ভাঙন
গৌতম চক্রবর্তী
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
আকাশ
কালো করে বৃষ্টি নেমেছে। একফোঁটা বিশ্রাম পায়নি শরীরটা। খাওয়া দাওয়া সেরে
নিজের অগোছালো কোয়ার্টারের অগোছালো বিছানাতে শরীর এলিয়ে দিয়ে নিজের জন্য
অবশেষে সময় বের করতে পারল মানব। ক্লান্ত শরীরে ঘুমাতে চেষ্টা করল। কিন্তু
ঘুম এলো না চোখে। অথচ এরকম তো হবার নয়। আজ তো তার আনন্দের দিন। নিজের হোম
ব্লকে তার পোস্টিং। সে আজ ব্লকের দণ্ডমন্ডের কর্তা। খোদ মুখ্যমন্ত্রী তার
প্রতি ভরসা রেখে তাকেই এই ব্লকের দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই ব্লক, যে ব্লকের
অখ্যাত এক গ্রাম থেকে তাকে একদিন কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে হয়েছিল, আজ সেই
ব্লকের তিনিi সর্বেসর্বা! কি বিচিত্র বিধির বিধান।
বাইরে
মাঝেমাঝেই সশব্দ বজ্রপাত। জানলার কাঁচের সার্শীগুলোতে বৃষ্টির ছাঁট।
বৃষ্টির রাত যেন বিভীষিকা তার কাছে। আজ সকালেই ব্লকে বিডিও হিসাবে কাজে
যোগদান করল সে। নেমপ্লেটে লেখা মানব মন্ডল, বিডিও ধূপগুড়ি। ট্রেনিং শেষ
হবার পরে কিছুদিন মূর্শিদাবাদ, তারপরেই তার নিজের খাসতালুক ধূপগুড়িতে
পোস্টিং দিয়ে পাঠিয়েছে সরকার। ধূপগুড়ি বানারহাটকে ঘিরে অনেক কৃষিভিত্তিক
এবং কর্মসংস্থানমুখী উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। সেগুলি হাতেকলমে সম্পাদন
করার জন্যই তাকে এখানে পাঠানো।
এখনো ছবির মত চোখের
সামনে ভাসে দৃশ্যকল্পগুলো। গাড়ি থেকে নামলেন বিডিও সাহেব মানব মন্ডল। একবার
চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন ব্লক অফিসের আশপাশ। সকলের সঙ্গে নমস্কার করে
সৌজন্য বিনিময় করলেন। তারপর সোজা নিজের চেম্বারে। প্রথাগত কাজ সারতে সারতে
দুপুর গড়ালো। একে একে পরিচয় হলো সকলের সাথে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল
গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধে ঘনিয়ে রাত।
সশব্দে বাজ পড়ার
শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল। পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লে দুই চোখের পাতা এক
করতে পারে না মানব। বিশেষত এইরকম বৃষ্টির রাতে নদীর পাড় ভাঙার শব্দ সে যেন
এখনো শুনতে পায়। সে ঘটনাও তো প্রায় পঁচিশ বছর হতে চলল। ঘুম আসে না চোখে।
পঁচিশ বছর আগেকার হারানো শৈশব যেন ফিরে ফিরে দেখতে পাচ্ছে মানব। গত সাতদিন
ধরে আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি হচ্ছিল। গ্রামের ওই ছোট নদীটার ঐরকম রূপ সে কোনদিন
দেখেনি। বাপের মুখের দিকে চেয়ে সে সেই শিশু বয়সেও অনাগত বিপদের আশঙ্কা
করেছিল। বুঝতে পেরেছিল আকাশের গতিক সুবিধার নয়। নদীতে প্রায় প্রতিবছর বান
আসত। দু চারদিনের জন্য তারা চলে যেত রাস্তার ধারের রেলের জমিতে। কিন্তু সেই
রাতের কথা কোনদিন ভোলা যায় না। মানব তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘কেলাস
থিরি’। বিশাল শব্দে কাছেই যেন বজ্রপাত হল। চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল
মানবের।
আবার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সেই দিনকার
খন্ডচিত্র। রাত তখন অনেক। মানব তখন গভীর ঘুমে অচেতন। বাবার ঝাঁকুনি আর
মানুষজনের চিৎকারে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। তারপর বাপ-ব্যাটায় এক
দৌড়ে ভিটের বাইরে। তারপর শুধু ঘুম-চোখে তাকিয়ে দেখা তাদের ভিটেমাটি,
তুলসী মঞ্চ, সবজির বাগান, গোয়াল ঘর, গাই-বলদ সবকিছু ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল
নদীর ভাঙ্গনে। সে কি বুক ফাটা আর্তনাদ মানুষের। শুধু কি তাদের ঘর? আরও
অন্তত পনেরোটা গেরস্ত ঘর, গরু-বাছুর, হাল-বলদ সমেত তলিয়ে গেল। সবাই তারা
উঠে এল বাঁধের উঁচু জমিতে। সার-সার ঝুপড়ির একটাতে তাদের ঠিকানা। সেই থেকে
বাপ জন মজুর। অন্যের জমিতে কাজ। ঝুপড়িতে বাস৷ আবার কখনও বা মাটি কাটার
কাজ। সরকারি লেবার। আর দুই বছর পরেই মা মরা ছেলেটাকে বাপ পাঠিয়ে দিল
ধুপগুড়ির নাথুয়া আশ্রম টাইপ হাইস্কুলের বোর্ডিং-এ।
সেই
যে যেবার বান এলো, নদী ভাঙনে তলিয়ে গেল তাদের বাড়িঘর তারপর ওর বাপ চলে
এসেছিল ধূপগুড়ির কাছে। সেটেলমেন্টের বাবুদের কেরামতিতে ক্ষমতাশালী লোকদের
নামে রেকর্ড হওয়া ডাঙা জমির কিছুটা জমি দালাল ধরে বর্গা পেয়েছিল তার বাপ
সরকারের বদান্যতার নামে। জমানো বেশ কিছু টাকা চলে গিয়েছিল বাবার। সেটাই ছিল
সম্ভবত শেষ সম্বল। দালাল বলেছিল কয়েকদিনে কাগজ পেয়ে যাবে। কিন্তু কোন কাগজ
পায় নি। বাড়ি যখন আসতো মানব দেখত বাপের ঘামে ভেজা শরীর আর হাসিমুখ।
উদয়াস্ত পরিশ্রম করত তার বাপ।
সে যখন ক্লাশ টেনে তখন
একবার ভুল করে বলেছিল লেখাপড়া ছেড়ে সে বাপের সঙ্গে কামকাজে লেগে যাবে। বাবা
তাকে লাঠি নিয়ে মারতে এসেছিল। বলেছিল তার মতো দিনমজুর নয়, লেখাপড়া শিখে
তাকে এত বড়ো হতে হবে যেন তার মতো অভাবী মানুষের জন্য সে কিছু করতে পারে।
সবুজ ধানের ক্ষেত। যেদিকে তাকাতো মানব চোখ জুড়িয়ে যেত। তারপর কার্তিকে
সোনালি রঙ ধরত তাতে। পাকা ধানের গন্ধ। সে ধানের গন্ধ আর বাবার হাসিমুখ এখনও
স্মৃতিপটে সজীব মানবের। তাদের গ্রামের আফতাব মাস্টার দুঃখ করে বলত তার
বাবাকে নদীর ভাঙন তোর জীবনটাই তছনছ করে দিল রে হৃদয়।এইভাবে চলল দিন। মানব
আরেকটু বড় হল। মানবের সেবার উচ্চ মাধ্যমিক। ধূপগুড়ি হাইস্কুলের ইংরেজীর
মাস্টার অমিতবাবু তার বাবাকে ডেকে বলেছিল, "তোর ছেলের যা মাথা, তাতে ওর
স্টার পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।" উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করে
কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে সুযোগ পেয়েছিল মানব। ভর্তি হয়েছিল ইংরেজী অনার্স
নিয়ে অমিতবাবুর কথা মতো। স্বপ্ন ছিল অমিতবাবুর মতো ছাত্রদরদী মাস্টার হবে।
সেবারে
কলেজে ভর্তি হয়ে পুজোর ছুটিতে বাড়িতে এল মানব। কার্তিক মাসের শেষ। মাঠের
কাজ তখন অনেকটা কম। বলতে গেলে নিড়েন দেওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না।
আমনের ক্ষেতে সোনালি আভা। দেখলে বুক জুড়িয়ে যায়। মাঠ থেকে নিড়েন দিয়ে
ফিরেছে বাপ খানিক আগে। তারপর চাট্টি ডাল-ভাত খেয়ে, দাওয়ার খুঁটিতে পিঠ
ঠেকিয়ে রোদে বসেছিল। একটু ঝিমুনি মত এসেছিল যেন। ঠিক সেই সময় বিলাসুর
ভটভটির আওয়াজটা তার দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। "তোমারে ডাকিসে কাকা
অঞ্চলে৷ কাল দুপুরে একবার আসা নাগিবে। পরধান কয়ে দিল।" বিলাসু অঞ্চল আপিসের
পিওন। বেশিদিন চাকরি নয়। ইদানীং মোটরবাইক কিনেছে। শোনা যায় হাতে বেশ
টু-পাইস আসছে এখন। হৃদয়ের মনে কু ডাকে। একটা খটকা যেন আশঙ্কার মেঘের মত জমা
হতে থাকে। ইদানীং যাদের বর্গা জমি ছিল, ছল চাতুরী করে তাদের জমি উন্নয়নের
নামে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে শুনেছিল হৃদয়। অকারণেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে
হৃদয়ের। মানবও বুঝতে পেরেছিল আবার অমানিসার অন্ধকার আসতে চলেছে তাদের
জীবনে।
সেই প্রথম মানবের চোখে জল দেখেছিল
মাস্টারমশাই। তারপর জিগ্যেস করেছিলেন, "কিরে কাঁদিস কেন?" সব কিছু খুলে
বলেছিল মানব। বাবার শরীর আর মনের অসহ্য যন্ত্রণা কেমন করে সে টের পাচ্ছে,
দিশাহীন বাবার অসহায় অবস্থা। মাস্টারমশাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তার।
তারপর তাকে সঙ্গে করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বাবাকে বলেছিল, "এখানে আর থাকিস
না। এখানে কী-ই বা আর আছে তোর? কাল সকালে আমার কাছে আসিস। আমার কলেজের
বন্ধু ভবেশ মুখুয্যেকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। কিছু একটা হিল্লে হয়ে যাবে তোদের
বাপ-ব্যাটার। ওদের অনেক জমিজমা, দেখভালের লোকজন তেমন নেই। তোদের পেলে
বর্তে যাবে। আর হ্যাঁ, পারলে ছেলেটার লেখাপড়ার যেন ক্ষতি না হয় দেখবি। ওর
পড়াশোনার জন্য আমিও নিয়মিত টাকা পাঠাবো।"
জমির আপিসের
আমিন ছোটকুকে চিনতে পারল বিজন। বাকি লোকদের একজনকে খুব চেনা-চেনা লাগল।
শুনলো প্রধান আলতাডাঙ্গার কাছে এক গ্রামের স্কুলের হেড মাস্টার। এখন পাটির
নির্দেশে ছুটি নিয়ে প্রধানগিরি করছেন। মনে পড়ে মানবের বাবাকে ঢুকতে দেখে
প্রধানসাহেব কোন ভনিতা না করে পাশে বসা এক ভদ্রলোককে সমর সম্বোধন করে তাকে
প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে বললেন। খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে সমর জানায় হৃদয় যে
চার বিঘে জমি লিজে চাষ করে সেটা সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দিতে হবে।
"লিজ!"
মাথায় প্রায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে হৃদয়ের, "লিজ তো নয়, সরকার তো আমার নামে
বর্গা করে দিয়েছিল ওই জমি। তখন সেখানে আবাদি হত না। বন্যার পর ভিটেমাটি
হারানোর পর সরকারি ব্যাবস্থাতে ওই জমি পেয়েছিলাম"
"লিজ নয়? জমির রেকর্ড কি বলছে হে ছোটকু?" সমরবাবু এবার প্রশ্নটা করে আমিনকে।
"পরচা
তো বলছে আশারু বর্মণের নামে রায়তি জমি৷ বর্গাদার তো কেউ নেই। হৃদয় কাকার
নাম কোথাও রেকর্ডে নেই।" ছোটকু কী একটা কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে
কথাগুলি।
মানব কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল। তাকে
থামিয়ে দিয়ে “তুই চুপ কর," বলে ছেলেকে কর্কশ ধমক লাগিয়েছিল হৃদয়। তারপর
গলাটা খানিক নামিয়ে মোলায়েম করে বলে, "আসলে আমি তো জানি ওটা বর্গা জমি!"
"মানুষ চলে যায় হৃদয়কাকা। রেকর্ড থেকে যায়। তোমার কাছে যদি কোনও কাগজ থাকে দেখাও। না থাকলে ছোটকু যা বলছে সে তো শুনলেই"
"আসলে
কী হয়েছে জানেন হৃদয়বাবু, ওই চার বিঘের মধ্যে দু'বিঘে মজা নদীর খাত। আর
বাকিটা রায়তি জমি। এবার কথাগুলি বলেন প্রধান সাহেব, "সরকার প্রকল্প নিয়েছে
খাল আবার নতুন করে কাটবে, তাতে করে ওই জমি তো……" তাছাড়া বাকি দু'বিঘে
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে দিয়ে দেন। আমাদের পার্টির সরকার। ব্যাবস্থা করে
দেব, কম্পেনসেশন পাবেন। মানুষের কাজে লাগবে জমিটা। আর তা ছাড়া আপনাদের
ভিটেটাও তো আমাদেরই জমি। সেটা তো আমি ফেরত চাইছি না এখনি।"
"তার
মানে? আমি খাবো কী? আমার খোরাক তো ওই জমি থেকে।" অসহায়ের মত কান্নায়
ভেঙে পড়েছিল হৃদয়। কেউ কোনও উত্তর দেয় না তার কথার৷ ধীরে ধীরে হৃদয় আর
মানব বেরিয়ে এসেছিল অঞ্চল আপিস থেকে।
সেদিন ছিল
গাঁয়ে নবান্ন উৎসব। বারো মাসের তেরো পার্বণ। শুধু হৃদয়ের ঘরেই টিমটিম করে
একটা হলুদ লাইট জ্বলছিল। সেই শেষ বিকেলে মধু ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিয়েছিল
জমিতে কারা যেন নেমেছে। ধান সব কেটে নিল। উদভ্রান্তের মতো গামছাটা কাঁধে
নিয়ে বেরিয়ে যায় হৃদয়। সূর্য ততক্ষণে অস্তে গেছে। অঘ্রানের সন্ধ্যা ঝুপ
করে নেমে এসেছে তখন।
হৃদয় আর বাড়ি ফেরেনি। পুলিশের
খাতায় সে নিখোঁজ। মানব বেশ কবার গিয়েছিল থানায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিল।
প্রতিবারই শুনে এসেছে তদন্ত চলছে। আসলে সেই তো রেকর্ড কথা বলে মানুষ নয়।
এবার তো থানা থেকে পুরনো সেই রেকর্ড খুঁজে বের করবে ধূপগুড়ির বিডিও সাহেব
মানব মন্ডল, প্রয়াত নিরুদ্দিষ্ট হৃদয় মন্ডলের ছেলে। দেখাই যাক না রেকর্ড
কথা বলে, না মানুষ। বিনিদ্র রাত কেটে যায় মানবের। চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়।
পূব আকাশ লাল হচ্ছে। আগামীকাল থেকে শুরু হবে প্রশাসক বিডিও সাহেবের নতুন
সকাল।