সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

বিকল্প

বিকল্প 
শ্বেতা ভট্টাচার্য্য
^^^^^^^^^^^^^^

ভোরের সূর্য যখন মিঠে আলো ছড়াতে শুরু করে দো'তলার বারান্দায় বসে ভোরের পৃথিবীকে দেখি।চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠে।হাতের সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়।উত্তর আর পুবের নারকেল, সুপারি,  ঝাউপাতাগুলো তিরতির করে কাঁপে।আম,পেয়ারা,
জামের পাতাতেও দেখি থরথর কাঁপন।শিশির-ধোয়া চাতালে সূর্যের আলো তেরচাভাবে পড়ে।ভোরের বাতাসে সেই আলোও কাঁপতে থাকে মৃদু মৃদু।শিশিরবিন্দুগুলো ঝলমল করে স্পন্দিত,নরম আলোয়।সেগুলো তখন আর জলকণা থাকে না, রঙবেরঙের মুক্তোদানা হয়ে যায়।বাচ্চাটি শিশিরজলে পা ভিজিয়ে চোখেমুখে ঠাণ্ডাবাতাস মাখে।আগে তো ওকে কখনও দেখি নি!
 এ পাড়ায় বুঝি নতুন এসেছে!পুজোর ক'টা দিন পৈতৃকবাড়িতে ছিলাম।ফিরে আসার পর থেকেই  ওকে দেখছি।
 ঝুল বারান্দার ঠিক নীচেই মস্ত গ্যারেজ। গ্যারেজের সামনে ভারী লোহার কুচকুচে কালো গেট।সিমেন্ট বাঁধানো লাল টুকটুকে চাতালটা গেটের বাইরেও অনেকটা প্রসারিত।গেটের এপাশে বেশ কিছু ফুলের সম্ভার...শিউলি,টগর, বাগানবিলাস আর স্থলপদ্ম।শিউলি গাছটায় বারোমাস অল্পবিস্তর ফুল ফোটে।তবে আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে শীতের শুরু পর্যন্ত  ফুলের পশরা সাজায় সে। 
বাচ্চা ছেলেটি সারা সকাল ওই চাতালটার ওপর বসে বসে ছোট্ট পৃথিবীটা জরিপ করে।কখনও কখনও দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, ছায়া ক্রমশ লম্বা হয়ে নেতিয়ে পড়ে।ছেলেটি ঠায় বসে থাকে আর নিজের মনে বিড়বিড় করে।কত আর বয়স হবে ছয় কিংবা সাত!অবাক দৃষ্টি মেলে কংক্রিটের শহরটাকে অবলোকন করেই যায়।তবু যেন ওর কৌতূহল মেটে না।বাড়ির কোণের  ঝাপড়া শিউলিগাছটা চাতালটাকে  ফুলে ফুলে ঢেকে রাখে।পদ্ম আর বাগানবিলাসের পাপড়িরা ঝরে ঝরে পড়ে।শিশির-ধোয়া পাথরের চাতালে চোখ পড়লেই ওর বুকের ভেতর নাম না জানা অনুভূতিরা বুঝি বুজকুড়ি কাটে।শুধুই কি দৃষ্টিসুখ?তা তো  নয়! নয়ন ভেদ করে তার মরমেও নিশ্চিত প্রবেশ করে সে রূপ।প্রাণ শুধু আকুলই করে না,হৃদয় মন্থন করে অমৃত তুলে আনে ওর কচি প্রাণে। নরম মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠে সেই অমৃত আস্বাদনের অপার আনন্দ।কমলা বোঁটার সাদা পাপড়িগুলো ছড়িয়ে থাকে  রোয়াকে।শতছিন্ন, বোতামখোলা জামাটার এককোণে জড়ো করে সেই ফুল আর পাপড়িগুলো।আর থেকে থেকে শ্বাস টানে,বেশ জোরে জোরে।এ যে গরীবের ঘোড়ারোগ! 
শেষ আশ্বিনের স্নিগ্ধ বাতাসে বুড়ির সুতোরা ওড়ে।শান্ত হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে সে,দৌড়ঝাঁপ করে মুঠোয় ভরে না।শুধু অলসভাবে চেয়ে থাকে।

যাওয়া-আসার পথে মাঝেমাঝে শুনতে পাই...
কত্ত গাড়ি,কত্ত লোক!যায় আর আসে...কোথায় যায়,কেন যায়... কে জানে!
অবাক হই ওর কথা শুনে।ওর মা শুনেছি বাড়ি বাড়ি
বাসন মাজে,কাপড় কাচে।বাবাকে কখনও দেখি নি।শুধু দেখেছি ভোরে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কমবয়সী একটি মেয়ে  চাতালটার ওপর ওকে বসিয়ে রেখে  যায়।আমার বাড়িটা মূলরাস্তা থেকে একটু ভেতরেই।তিনটে গলি এসে মিশেছে বাড়ির সামনে।ইংরেজি T অক্ষরের মতো। টি-এর ডাঁটিটা সামনে যতদূর চোখ যায় সোজা চলে গেছে।বাঁদিকে কানাগলি, ডানদিকের রাস্তা এঁকেবেঁকে বহুদূর বিস্তৃত।কানাগলিরই কোনো এক বাড়ির একচিলতে ঘর মা আর ছেলে ভাড়া নিয়ে থাকে।আমার বাড়ির সামনের জায়গাটা প্রশস্ত আর সুরক্ষিত।মা তাই এখানেই ওকে বসিয়ে রেখে যায়।ছেলেটিও ক্যাসাব্লাঙ্কার মতো মায়ের প্রতিটি বাক্য মান্য করে চলে।
  
 ঠিকে ঝি মালার কাছ থেকেই এসব খবর আমার শোনা।
...তোর নাম কী রে?
...আয়াজ।
...বাহ্!
শীতের বাতাসই বটে।চোখ দু'টো কীইইইই সুন্দর! রিনরিনে, মিষ্টি গলার স্বর শ্রবণযন্ত্র জুড়িয়ে দেয়।
...স্কুলে পড়িস?
...পড়তাম তো!শীত এলে মা আবার এখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেবে।
...আচ্ছা!
...তুমি আজ স্কুলে যাবে না?
...না রে!আজ আমার ছুটি।কিছু খেয়েছিস?
...না!মা কাজ সেরে ফিরে রান্না করবে।আমি আর মা দু'জনে মিলে খাব।
...তোর মা ফিরতে ফিরতে তো বিকেল গড়িয়ে যাবে!
... আমার খিদে পায় না।
...তোর বাবা কোথায় থাকে?
আয়াজ বোধহয় "বাবা "শব্দটি কখনও শোনেই নি।অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে।আর কথা বাড়াই না।

মাঝেমাঝে বড়ো বিরক্তির উদ্রেক করে ওর উপস্থিতি।গাড়ি বের করা বা ঢোকানোর সময় বারবার আনমনা ছেলেটিকে তাড়া দিতে হয়।আমার চোখেমুখে সে অসন্তোষ প্রকাশও পায়।ছেলেটি দৌড়ে এসে দরজা খুলে অথবা বন্ধ করে দেয়।
...তুমি নিশ্চিন্তে যাও,আমি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি।
ঝরঝর করে হেসে ফেলি।

সেদিন উত্তরের ঘরে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছি,শুনছি আয়াজ কাকে যেন বলছে...
...ডানদিকে সাদা বোতামটা রয়েছে।চাপ দাও,চাপ দাও।কাকু এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে।
কলিং বেলটা বেজে উঠতেই নীচে নেমে দরজা খুলি।
এক সেলসম্যান।বড়ো বিরক্ত হই।
...তোমাকে খুঁজছিল গো!
অল্প কথায় লোকটিকে বিদায় করি।
আয়াজকে কী বলব ভেবে পাই না।

স্কুল খুলে গেছে।যাতায়াতের পথে আয়াজের সাথে টুকটাক কথা হয়।সেদিন বাড়ি ফেরার সময় দেখলাম শুকনো মুখে আয়াজ তখনও গেটের বাইরে
বসে।
...মা ফেরে নি?
...না!
খাবার খেতে বসে কী মনে হ'ল পায়েসের বাটিটা আয়াজকে ডেকে ওর হাতে দিলাম।
...খেয়ে নে।
....আমি বাড়ি নিয়ে যাব বাটিটা? মা ফিরলে
দু'জনে একসাথে খাব?
ধীরেধীরে ঘাড় নাড়ি।
কখনও কিছু খেতে দিলে আয়াজ মাকে ছাড়া একা খায় না।
মালা গজগজ করে...মায়ের জন্য কত্ত চিন্তা! মা তো এবার বিয়ে করবে তখন এত্ত ভালোবাসা যাবে কই?

আমি মালাকে ধমকে উঠি... থাম তুই!
...হ্যাঁ গো দাদাবাবু, গতকাল আয়াজের দিদা এসেছে।
ওরা তিনজন এবার গ্রামে চলে যাবে।আয়াজের মা তো এ জায়গার লোক নয়,তাই বরাবরের জন্য কেউ কাজে রাখতে চায় না।টুকটাক কাজ করে কি দু'টো পেট চলে?তাতে আবার অল্প বয়স,ছেলেছোকরারা ছোঁকছোঁক করে।গ্রামের এক রইস বাড়িতে কাজ করতো ওর মা।সেখানেই তো আয়াজের জন্ম।তারপরই তো গ্রামছাড়া করলো সবাই সাদিয়াকে!
...সাদিয়া কে রে?
...দেখো সাতকাণ্ড রামায়ণ শুনে...
...তুই এবার যা তো মালা!
মালা যেতে যেতে উত্তরটা দিয়ে যায়
...সাদিয়া হ'ল আয়াজের মা।
ছুটির দিন।ড্রাইভার নিখিলকে নিয়ে গাড়ি পরিষ্কার করছি ।আয়াজ এটা-সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। আয়াজের ভাবুক চোখ দু'টোয় হাজারও প্রশ্ন বুঝতে পারছি!সাহস পাচ্ছে না জিজ্ঞাসা করতে।
...নতুন বছর তো পড়ে গেল, স্কুলে ভর্তি করবে না তোর মা?
আয়াজের মুখে লাজুক হাসি।
...মায়ের বিয়ে গো। এবার আমার বাবা আসবে। বাবা-মায়ের সাথে এবার থেকে ইঁটভাটায় থাকব। ওই দূরের বড় শহরটায়। বাবা সেখানে মস্ত চাকরি করে।
...বাহ্! সেখানে তবে এ বছরই  স্কুলে ভর্তি হয়ে যাস।

...ইশশশ!  বাবা-মায়ের সাথে একসাথে থাকবে?
মালা ফোঁসফোঁস করে!কখন যে মালা এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি।
...মালা!
আমি ধমকে উঠি।মালা দমবার পাত্রী নয়।
...দাদাবাবু, ইঁটভাটার এক কুলির সাথে সাদিয়ার বিয়ে। সাদিয়াকে নিয়ে সে চলে যাবে অন্য শহরে। সাদিয়ার মায়ের সাথে আয়াজ গ্রামে থাকবে। পরের ছেলেকে কে নেবে নিজের সংসারে?
...সাদিয়া সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারবে?
...নূতন সংসারে কি ওদের ছেলেপুলে হবে না দাদাবাবু? অ্যাই সর, সর....
মালা গটগট করে চলে যায় আয়াজকে এক ঝামটা মেরে।
আয়াজের মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। এক গভীর অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয় মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থ। বিকল্প(substitute) শব্দটা গভীর অর্থবহ হয়ে মাথায় গেঁথে বসে। ক্লাসে যখন অংক শেখাই অহরহ তো শব্দটা ব্যবহার করি! আজ এর তীব্র অভিঘাত আমায় কেন থেকে থেকে এত রক্তাক্ত করছে?

আর মাসখানেকের মধ্যেই আমি আর শ্রীপর্ণা আলাদা হয়ে যাব। আমাদের দু'জনের জীবন দু'টো আলাদা খাতে বইতে শুরু করবে। আমাদের ছেলে অভি, আট বছরের অভি আমার কাছেই থাকবে। শ্রীপর্ণা ইন্দ্রজিৎকে বিয়ে করে ইস্রায়েলে পাড়ি জমাবে। সেখানে তাদেরও সন্তান জন্ম নেবে। সেই সন্তানকে পরম স্নেহে মানুষ করবে চরম উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। পরের ছেলেকে কে নেবে?

আমিও হয় তো অভিকে মানুষ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠব!নারী, চাঁদ,ফুল তো আমায়ও টানে! স্বেচ্ছায় পাণিগ্রহণ করব অন্য আরেক নারীর। কাঁদুনি গাইব...
একা একা আর সংসার টানতে পারছি না। ন তুন সংসারে নতুন সন্তান আসবে। কিন্তু অভি?

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri