ভূত রাজার দেশে
ভূত রাজার দেশে
শ্বেতা সরখেল
------------------------
তুহিন বারবার ডালিমটারেই যায় কেন এ প্রশ্ন সকলের মতো তুহিনের বান্ধবী হিয়ারও। হিয়া যে কতবার তুহিনকে জিজ্ঞাসা করেছে যে, ডুয়ার্সে দেখার জায়গা তো কম নেই, চাইলেও এক জনমে সবটা বেড়িয়ে ওঠা সম্ভব নয়, তা সত্ত্বেও বারে বারে ডালিমটারেই কেন। তা ছাড়া হিয়া কত বার যেতে চেয়েছে ওর সঙ্গে, কিন্তু কিছুতেই নিয়ে যায়নি তুহিন। এমনকি ওখান থেকে ঘুরে আসার পরও বেড়ানো প্রসঙ্গে কোন কথা হলেই তা সুন্দর করে এড়িয়ে যায় ও। হিয়ার কৌতূহল আরও বাড়ে, বাড়তেই থাকে। এতে খুব মজা পায় তুহিন।
মালবাজার থেকে গরুবাথান হয়ে পাহাড়ের দিকে এগোলে একটা খাড়া রাস্তা ওপরে উঠে গিয়ে অনেকগুলো হেয়ার পিন টার্নিং পেরিয়ে একটা ফাঁকা ময়দান মতো জায়গায় এসে থামে। তারপর আবার অন্য রাস্তা ধরে অন্য রুটে যেতে হয়। কিন্তু এ রাস্তাটা সরাসরি এসে ঠেকেছে এখানেই, অশ্বিনী রাইয়ের হোমস্টেতে। ভাড়া গাড়িতে এলে বেশ খানিকটা হেঁটে আসতে হয়। তুহিন এসে এখানেই থাকে।
অশ্বিনী আংকলের সঙ্গে এতটাই সখ্যতা হয়ে গেছে তুহিনের, যে, আজকাল ও এলে আর অতিথি হিসেবে গণ্য হয় না। বরং টাকাকড়ির সম্পর্কটাও বেশ ঢিলেঢালাই। কখনও বা দিচ্ছে কখনও বা দু’এক দিন থাকলেও দিচ্ছে না।
অশ্বিনী সারাদিন নিজস্ব খেত খামারের কাজ করেন তারপর সন্ধে হলেই শুরু হয়ে যায় গল্প। এখানে টিভি নেই। ফলে সন্ধেবেলাটা পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করাটাই দস্তুর। খেত বলতে বাড়ির সামনের অল্প জমিতে নিজের জন্যে ধান করেন, সেই চাল দিয়ে বেশ কয়েকটা মাস চলে যায় ওদের। একটু জমিতে কিচেন গার্ডেন আছে। ফুলকফি আর বাঁধাকফিটা সারা বছর হয়, সেই সঙ্গে গাজর, মুলো, টম্যাটো, অল্প কিছু বেগুন, ধনে পাতা, পালং শাক এসবও ফলান। বাড়ির পেছন দিকটায় আছে মুরগীর ছোট্ট একটা খামার। সেখান থেকে ডিম পেয়ে যান সারা বছর। আর মাঝে মাঝে মুরগীর মাংস। তুহিনও আজকাল হাত লাগিয়ে দেয় খেতের কাজে। অশ্বিনীর ছোট মেয়েটার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে তুহিনের। বয়সে তুহিনের চেয়ে বছর ছয়েকের ছোট। তুহিনের খুব কাছাকাছি এসে গেছে এই দু বছরে। প্রকৃতি রাই নাম ওর। গত দু’বছরে না হলেও সাত-আট বার এসেছে তুহিন। ফলে ঘরের ছেলের মতো ব্যবহার পায় এখন। অশ্বিনী গল্প শোনান, তুহিন আর প্রকৃতি মনযোগ দিয়ে শোনে।
শুরুটা এই গল্প দিয়েই। ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করে অধ্যাপনা করছে তুহিন। বিষয়ের প্রতি গভীর আগ্রহ ওর। ইচ্ছে আছে ডক্টরেট করার। ডালিমটারে জাস্ট বেড়াতেই এসেছিল দুই বন্ধুতে মিলে। কিন্তু অশ্বিনীর কাছে এখানকার কাহিনী শোনার পর থেকে ও যেন আঠার মধ্যে সেঁটে গেছে। এখানকার ইতিহাসই হবে ওর গবেষণার বিষয়, এমনটাই ঠিক করে নিয়েছে মনে মনে। আর তাই একলাই কাউকে কিছু না জানিয়েই একটা ঘাঁটি গেঁড়ে নিয়েছে এখানে।
“হংস গ্যাবো আচক ছিলেন সিকিমের রাজা। ভুটানের রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে বেশ কিছু ভূ-ভাগ পেয়েছিলেন সিকিমরাজ। কিন্তু বারো বছর কেটে যাবার পরেও তাঁদের কোন সন্তান না হওয়ায় রাজকুমারী শেষমেশ ভুটানে তাঁর বাপের বাড়ি চলে যান। সিকিমরাজ ‘রাই’ পদবীযুক্ত আর এক কন্যাকে বিয়ে করেন এবং তাঁর গর্ভে একটি সন্তান আসে।পারিবারিক নানান কারণে সেই সন্তানকে মেরে ফেলার চেষ্টা হলে তাঁর নানী মেয়ের ভ্রূণকে রক্ষা করেন লুকিয়ে লুকিয়ে”।
এই গল্পের শুরু হয়েছিল যখন তুহিন প্রথমবার ডালিমটারে আসে। অশ্বিনী ‘ডালিমটার’ নামের পেছনের ইতিহাস জানাতে গিয়ে এই গল্প বলা শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে কৌতূহল বাড়ে তুহিনের। আরও না জানি কত রহস্য আছে এখানে। প্রথমবারের যাত্রায় গল্পটা পুরো শোনা হল না। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই তখনই তুহিন ঠিক করে নিয়েছিল, বার বার আসতে হবে ওকে। এখানকার রহস্যের মধ্যে ডুবে গিয়ে সমস্ত উদ্ঘাটন করে নিয়ে আসতে হবে বইয়ের পাতায়। অনেককে জানাতে হবে এখানকার কথা। সেটা একমাত্র সম্ভব ওর গবেষণার মাধ্যমেই।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবারই চলে এসেছে তুহিন। সেদিন ছিল রোববার। পরদিন সকালেই চলে যেতে হবে ওকে। জরুরি একটা ক্লাস আছে থার্ড ইয়ারের। সক্কালবেলা দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তুহিনের। প্রকৃতি চায়ের কাপ হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে। মুখে মিষ্টি হাসি। এমন সুপ্রভাত হলে কার না ভাল লাগে। তুহিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ওর নিষ্পাপ হাসির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রকৃতি মুখটা তুলল। তাকাল তুহিনের দিকে। মুখমন্ডল জুড়ে নতুন সকালের সূর্যের ছটা। তুহিনের তাকিয়ে থাকার মধ্যে একটা আবেদন প্রকাশ পেল। প্রকৃতি বুঝল সে ভাষা। চোখটা নামিয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। এ অনুভূতি আদান-প্রদানের মধ্যে একটা চোরা স্রোতে তলিয়ে যাবার ইঙ্গিত।
মাস খানেক যেতে না যেতেই আবার তুহিন চলে এল ডালিমটারে। অশ্বিনী ওর পছন্দের মুরগীর ঝোল রাঁধিয়ে রেখেছেন স্ত্রীকে দিয়ে। তুহিন নিয়ে এসেছে অশ্বিনীর প্রিয় ব্র্যান্ডের হুইস্কি। সূর্য ঢলতে না ঢলতেই দু’জনের জন্যে গেলাস পাঠিয়ে দিলেন প্রকৃতির মা, প্রকৃতির হাত দিয়ে। তিনজনে জ্যোৎস্না ভেজা রাতে ঘরের বাইরে পেতে রাখা একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চের ওপর বসল। দু’জনের হাতে গেলাস। তাতে লাল পানীয়। একটু করে চুমুক আর একটু করে গল্প। অশ্বিনী খুব রহস্যঘন একটা পরিবেশ তৈরি করে ফেলতে পারেন মুহূর্তের মধ্যে। একটুখানি ছমছমে ভাব, মাথার ওপর জ্যোৎস্নার চাঁদোয়া, পাশেই বসে আছে প্রকৃতি, সেই সঙ্গে হুইস্কির ধুন। তুহিনের বাড়ির কথা আর অবচেতন মনেও যেন উঁকি দিচ্ছিল না। এটাই যেন ওর জীবন। গল্প এগোয়। তুহিন বুঁদ হয়ে পৌঁছে যায় ইতিহাসের পাতায়। প্রকৃতি হাতটা রাখে তুহিনের রাখা হাতের পাতার পাশেই। আঙ্গুলের ডগায় ডগায় ছোঁয়া লেগে যায় হঠাতই। তুহিন আলতো হাতে ধরে ফেলে প্রকৃতির হাতের পাতা। প্রকৃতি অবশ হয়ে পড়ে। হাত সরাতে পারে না। তুহিনের হাতের মুঠোয় পেলব হাতের উষ্ণ স্পর্শ।
“এখন যেখানে ঝান্ডি, তার কাছেই ছিল চ্যাখুনডারা নামে একটি জায়গা, সেখানেই একটি গোয়ালে লুকিয়ে রেখে পুনো গ্যাবো আচককে বড় করতে থাকেন তাঁর দিদা। গ্যাবো আচককে নানান বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে থাকেন তিনি। তিনি নিজে তান্ত্রিকবিদ্যা জানতেন বলে সেটিও শেখালেন গ্যাবোকে। একটু বড় হতেই সৈনিক-বিদ্যায় দক্ষ করে তুললেন আর নিজে হাতে বেতের পোষাক তৈরি করে পরিয়ে দিলেন নাতিকে যাতে তরোয়ালের আঘাতে ক্ষতি না হয়”।
দুজনেই ধীরে ধীরে ডুবে যায় অশ্বিনীর গল্পের গভীরে। প্রকৃতি হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। তুহিনও কখন যে আলগা করেছে বাঁধন বুঝতে পারেনি নিজেও। কন্যা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল বাবার কথা। হঠাৎ বলে উঠল, “বাবা, একটু থামো। দাদাকে, আমি আমার উপহারটা এনে দিই। একটু দাঁড়াও তোমরা”। দৌড়ে চলে গেল ঘরে। নিয়ে এল কালো কাপড়ের ওপর ধবধবে সাদা রঙ দিয়ে ওর নিজের হাতে আঁকা গ্যাবো আচকের একটা ছবি। কী যে সূক্ষ্ম হাতের কাজ, তুহিন অবাক হয়ে গেল মুগ্ধতায়। একবার ছবিটা দেখে একবার প্রকৃতিকে দেখে। “এটা তোমার নিজের আঁকা? সত্যি?” “কেন? তোমার বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না?” “না তা হবে না কেন? আমি তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি তোমার কাজ দেখে। সত্যিই প্রকৃতি, তুমি অবাক করে দিলে আমায়। এ আমার কাছে বিরাট পাওয়া”। অশ্বিনী ওদের কথোপকথনের মাঝখানে বলে উঠলেন, “এখন ওর তেইশ বছর বয়স। অনেক ছোটবেলা থেকেই ওর ছবি আঁকার ন্যাক। এখন হাত পেকেছে। আমি ওকে বলেছি এরকম বেশ কিছু ছবি এঁকে রাখতে যাতে স্পেশাল গেস্ট এলে তাঁদের উপহার হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। ওর আঁকার উপযুক্ত বিচার হবে। ও বুঝতে পেরেছে তুমি আমাদের বিশেষ অতিথি, তাই তোমাকে নিজে হাতে ও এনে দিয়েছে। রেখে দাও”। সন্ধেটা আরও মনোরম হয়ে উঠল সকলের মধ্যেই।
“বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাবো নিজের বেশ কিছু সঙ্গীসাথীদের নিয়ে এক সেনানী দল তৈরি করে ফেললেন। এবার নিয়মিত সেই দলের প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করার জন্য একটা সঠিক স্থানের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তৈরি হল ডালিম গড় বা ডালিম ফোর্ট। কিন্তু তখন কোনও বৈজ্ঞানিক বাস্তুবিদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না, ফলে বড় একটা ত্রুটি রয়ে গেল দুর্গে। নিচের দিকের পাথরগুলো বড় বড়। ফলে ভারসাম্যের অভাব হল। কাঠামোগত দিক থেকে ত্রুটি থাকলেও দুর্গে প্রবেশ করা কিন্তু দুরূহ ছিল। দুর্গের ভেতরেই চলতে লাগল প্রশিক্ষণ আর সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল গ্যাবো আচক-এর আধিপত্য”। “তারপর কী হল?” কৌতূহলী তুহিন প্রশ্ন করে। অশ্বিনী বলেন, “তারপর যা হওয়ার কথা তাই হল। ব্রিটিশের চক্ষুশূল হলেন। ব্রিটিশ সেনা গরুবাথান আর নিমবস্তী থেকে কামান দেগে কয়েকবার চেষ্টা করেছিল ফোর্ট ধ্বংস করে দেবার। কিন্তু লোকে বলে, গ্যাবো যেহেতু তান্ত্রিকবিদ্যা জানতেন তাই প্রত্যেকবারই নাকি আগাম টের পেয়ে যেতেন যে আক্রমণ হবে। তাই আগে থেকেই তা প্রতিরোধ করার যথোপযুক্ত বন্দোবস্ত করে নিতে পারতেন। ব্রিটিশেরা এই ধাক্কা সহ্য করতে পারল না। ঘি তোলার জন্য আঙুল বাঁকা করল তারা”।
এবারের গল্প এই পর্যন্তই শোনা হল। রাতের খাওয়া-দাওয়ার সময় আড় চোখে দু’জনে বারবার তাকিয়েছিল দু’জনের দিকে। তুহিন আর প্রকৃতি। দেওয়া-নেওয়ার গতি দ্রুততর হল।
পরদিন দিনের বেলা ফোর্ট দেখতে যাওয়ার প্ল্যান। রবিবার ছিল সেদিন। অশ্বিনীর বাড়ি থেকে মোটামুটি কিলোমিটার পাঁচেক যেতে হল বাইকে চেপে। প্রকৃতি গেল না বলে মনটা বেশ খারাপ হল তুহিনের। প্রকৃতির মা যেতে দেননি মেয়েকে। তুহিন ভেবেছিল এটাই তো স্বাভাবিক।
দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখতে দেখতে আর গল্পের সঙ্গে মেলাতে মেলাতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল তুহিন। অশ্বিনী বুঝতে পারলেন সেটা। কোন রকম কথা না বলে ওকে একলা ছেড়ে দিয়ে বাইরে এসে একটা বড় পাথরের ওপরে বসলেন তিনি। একেকটা পাথর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে তুহিন আর গ্যাবো আচকের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে তাঁর। বেলা পড়ে এলে দু’জনে ফিরে এল বাড়িতে। প্রকৃতিকে দেখেই বোঝা গেল অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়েছে বেচারী। বাবা একটু আড়াল হতেই গলা নিচু করে বলে উঠল, “এত দেরি করতে আছে? আমি কখন থেকে ভাবছিলাম তোমার কথা!” কন্ঠে অভিমানের সুর গুনগুন করে উঠছিল। তুহিন আলতো করে নিজের দু’কানে হাত দিয়ে বলল, “সরি বাবা, সরি”। রাতে তুহিন যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল প্রকৃতি পাশে এসে বসল। বলল, “আবার কবে আসবে তুমি”? তুহিন এমন নরম কন্ঠস্বরের আকুতি শুনে ঝট করে চোখে চোখ রেখে তাকাল ওর দিকে। খুব ইচ্ছে করছিল গালে একটু হাত বুলিয়ে বলে, এই তো কয়েকটা দিন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসব তোমার কাছে।
পরদিন চলে আসবার সময় গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়ে প্রকৃতির চোখের কোণ দুটোতে শিশির জমে উঠল। সে ভাষার অর্থ ‘আবার কবে আসবে তুমি’। তুহিন অশ্বিনীর বাইকের পেছনে চেপে গাড়ি যাবার পথের মুখটায় পৌঁছে গেল। আসবার সময় যতদূর দেখা যায় হাত নেড়ে নেড়ে দুজনেই বিদায় জানিয়েছে একে অপরকে। এমন মিষ্টি সম্পর্কের ঝংকার যে তুহিনের শিরায় আর ধমনীতে বয়ে যাবে এ আর নতুন কী কথা! হলও তাই। একমাস যেতে না যেতেই আবার ফিরে এল তুহিন।
এই একমাসে হিয়ার সঙ্গে বেশি করে সময় কাটাতেও ইচ্ছে করেনি তুহিনের। হিয়া মন খারাপ তো করেইছে, সেই সঙ্গে সন্দেহও। অঙ্ক না মিললে মন খারাপ তো হবেই।
গাড়ি থামার জায়গা থেকে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যেতে হয় বাড়ি পর্যন্ত। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দূর থেকে দেখতে পেল প্রকৃতি সব্জি বাগানে বাবার সঙ্গে হাত লাগিয়েছে। ঢিলেঢালা একটা জামা গায়ে, মাথায় একটা স্কার্ফ। খুব মন দিয়ে মাটি নিড়োনোর কাজ করছে মনে হল। তুহিন আর না এগিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’চোখ ভরে ওকেই দেখতে লাগল কেবল। কাছাকাছি আসতেই প্রকৃতির চোখ পড়ল তুহিনের ওপর। উঠে দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এল বাগান থেকে। চলে এল এক্কেবারে গেটের কাছে। তুহিনও জোরে হেঁটে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। অশ্বিনী এতক্ষণে খেয়াল করেছেন ব্যাপারটা। হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে স্বাগতম জানালেন নিজের বাড়িতে। তুহিনের হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে ওর জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা ঘরে নামিয়ে রেখে প্রকৃতিও চলে এল কিচেন গার্ডেনে। তুহিন খুরপিটা নিয়ে মাটিতে হাত লাগিয়ে দিল অশ্বিনীর সঙ্গে। প্রকৃতির মা চা করে নিয়ে এসে হাসি মুখে ভালোবাসা জানালেন তুহিনকে। লাঞ্চ রেডি হয়ে গেলে প্রকৃর মা ডাকলেন অশ্বিনীকে। তুহিন আর প্রকৃতি পাশাপাশি কাজ করতে করতে জমির এক কোণায় চলে গেছে ততক্ষণে। গুজুর গুজুর করে কত যে গল্প ওদের! সেই সঙ্গে হাসাহাসিও।
রাত্তিরটা আজকাল অনেক অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে প্রকৃতির উপস্থিতির কারণে। তুহিন ঠিক প্রেমে পড়েছে কিনা বুঝতে পারে না, কিন্তু প্রকৃতির প্রতি যে এতটা আকর্ষণ সেটা কি কেবলই ভালোলাগা? বুঝতে পারে না ঠিক। হিয়ার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা বাড়ির তরফেও পাকা হয়ে আছে। কাজেই সে নিয়ে ভাবনা নেই। কিন্তু প্রকৃতি যে এখানে আসবার আর একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাও বেশ বুঝতে পারে তুহিন। তবে হ্যাঁ, ইচ্ছে আছে হিয়াকে নিয়ে একবার এখানে এসে প্রকৃতির সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেবার। বড়ই মিষ্টি মেয়ে সে। কিন্তু সেটা করতে হলে যতটা সংযম, মনের জোর আর সাহস দরকার সেটা তুহিনের পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে কিনা সে ব্যাপারে নিজের ধারনাটাও পরিষ্কার নয়।
রাত্তিরের গল্প শুরু হল আবার। অশ্বিনী বসেছেন একটা বেঞ্চিতে। আর পাশেরটায় পাশাপশি তুহিন আর প্রকৃতি। “এক কমান্ডার, রাখাল সেজে ঘোরাফেরা করতে লাগল ডালিমটারের আশেপাশে। কোনও কোনও সৈনিকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে, সোনার মুকুট, সোনার মোহর এসব দিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের হাত করে নেয়। এরপর ১৭২৬ এর জানুয়ারি মাসের একটি দিনে এই বিশ্বাসঘাতক সৈনিকদের সাহায্যেই বোমা ঢুকিয়ে দেয় ব্রিটিশ। ভারসাম্যের অভাব থাকায় মাথার দিকের খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ে ঠিকই কিন্তু তবুও বাকিটা বেঁচে যায়। পুনো গ্যাবো আচক নিজেকে লুকিয়ে ফেলে বেঁচে যায়। পরাজয়ের গ্লানি দগ্ধে দগ্ধে পীড়ন করতে থাকে ইংরেজদের। তাই থেমে না থেকে ভুটানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবার ফন্দী আঁটল তারা। ভুটানের সে সময়কার রাজা বন্ধুত্বের বন্ধন রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে এক ভোজসভার আয়োজন করে। তাতে গ্যাবো আচকেরও নিমন্ত্রণ ছিল। ধামসাং-এর রাজা পুনো গ্যাবো আচকের পানীয়তে বিষ মিশিয়ে দেয় ওরা”। “বলছেন কী”? অবাক হয়ে যায় তুহিন। অশ্বিনী বলে চলেন, “অজ্ঞান হয়ে পড়ে গ্যাবো। সম্ভবত সেটাই তাঁর মৃত্যু, কিন্তু লোকমুখে কথিত কাহিনী এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। জ্ঞান ফিরলে ছয়জন লোক নাকি কাটতে আসে তাঁকে। কিন্তু তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ গ্যাবোকে বামফোকের সাহায্যেও নাকি মারতে পারেনি তারা। ভুটানিদের এক ধরনের তরোয়ালের মতো অস্ত্রের নাম বামফোক। অবশেষে এক তোতলা সৈনিক, যে কারণে তার নাম বকবকে ভোটে, গ্যাবোর শিরোচ্ছেদে সক্ষম হয়। মাথা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ে চেল নদীর এক গভীর কুয়োর মধ্যে। কিন্তু বাকি শরীর? সেটা তো রয়ে গেল! এর পাঁচদিন পর নাকি সেই মাথা এবং শরীর জোড়া লেগে এক হয়ে যাওয়ার দিন। অর্থাৎ গ্যাবোর পুনরুজ্জীবনের দিন। লোককাহিনী তাই বলে। ব্রিটিশেরা তাই শরীরকে টুকরো টুকরো করে এমনভাবে কেটে ফেলে যাতে আর শরীরের সঙ্গে মাথা জোড়া লেগে বেঁচে উঠতে না পারে রাজা। বলা হয় মাথাটা নাকি ওই শরীরকে না পেয়ে চিল হয়ে আকাশে উড়ে যায়”।
“পুনো মানে মহারাজা আর গ্যাবো আচক হল তাঁর নাম। এমন এমন আলৌকিক সব কাহিনী তাঁর সম্পর্কে শোনা যায় যে তাঁকে তাঁর এলাকায় ‘ভূত রাজা’ বলেও ডাকা হত, এমনকি এখনও ডাকা হয়”।
রাত্তির এখন প্রায় সাড়ে আটটা ন’টা হবে। চারিদিক নিস্তব্ধ। মাথার ওপর জ্যোৎস্না ভরা আকাশের মোহ।
তুহিন ডালিমটারের এই কাহিনী আর গা ছমছমে পরিবেশের প্রতি এক আশ্চর্য রকমের আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে। প্রথম প্রথম দুর্গ দেখতে অশ্বিনীর সঙ্গে একলাই যেত তুহিন। আজকাল প্রকৃতিও যায় ওদের সঙ্গে। রাজকন্যা মনে হয় ওকে। ইতিহাসের পাতা থেকে যেন উঠে আসে ওরা।
গত দু’বার অশ্বিনীর বাইকের পেছনে প্রকৃতিকে বসিয়ে নিয়ে কেবল ওরা দুজনেই চলে গেছে ডালিমটারের ভেতরে। প্রকৃতির মা আজকাল আর আপত্তি করেন না। যাবার সময় অশ্বিনী শুভেচ্ছা কামনা করে বলে দিয়েছেন, “সাবধানে যেও, আর বেশি দেরি করো না”। দুর্গের পাথরগুলোয় হাত দেয় তুহিন। প্রকৃতি তুহিনের হাতে হাত রাখে। চোখে চোখ রাখে একে অপরের। আচমকা জড়িয়ে ধ’রে বুকের মধ্যে যেন লুকিয়ে ফেলে প্রকৃতিকে। প্রেম বিনিময় হয়ে যায় নিজেদের শিথিল নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সরিয়ে নেয় প্রকৃতি। চোখ নামিয়ে নেয় নিচে। তুহিন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কী হল?” প্রকৃতি বলে, “কিছু না তো!” “তাহলে?” “আমার স্বামী হিসেবে কাউকে পেতে মানা আছে। কিন্তু আমি তোমাকে মন দিয়ে ফেলেছি। তাই ভয় করছে”। হঠাৎ এমন বেমক্কা একটা কথাতে তুহিন অবাক হয়ে গেল। বলল, “কেন? মানা কেন? কী বলতে চাইছ একটু খুলে বল।” “আমি যতবারই গ্যাবো আচকের ছবি এঁকেছি ততবারই রাত্তিরে স্বপ্ন দেখেছি আমাকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যেতাম। মা আমাকে এখানকার তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গিয়েছিল এমনটা কেন হচ্ছে শোনার জন্যে। তিনি বলেছেন, আমি যাকেই গ্যাবো আচকের ছবি এঁকে দেব তারই কোনো না কোনো ভালো হবে, কিন্তু আমি যদি তাদের কাউকে পুরোপুরি মন দিয়ে দিই, কিংবা তাদের মধ্যে কাউকে বিয়ে করব বলে ভাবি তাহলে চরম ক্ষতি হয়ে যাবে তার। আমার ওপর গ্যাবো আচকের আশীর্বাদ আছে। আমার মাধ্যমে তিনি নাকি অনেক মানুষের কল্যাণ করবেন এভাবেই”। “আর তোমার কল্যাণ? তার কী হবে?” তুহিন দৃঢ়তার সঙ্গে বলে। “জানি না। আমার মা-বাবার তাই আমাকে নিয়ে খুব মন খারাপ”। “আর তোমার? তোমার মন খারাপ নেই?” “ছিল না এদ্দিন। বুঝতেই পারিনি কেন মন খারাপ করব। ভেবেছি, এ আর এমন কী। কিন্তু তোমাকে পেয়ে এখন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। এবারে আমার কী হবে তা তো আমি নিজেও জানি না গো!” ভূত রাজার দেশের অলৌকিক কাহিনী আরও অলৌকিক হয়ে রয়ে গেল সেদিন থেকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴