়া ভাষার অস্তিত্ব নেই। তরাই্য়ের যে মানুষটি ধীমাল ভাষায় কথা বলতো, ডুয়ার্সের যে টোটো, সাঁওতাল, ওঁরাও, খেরিয়া পরিবারটি তাদের নিজস্ব ভাষায় ভাব বিনিময় করত উত্তরবঙ্গের যে পরিবারটি পূর্ববঙ্গীয় অথবা রাজবংশী ভাষায় কথা বলত বর্তমানে জীবিকা সূত্রে মাতৃভাষার সংস্রব পরিত্যাগ করে শহুরে জীবন-যাপন করে আপাত কেন্দ্রীয় ভাষা-সংস্কৃতির চৌম্বকাকর্ষণে নিজেকে ধরা দেওয়া অথবা মিশিয়ে ফেলার তাগিদে উত্তরসূরীকে নিজের মা-ভাষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে --সেই সমস্ত ক্ষেত্রে শুধু কি একটি ভাষার মৃত্যু নাকি সেই সঙ্গে একটি পরিবার থেকে আচার-ব্যবহার, শিক্ষা-সংস্কৃতির অনিবার্য পলায়ন?
মায়ের মূখের ভাষাকে অবজ্ঞা করার পরিণাম বৃহত্তর এক প্রান্তবাসী শ্রেণিকে প্রথাগত শিক্ষার আলো থেকে তাদের ক্রমশ দূরে সরিয়ে রাখা, কেন্দ্রীয় ভাষা-সাহিত্য-শিক্ষা শক্তি থেকে তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া। অন্তত কেন্দ্রীয় ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতির স্রোতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার তাগিদেও বিদ্যালয় শিক্ষার একটি স্তর পর্যন্ত ভাষা বৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখা আবশ্যক। দেড় শতাব্দ পূর্বে প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে লিখেছেন, “বাচনিক ভাষায় পুস্তক লিখিলে ত্বরায় এমন এক স্বতন্ত্র ভাষার উৎপত্তি হইবার সম্ভাবনা যাহা কলিকাতা ও তন্নিকটবর্তী স্থান ব্যতীত সর্ব্বত্র অবোধ্য হইবে। অপর বঙ্গদেশের লোকেরা ঐ দৃষ্টান্তের অনুগামী হইয়া আপন আপন পল্লীর বাচনিক ভাষার পুস্তক রচিলে বঙ্গদেশে যত জেলা আছে ততসংখ্যক নতুন ভাষা প্রস্তুত হইবে।” এ প্রসঙ্গে মধুসূদন দত্তের অভিমত, “প্রত্যেক জাতির মধ্যে অভিব্যক্তির একটি বিশেষ রীতি আছে বলে আমি বিশ্বাস করি, যা কখনো অচল বলে বর্জিত হয় না।” পূর্ব ভারতের সীমান্ত রাজ্য অরুণাচল প্রদেশে এখনো প্রায় ৫০টি ভাষা নিজেদের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, ঘর-দোর, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভাস ও সামাজিকতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রায় ২৫টি জনজাতি সেখানে বাস করছে।
ভাষা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক একটি জাতির প্রচলিত প্রাচীন অতীতগুলি (popular antiquity) ক্রমে বিলুপ্তির পথে হাঁটতে শুরু করে। মানুষের চিরাচরিত সাংস্কৃতিক ব্যবহারের (cultural behabiour) স্বতস্ফূর্ত অনুশাসনের উপর থাবা বসানোর সুযোগ পায় মেকি সংস্কৃতির প্রলুব্ধ নখর। শেষকথা অন্যের দিকে তর্জনী নির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যমা, অনামিকা, কনিষ্ঠা নীরবে নিজের দিকে তাকায়। এখন সময় সেই নিষ্পলক চোখের ভাষা ডিকোডিং করার । হাত গুটিয়ে থাকলে নোবেল চুরির ক্ষতচিহ্ন মিলিয়ে যেতে না যেতে আমাদের বিশ্ববাঙালি কবির প্রাণের ভাষাটাও চুরি হয়ে যাওয়ার পথ তৈরি হয়ে যাবে না তো!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴