ভালোবাসা যারে কয়...
মিলি ভট্টাচাৰ্য
----------------------------
রাত পোহালো সবে, আঁধার মোছেনি তখনও স্বর্গ মর্ত্য জুড়ে... আলো ফুটি ফুটি সবে l
বৈকুণ্ঠধামে সুখনিদ্রায় আবিষ্ট স্বয়ং বিষ্ণু আর মাতা লক্ষ্মী। বাহন প্যাঁচার তখনও বন পরিক্রমা সারা হয়নি, সুবিশাল শ্বেত ডানা দুটো ঝাপটাতে ঝাপটাতে শেষ শিকারের সন্ধানে..
হু.. টু.. টু.. হু.. টু.. টু......উ.. উ..
রুদ্রাক্ষের বড় ডালে ময়ূর ঝিমাচ্ছিল, হঠাৎ খস খস আওয়াজে ভোরের হালকা ঘুমটা গেল ছিঁড়ে, চোখ পিট পিট করে দেখে.... আরে, এত আমাদের হ্যান্ডসাম লক্ষ্মীপ্যাঁচা.. ওর সাথে ও কে.. হুতোম প্যাঁচা!
চড়াক করে চোখ খুলে গেল...
শ্বেত ডানার সাথে ধূসর ডানার আলিঙ্গন!
ব্যাপারটা কী?
প্যাঁচা সমাজের কুলীন শ্রেষ্ঠ নব যুবক এই লক্ষ্মী প্যাঁচা, তার সাথে ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে এই পিঙ্গল বর্ণা হুতুম!
না, ব্যাপারটা স্বর্গে জানাতে হচ্ছে!
লক্ষ্মী প্যাঁচাকে বলতেই, খেল এক ধমক।
"তোর এত নজরদারি কিসের রে ময়ূর?
ভোর হতে না হতেই ঘাড় উঁচু করে পাহারায়, আমি রাতে কার সাথে ঘুরি, কার সাথে খাই, গপ্পো করি... It's none of your business.. বুঝলি?"
"হুমম, বেশি ডানা ঝাপটাস না, একটু বেশিই উড়ছিস ইদানিং ওই খোঁড়া পায়ে...
তা, তোর সমাজের ফর্সা সুন্দরী চাঁদমুখো বান্ধবীরা জানে তো ব্যাপারটা?"
গর্বিত ভঙ্গিতে ঘাড় উঁচু করে, সুদৃশ্য বিশাল লেজ অর্ধ বিস্তার করে দেমাকি ময়ূর চলে গেল।
প্যাঁচা পড়ল মহা ফাঁপরে, কোনো মতে হুতুম প্যাঁচানিকে অলবিদা জানিয়ে সাদা ডানা দুটো মেলে বৈকুণ্ঠধামের দিকে উড়ে গেল l
ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে, কে জানতো? প্যাঁচাদের সমাজে ঝড় উঠল, নিন্দার ঝড়, সমালোচনার ঝড়! সুদর্শন শ্বেত ধবল প্যাঁচার সাথে পিঙ্গলবর্ণা হুতুম প্যাঁচানির প্রেম! স্বর্গের বনে বাদাড়ে সন্ধ্যা রাতে, গভীর রাতে নিকষ কালো অমাবস্যায়, রূপোলি জোছনা রাতে, গাছের 'পরে, ঝোপের ধারে দুজনের রোম্যান্স... বাতাসে গুঞ্জন!
প্যাঁচা ভেবে পায় না, এত বিরোধ কিসের? এত বর্ণ বিদ্বেষ বা কিসের?
হুতুমের কণ্ঠস্বরে মোহিত প্যাঁচা, হুতুমের ধূসর ডানার উষ্ণ আলিঙ্গনে প্রাণ পায় প্যাঁচা...
এমন করে ভালোবাসার কথা কেউ তো বলে না। "হুতুম, আমার প্রাণ প্ৰিয় হুতুম, এমন করে নিজের প্রাণ বাজি রেখে......"
লক্ষ্মী প্যাঁচার মানস পটে ভেসে ওঠে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
বনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ওই শিরিষ গাছের ডালে গুছিয়ে বসেছে প্যাঁচা... ফোঁস ফোঁস আওয়াজে হঠাৎ চমকে দেখে.. বিশাল এক ময়াল হাঁ করে ওকে গিলতে আসছে...
বুকের ধুকপুকানি বন্ধ হয়ে আসে, নিশ্চিত মৃত্যু!
নিমেষের মধ্যে হুতুম এসে সর্বশক্তি নিয়ে ওর ধারালো ঠোঁট দিয়ে বারবার আঘাত করতে থাকে ময়াল এর মুখে, চোখে...
ময়াল অতিষ্ট হয়ে হাঁ মুখ বন্ধ করে শিকারের আশা ছেড়ে নেমে যায় ওই ডাল থেকে।
লক্ষ্মী প্যাঁচা সম্বিৎ ফিরে পায়। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল আসে ওর। কৃতজ্ঞতা থেকেই কী এই প্রেমের জন্ম? প্যাঁচা ভাবে, হোক না ওর পালক ধূসর, মনটা যে ওর বড্ডো সাদা। নাহলে, একটু খুঁড়িয়ে চলা লক্ষ্মী প্যাঁচাকে তার সমাজের গর্বিত সুন্দরীরা একটু করুণার চোখেই দেখে, কিন্তু, এই পিঙ্গল বর্ণার দুচোখ ভরে শুধুই সম্ভ্রম, শুধুই ভালোবাসা!
মনস্থির করে ফেলল প্যাঁচা, "না, আজই লক্ষ্মী ঠাকুরণকে জানাতে হবে সবিস্তারে... মা নিশ্চয়ই সুবিচার করবেন।"
সন্ধ্যারাগ ঘনিয়ে এল, আকাশে বসল তারাদের মেলা, লক্ষ্মী প্যাঁচা ওর শ্বেত ধবল ডানা দুটো বিস্তার করল ভালোবাসায় উদীপ্ত হয়ে, উড়ে চলল বৈকুণ্ঠধামে. সুবিচারের আশায় .. যেখানে বিষ্ণু নারায়ণ এর কাছে শাশ্বত প্রেমের পাঠ নিচ্ছে স্বয়ং মা লক্ষ্মী ঠাকুরণ মৃদু মন্দ শারদ বাতাবরণে।