বছর কুড়ি পর/অলক পর্না সেনগুপ্ত ব্যানার্জী
বছর কুড়ি পর
অলক পর্না সেনগুপ্ত ব্যানার্জী
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
- উফ্ বড্ড গরম আজ, একটুও ঘুমোতে পারছি না, বাইরে রোদের তেজ কি!! বাপরে বাপ!!
- ওঃ এখন আবার কে এল!! এত জোরে কে যে বেল বাজায়!!এই সত্তর বছরেও একটু নিশ্চিন্তে শোওয়া বসার উপায় নেই!! একে তো এই গরম…
- তুমি!!! এ কি!!! এত বছর পরে!!!.... কীভাবে??? তুমি কি তাহলে বেঁচে…
- ভেতরে আসতে বলবে না?
- ও… হ্যাঁ হ্যাঁ এসো এসো
- কত বছর হল বল তো? কুড়ি না?
- হ্যাঁ… কুড়ি, কুড়ি বছর
- কেমন আছ স্বাতী? একাই আছ?
- ভালো, বেশ ভালো। তুমি ভালো আছ তো? একাই তো থাকতে হবে, মেয়ে বিয়ে হলে নিজের সংসারে যাবে না!! বোসো
- হ্যাঁ, বসি। সুন্দর সাজিয়েছ
- হুঁ। কোথায় আর!!
- খুব জানতে ইচ্ছে করল কেমন আছ তুমি, তোমরা। আমার মুন কেমন আছে? জীবনের মাঝপথে তোমাদের ছেড়ে চলে গেলাম… বড্ড কষ্ট হয়েছিল জানো!!
- মুন ভালো আছে। বর, ছেলে নিয়ে সুখেই আছে, মেয়ে জামাই আমার খেয়াল রাখে দূর থেকে যতটা সম্ভব। তোমার চলে যাওয়াটা তোমার হাতে তো ছিল না আর জীবনের মাঝপথ বলে সত্যিই কি কিছু হয়? জীবনের শুরু আর শেষ এ দুটোই হয় যেগুলো কোনোদিনই আমাদের হাতে থাকে না। তোমার অসুখ, চলে যাওয়া এবং তার পরও অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে আমাদের জীবনে।
- তোমাদের জন্য তো আমি কিছুই প্রায় রেখে যেতে পারিনি। মুনের বিয়ের টাকাটাও….
- থাক না ওসব কথা। তোমার মেয়ে তো ভালোই আছে। সময় সব কিছুর ওপর প্রলেপ দিয়ে দেয়। এখন আর কিছু মনে হয় না জানো। কুড়িটা বছর তো কম নয়। কিন্তু তখন খুব কষ্ট হত, রাগও। সবার জন্য এত করে গেলে সারা জীবন শুধু আমাদের বেলায় টেকেন ফর গ্ৰান্টেট?
- আমি বুঝতে পারিনি আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। ভাবতাম এভাবেই কাটিয়ে দেব। বাইরের মানুষের বিপদে পাশে থেকেছি ভেবেছিলাম আমার বিপদেও পাশে থাকবে তারা। তোমাদেরও অবহেলা করেছি এখন বুঝতে পারি। তখন কিন্তু বুঝিনি।
- একটা কথা এত বছর জিজ্ঞাসা করিনি। আজ করতে ইচ্ছে করছে খুব, আসলে এত বছর পরেও আগের কথাগুলো ভাবলে এই প্রশ্নটা বার বার সামনে আসে আমার
- কী কথা?
- হয়ত কুড়ি বছর আগে জিজ্ঞাসা করলে ভালো হত।
- কেন জিজ্ঞাসা করোনি?
- কি জানি…হয়ত বা অভিমান..
- এখন বল…আমি তো তোমার কথা শুনব বলেই এসেছি
- একসাথে চব্বিশ বছর কাটিয়েছি আমরা, তুমি কোনোদিন আমাকে ভালোবাসতে পেরেছিলে? কেমন যেন একটা বরফ চাপা জীবন কাটিয়ে গেলাম তোমার সাথে। গার্জিয়ান থেকে গেলে চিরকাল, একটু যদি বন্ধু হতে চাইতে…। আর তার মধ্যেও ভালোবাসা অনুভব করিনি তো কোনোদিন!!এ কি আমার বোঝার ভুল নাকি আমি ঠিক?
- আসলে আমাদের মধ্যে বয়সের এতটা ফারাক, আমার সেই ছোট্টবেলা থেকে অভাবের সাথে লড়াই, আমার মুখ চেয়ে থাকা এতগুলো মানুষ, তাদের প্রত্যাশার চাপ আমার প্রেমিক মনটাকে মেরে ফেলেছিল কবে যেন।
- আর যে মেয়েটা তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জনেদের ছেড়ে তোমার কাছে এসেছিল তার মনের খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবলে না কোনোদিন?
- ভাবিনি… সত্যিই ভাবিনি!!
- সারাদিনের উদয় অস্ত খাটুনির পর যে মুখটার দিকে তাকিয়ে একটু স্বস্তির শ্বাস নিতে চাইত মেয়েটা তার মুখ তখন মোটা মোটা বই এর আড়ালে ঢাকা… উদাসীন। কী জানি আমি হয়ত যোগ্য ছিলাম না তোমার
- ছিঃ স্বাতী!! ওভাবে বোলো না। ভালোবাসা ছিল, কিন্তু ভালোবাসা যে কখনও কখনও প্রকাশ করতে হয় এ বোধটাই আমার ছিল না। তুমি বলেই দুর্যোগের মধ্যেও শক্ত হাতে হাল ধরেছিলে। আমি হলে তো ভেসে যেতাম কবেই।
- কী করব, তখন আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তুমি নেই, আমি শক্ত না হলে মেয়েটার কি হত বলো? আর একটা কথা এখন মনে হয় জানো, তুমি তো কারো অপকার করোনি তাই হয়ত সব বিপদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছি আমরা
- তোমার চাকরিটাও ছিল অবশ্য, ওটা তোমার বড় সহায় হয়েছিল তখন।
- তা হয়েছিল অবশ্য। মনে আছে তুমি কিছুতেই আমাকে কাজটা করতে দিতে চাইছিলে না?
- আরে জঙ্গল পেরিয়ে রোজ রোজ যাওয়া, চিন্তা হবে না!!
- আর তোমার সেই ছাত্র, প্রকাশ যাকে ঠিক করেছিলে বাইকে করে পৌঁছে দেবার জন্য, রোজই আধা রাস্তায় গিয়ে ওর বাইক খারাপ!!
- হা হা হা…আরে ওকে আমি তেল ভরার টাকা দিতাম রোজ যাতে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসে, ব্যাটা খুব চালাক ছিল!!
- তোমার একটা গাড়ি কেনার খুব শখ ছিল, মনে আছে?
- হুমম…তা ছিল, কি করব বলো কুঁজোরও তো কখনও কখনও চিৎ হওয়ার শখ হয়
- ও মা ওসব কী কথা!! সব ঠিক থাকলে হয়ত কেনা হত
- হুঁ, আর তোমার বাসে উঠলে খুব কষ্ট হত সেটাও বুঝতাম। যাক কি আর করা… কত কিছু করার স্বপ্ন ছিল, কিছুই তো করা হল না
- সব স্বপ্ন কী আর পূরণ হয় এক জীবনে বলো? তাও মনে হয় যদি আর কটা দিন থাকতে…
- হা হা… ওই যে তখন বললে যাওয়া আসা কিছুই আমাদের হাতে নেই, বড় সত্যি বলেছ
- জানো রাজার হাসি, কথাবলার ধরণ, হাত পায়ের গড়ন একদম তোমার মতো। এমনকি আমাকে বকাও দেয় অবিকল তোমার মতো করে। রাজা কে বুঝতে পারলে? আমাদের মুনের ছেলে
- বড় ইচ্ছে ছিল নাতি নাতনির মুখ দেখার, যাক্ তোমার চোখ দিয়েই দেখব। এবার আমার সময় হল উঠি।
- যাবে? আচ্ছা…
- যেতে তো হবেই। তুমি ভালো আছ জেনে শান্তি পেলাম। কষ্ট রেখো না মনে। অনেক অবহেলা করেছি তোমায়। কিন্তু চোরা স্রোতের মতো ভালোবাসা ছিল তোমার জন্য। যা তোমাকে বোঝানোর মতো বোধই ছিল না আমার।
-“জানি না আরও কত দীর্ঘ পথ বাকি…মনে সাহস নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টাই করে যাই। আমি ভালো না থাকলে মেয়েটার যে বড় কষ্ট হয় গো।
- তোমার জীবনকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেওয়ার দায় আমারই, জেনে অথবা না জেনে। কিন্তু জীবনের শেষদিন অবধি যেন সেই যুদ্ধ করার শক্তি ঈশ্বর তোমাকে দেন এই প্রার্থনা করি।
- যাওয়ার সময় কি না কাঁদালেই চলছে না তোমার?
- আমি তো যাইনি স্বাতী, তোমার মনের মধ্যেই তো বেঁচে আছি
ক্রিরররং…ক্রিং…ক্রিরররং…ক্রিং
- ওঃ এতক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম!! হ্যালো…
- হ্যালো…দিম্মা কালকে তোমার কাছে যাচ্ছি আমি আর মা, তুমি পুডিং বানাবে হ্যাঁ?
-হ্যাঁ সোনা অবশ্যই। তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকব।
-আচ্ছা দিম্মা আমি রাখি এখন। মা তোমাকে পরে ফোন করবে।
- আচ্ছা
আঃ কি সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে বৃষ্টি আসবে মনে হয়!! বড় শান্তি… বড় শান্তি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴