খুঁক করে কাশতেই অমরনাথ দেখলেন যশোধরা তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। চোখ মুখে ভয়ার্ত কৌতুহল।
যশোধরা এ বাড়ির সব চাইতে নিরীহ মুখ। মুখচোরা, সর্বংসহা। আনমনেই যেন আর্তনাদ করে উঠলেন। সর্বনাশ! জ্বর নেই তো? গলা ব্যথা, সর্দি?
অমরনাথ জানেন এ প্রশ্ন খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। গত সাত-আট মাস ধরে মানুষের মুখে মুখে বাড়িতে বাড়িতে পাড়ায় পাড়ায় সাগরের ঢেউয়ের মতো উপচে পড়ছে।
লকডাউন। কখনো টানা, কখনো ক্ষেপে ক্ষেপ!
খবরের কাগজ, টিভিতে অনবরত ঘোষণা হচ্ছে, কতজন আক্রান্ত হল, কতজন মারা পড়ল। কী করবেন, কী করবেন না। কী খাবেন, কী খাবেন না। মুখে মাস্ক পড়বেন, পকেটে স্যানিটাইজারের শিশি রাখবেন। হাঁচি কাশি করমর্দন এড়িয়ে চলুন। বাজার ঘাটে ভিড় এড়িয়ে চলুন। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না, দূরত্ব বজায় রাখুন।
কল-কারখানা, অফিস-কাছারি, স্কুল কলেজ সব বন্ধ! চারধার নৈঃশব্দে ঢাকা। জনশূন্য পথ ঘাট। যেন শ্মশান ঘাটের স্তব্ধতা।
সবাই ভাবে কাশি মানেই করোনার পূর্বলক্ষণ। জ্বর থাকলে আধমরা। আর তার সঙ্গে গলায় ব্যথা থাকলে বয়স্ক হলে গঙ্গা যাত্রা, মাঝবয়সীদের পদ যাত্রা, অল্প বয়সীদের প্রাতঃভ্রমণ!
আপনজন প্রিয়জন শব্দ দুটো দেশ থেকে উঠে গেছে! সবাইকে সবাই ভয় পাচ্ছে। এমনকি সদ্য বিবাহিত কাপলরা আড়ালে আবডালে তাঁদের প্রিয়তমাকে আদর করতে ভয় পাচ্ছে।
আর যদি কোনো প্রকারে করোনা কাউকে করুনা করে, তাহলে কাম শেষ। গোটা পরিবার রকেটের মতো মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে। সরকারি হাসপাতালে জায়গা পেলে চিকিৎসা পাবে না। বেসরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে জায়গা নিয়ে................ নিজের বাড়ি ঘর বিক্রি করে স্বজন পরিজন নিয়ে শ্মশান ঘাটের সাজানো চিতা হয়ে যাবে।
অমরনাথও জানেন করোনায় মারা গেলে দেখা তো দূরের কথা মালসায় একখন্ড পোড়া হাড় ছাড়া কারো কপালেই কিছু জুটবে না।
........... বড় ছেলে অচিন্ত্য, মেজ ছেলে অম্লান বিষাদে ভরা মুখ নিয়ে অমরনাথের কাছে এসে বলল, মার কাছে সব শুনলাম, বাবা। ভয় পেয়ো না। নাকে গন্ধ আছে? খাবারে স্বাদ? জানোই তো এখানে কোনো চিকিৎসা নেই। শিলিগুড়ি যেতে হবে। ঝন্টু এ্যাম্বুলেন্স ঠিক করতে গেছে। পাঁচ হাজার চাইছে। দেওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হল করোনা টেষ্ট রির্পোট ছাড়া নার্সিংহোম ভর্তি নেবে না।
- কী করি বল তো?
- সারা শরীর ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতের মতো জ্বলে উঠল অমরনাথের। হারামজাদা। গলায় সুপুরির কুচি আটকে কাশি। তার জন্য এত আয়োজন!
তোমাদের মা এমনিতে কম কথা বলে, ঠিক! কিন্তু যেটা বলে সেটা ভূমিকম্পের মতো ধ্বংসাত্মক!