বুকের ভেতর ঝনকে ওঠে
বুকের ভেতর ঝনকে ওঠে
শৌভিক কুন্ডা
----------------------------------
"মাঝেমাঝেই বুকের ভেতর ঝনকে ওঠে
এখন, এই পড়ন্ত বেলায়
মন বসে না কোন কাজে, কোন খেলায়"....
বড় প্রিয় কবিতা আমার। না, সদ্য হয়ে ওঠে নি, অর্থাৎ বেলা ঢলতে শুরু হওয়ার উপলব্ধি নয় এটা। নিতান্ত কাঁচা বয়স থেকেই বরং। যখন পড়ি (না কি শুনি,) প্রথম। গোটা কবিতার মর্মার্থ বুঝে নেওয়ার বয়স নয় সেটা। কেবল, ওপরের তিনটে লাইন অবুঝ হয়ে গেঁথে গেছিল মনের ভেতর। কিন্তু ঐ অকারণ ঝনকে ওঠা, বুকের ভেতর, সে আরো আগের থেকেই। যখন আমি একলা একা ঘুরে বেড়ানো অপু, কঞ্চির তীরধনুক নিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ডাহুক শিকারের চেষ্টা করে চলি, অমল হয়ে বসে থাকি খোলা জানালায়, সেই তখন থেকেই তো! নাহ্। আরো আগে, সেই যখন
এ পারেতে বিষ্টি এলো ঝাপসা গাছপালা
ও পারেতে মেঘের মাথায় লক্ষ মানিক জ্বালা....
কে কঙ্কাবতী? কী তার অভিমান, ব্যথা, কিছুই জানতাম না। এখনো কি জানি? না।
জেলাস্কুলের নীচুক্লাসে, সাতদশকের মাঝ অর্দ্ধে, বিরাট জানালার দু হাত দূরেই পাঁচিল। পাঁচিল ঘেঁষেই বাঁধ, তিস্তার। অনেক খাঁ খাঁ দুপুরে, বাংলা কবিতা পড়াতে পড়াতে, পীযূষ বাবু স্যর যেন ভুলেই যেতেন হঠাৎ হঠাৎ, যে তিনি ক্লাসরুমে আছেন! বাঁধ ধরে একটা গোরুর গাড়ি চলে যাচ্ছে, ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ। ছোটকা আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, "আষাঢ়ুর মাঠ!" হাসি পায় না আমার। শুনসান দুপুরটা যেন ঝনকাতে থাকে বুকের ভেতর। কি জানি, হয়তো স্যরেরও তাই!
ঐ সময়ের পরপরই চলে গেল বুকু। ক-য়ে হ্রস্ব উ কা...কু...লি দাস। সাধারণ পরিচয়ে আমাদের দোতলার ভাড়াটে। বস্তুত আমার সহপাঠিনী, ছাত্রী, পুতুলখেলার বৌ, জেমস বন্ডের সহচরী, ক্যারম খেলার পার্টনার। বুকুরা বদলি হয়ে গেলে পর, দোতলার রেলিং টপকানো প্যারাপেটে বসে, বহু বহু দিন, নারকেল পাতার ফাঁক গলে সূর্যের নিভে যাওয়া দেখতে দেখতে, আবারও মাঝেমাঝেই ঐ ঝনক।
বড় হচ্ছি আমি। বড় হচ্ছি। ১৯৮০। মাধ্যমিক। দেখা হল। হ্যাঁ, শুধু দেখাটুকুই। দেখে মুখ চেনা হল। এক শীর্ণ কিশোরের ঐ চেয়ে থাকাটুকুর, বৈকালিক সাইকেল চক্করে এক ঝলক দেখতে চাওয়া টুকুর, কী নাম? অথচ, নামহীন, সম্পর্কহীন, অপেক্ষাটিও যখন চলে গেল জলপাইগুড়ি ছেড়ে, না প্রভু, তখনো আমি নষ্ট হয়ে যাইনি! কেবল দুপুরে কি সন্ধেয়, আলোতে বা আবছায়ায়, কপালে একটা কাটা দাগের ছবি কেন যে বুকের ভেতর ঝনকে উঠত! সত্যিই মন বসত না কোন কাজে, কোন খেলায়!
তারপর কলেজ। প্রেম এল। সকলের জানার মাঝে। নৈমিত্তিক দেখা, কথা, কবিতা, খুনসুটি। দু'বছর পর আমার যাদবপুর যাত্রা। মেইন হোস্টেল এ ব্লকে দু মাসের মধ্যেই খবর এল, সে প্রেমিকা আর আমার নেই। বেছে নিয়েছে অন্য কোন প্রহর। ভেঙে পড়লাম, পুড়ে গেলাম, কিন্তু আশ্চর্য, ঝনকে ওঠা সে ব্যথাকে ফিরে পেলাম না। মফস্বলের রাখাল দক্ষিণ কলকাতার ফ্যাশনদুরস্ত চত্বরে একা, বাইরে একা, ভেতরেও, খাতা ভরাতাম কাঁচা কবিতার অলচিকিতে!
মাইগ্রেট করে ফিরে আসি জলশহরে। সেই শহরে, যেখানে ছিঁড়ে যাওয়া কাটি পতঙ্গটি ওড়ে তখনো। ফিরে আসতে চায়। আসে। যেন ভুল বোঝাবুঝি শুধু। যেন মাঝের অপমানটুকু কিছু নয়! ভাঙা আয়না তো শুধু প্রেতচ্ছবিই দেখাতে জানে। তাই আবারও উড়ে যায় রানঅ্যাওয়ে কাইট!
অবশেষে কঙ্কাবতী। কলেজের শেষদিকে। তখনও জানি না কেন কঙ্কাবতী, কি তার ব্যথা, অভিমান। নীল প্যাডে সাজানো অক্ষরেরা তার কাছে যায় ভেসে যায়। অল্পদিনের জন্যও যখন সে যায় কলকাতায়, নাচের তালিম নিতে, জলশহরে থেমে যায় সব বোল বাণী। রোদেলা দুপুরেও পরিষ্কার আকাশ থেকে তিস্তার বুকে নেমে আসে দু'এক ফোঁটা জল। জলের বুকে জলের ফোঁটা বৃত্ত আঁকে, মিলিয়ে যায়। একটা গোটা আকাশ বুকের ভেতর থেকে উড়ে চলে যায় ডানা ঝাপটে, শুধু রেখে যায় ঐ ঝনকার।
য়্যুনিভার্সিটি। এবার নর্থবেঙ্গল। "য়ে কাঁহা আ গ্যয়ে হাম ইঁউ হি সাথ চলতে চলতে......!" কঙ্কাবতীও টের পায়। নাচ করে কঙ্কাবতী। কখনো
"শাওনের গগনের গা'য়
বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়, ক্ষণে ক্ষণে
শর্বরী শিহরিয়া উঠে হায়.........."
আবার কখনো,
"মোতি বনকে টপকে পানি
ভিগত যায়ে গাগরিয়া........."
রাত বাড়লে হোস্টেলের একচিলতে ঘরের অন্ধকারে চমক তোলে থিরবিজুরী, ছমছম বেজে ওঠে পায়েলিয়া। দূরে, কার্শিয়াঙের আলোর নেকনেস একটু একটু করে নিভতে থাকে। ফিরে আসে ঝনকে ওঠা সেই বিষণ্ণতা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴