ভালোবাসা, তোমায় দিলাম
ভালোবাসা, তোমায় দিলাম
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
~~~~~~~~~~~~~~~
নদীর বুক ভরে উঠেছে চাঁদের আলোয়। চরাচরের অনেকটাই স্পষ্ট তাতে। চারিদিকের অফুরন্ত সবুজ পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় অলৌকিক ছায়াময় এক রূপ নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে যেন। কিছুদূরের পাহাড়ি বস্তি থেকে মিঠে গানের সুর ভেসে আসছে। রাতজাগা পাখিটা ডেকে চলেছে থেকে থেকে......
শর্মিলা এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে, লক্ষ্যহীন ভাবে। ওর সামনের সবুজ বনানী ক্রমশ ঘন থেকে ঘনতর হয়ে উঠছে। ও খেই হারিয়ে ফেলেছে ঐ সবুজের মাঝে। তবুও, এগিয়ে চলেছে ও.. ওর মন খু্ঁজে চলেছে ওর ভালোবাসার সখীকে...যদি দেখা মেলে তার, এই পথ ধরে.... একটু আলোর আভাস.. একটা মুখ স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ.. শর্মিলার খুব কাছে সেই মুখ.. সেই মিষ্টি মেয়ের মুখ.. হাসিমাখা.. দু'গালের টোল দুটো ঝিলিক তুলছে সেই হাসিতে.. রিনরিন করে বেজে উঠেছে ওর মিষ্টি গলার স্বর.. 'আমার ভালোবাসা, তোমায় দিলাম '
অল্প অল্প আলো আঁধারিতে বিছানায় উঠে বসল শর্মিলা। সদ্য দেখা স্বপ্নের রেশ নিয়ে খোলা জানলায় বসন্তের ভোরবেলাকে অনুভব করবার চেষ্টা করল। ভোরের নরম আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে কৃষ্ণচূড়ার লাল। মনে পড়ল, আজ দোলখেলা.. রঙে রঙ মেলাবার দিন। প্রদীপ্তর অনুপস্থিতিকে প্রগাঢ় ভাবে উপলব্ধি করল। অফিসের একটা প্রোজেক্টের কাজে প্রদীপ্তদের একটা টিম সেই জায়গাটার কাছাকাছি একটা জায়গায় গেছে, যেখানে বিয়ের ঠিক পর পর প্রদীপ্তর সাথে শর্মিলাও গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। সেবারও অবশ্য অফিসের কাজ নিয়েই যাওয়া। প্রদীপ্তর বাড়ির লোকেরা সদাব্যস্ত প্রদীপ্তর সাথে শর্মিলাকেও জুড়ে দিয়েছিল একটু খোলা হাওয়া নিয়ে আসবার জন্য। ঐ ছোট্ট শহরের কাছাকাছি সবুজে ঘেরা নিরালা এক পাহাড়ি গ্রামের এক হোম- স্টে তে ওরা ঠাঁই নিয়েছিল। সেখানেই আলাপ হয়েছিল ঝর্ণার মতো উচ্ছ্বল, পাহাড়ি ফুলের মতো মিষ্টি পুষ্পার সাথে। ওর বাবা সেই হোম- স্টের বাবুর্চি। প্রদীপ্ত কাজের চাপে কোনো সময়ই দিতে পারেনি সেবার শর্মিলাকে। প্রায় সমবয়সী পুষ্পা শর্মিলাকে ভালোবেসে ওর সাথে নিজেকে জুড়ে নিয়েছিল বড় আপনার করে। ওকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল ঐ সবুজ প্রান্তরের প্রায় সবটুকু। ফাল্গুনী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাকে ভরসা করে সন্ধের পরও ওরা বেরিয়ে পড়ত হাতে হাত দিয়ে। বাড়ির বাইরে গিয়ে প্রদীপ্তকে না পাওয়ার কষ্ট শর্মিলার মুখে কালো ছায়া ফেলবার আগেই পুষ্পা ওকে নানান কথায় হাসিয়ে ..গানে, গল্পে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করত। পুষ্পা ও তার সঙ্গিনীদের সাথে সেবারের দোল খেলা শর্মিলা ভুলতে পারেনি আজও। পুষ্পার নিখাদ আন্তরিকতা আর নিষ্পাপ হাসিমাখা মুখ এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে ওর সাথে জড়িয়ে দিয়েছিল শর্মিলাকে। ওর উচ্ছ্বল হাসি এখনও কানে বাজে। ফিরে আসবার আগে জলভেজা চোখে পুষ্পা বলেছিল, 'আমার ভালোবাসা আমাকে ঠিক নিয়ে যাবে তোমার কাছে'....
এরপর কেটে গেছে আরও কিছু বছর। দৈনন্দিন ব্যস্ততার ভরা স্রোতে ভেসে গেছে জীবন। সমস্ত চাওয়া পাওয়া হাতের মুঠোয় থাকলেও মা হতে পারেনি শর্মিলা।
প্রদীপ্তর প্রোজেক্টের কাজে সেই একই জায়গায় গিয়ে এবার আবার দেখা পুষ্পার বাবার সাথে.. আর দেখা এক নতুন প্রাণের সাথে যাকে জন্ম দিতে গিয়ে পুষ্পা চলে গেছে চিরতরে। বিয়ের কথা দিয়ে যে শহুরে বাবু পুষ্পার শরীরে তার স্মৃতি রেখে চলে গিয়েছিল, সে আর ফিরে আসেনি। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত পুষ্পার বাবা মহিলাবিহীন সংসারে এই সদ্যজাতকে নিয়ে বড়োই বিড়ম্বনায় পড়েছেন। প্রদীপ্তকে দেখে ওনার চোখের জল আর বাঁধ মানছিলনা। প্রদীপ্ত হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছিল ছোট্টো ফুটফুটে শিশুটিকে.... তারপর অপেক্ষা কিছু সময়ের।
বাইরে রঙের উৎসব একটু একটু করে সাড়া জাগাচ্ছে। খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল শর্মিলা। দরজায় আওয়াজ হতে পর্দার এপারে প্রদীপ্তর হাসিমাখা মুখ দেখে ঘোর কাটল যেন। অবাক চোখে দেখল ওর কোলে সদ্যফোটা পদ্মের মতো একটি কচি প্রাণ। প্রদীপ্ত এগিয়ে এল শর্মিলার একেবারে কাছে। ওর হাতে তুলে দিতে উদ্যত হল পরম ভালোবাসার জনটিকে, পরম যত্নভরে, পরম আদরে।
শর্মিলার গাল বেয়ে জলের ধারা, মুখে হাসি। হাত বাড়িয়ে আগলে নিতে চাইল মিষ্টিমধুর নতুন অতিথিকে। ওর হাতের ছোট্ট মুঠো বন্দি করে নিতে চাইল নিজের হাতের মুঠোয়। ছোটো ছোটো আঙুলগুলো ওর আঙুলে জড়িয়ে গালে টোল ফেলে যে মধুর হাসি হেসে উঠল ছোট্ট মানুষটি, সে হাসি শর্মিলাকে ওর খুব ভালোবাসার একজনের মুখকে নতুন করে মনে করিয়ে দিল। দুহাতে ওকে আঁকড়ে কান্নাভেজা শর্মিলার ঠোঁট অস্ফুটে বলে উঠল 'তুই পারিজাত হয়ে এলি আমার ভালোবাসার গল্পে'..
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴