ফেরা
ধীরাজ কুমার রায়
------------------------
বিতানের চিৎকার শুনে ছুটে এলো মধুরিমা | উঠোনে আমগাছের নীচে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত বিতান। কাছে গেলো মধুরিমা। ওমা, এতো পাখির বাসা ! বিতানের মাথার উপর আমগাছে একটি পাখি আর একটি কাকের মধ্যে লড়াই চলছে তখনও। "মা দ্যাখো, বাচ্চাদুটো কি সুন্দর !" দুই সদ্যজাত পাখির ছানার উপস্থিতি এতক্ষণ খেয়াল করেনি মধু। বিতানের কথার প্রেক্ষিতে দেখে, সত্যি তো ! বিষয়টা আগেই বুঝে নেওয়া উচিৎ ছিলো।নইলে শুধু শুধু ফাঁকা বাসা নিয়ে কেন এত উদ্বিগ্ন হবে ছেলেটা ? কাকটার সাহসের প্রশংসা করতেই হয়, মধুরিমার উপস্থিতিতেও এতটুকু ভয় পায়নি ! অসহায় ছানাদের উপর ছোঁ দেওয়ার হ্যাংলামো দেখে - বড্ড রাগ হল। নিরুপায় মা পাখির ডানা উঁচিয়ে বাঁধ সাধা ছাড়া কিই বা করার আছে ! জানে মধু। চটকরে দু'টো পাটকাঠি ধনুকের মতো বাগিয়ে ধরতেই বন্ধ হল কাকের সন্ত্রাস। কাকটি চলে যেতেই নীচের দিকে তাকাল মা পাখি। তার ছানাদের আগলে থাকা বিতানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে মনে হল। কী ভাবতে পারে পাখিটি?
যাই ভাবুক, চেয়ে থাকার মধ্যে চিন্তা বা ভয়ের যে কোনো চিহ্ন নেই - এইটুকু বুঝতে অসুবিধে হল না মধুরিমার। কতই বা বয়স হবে ছানাদুটির? খুব জোর হলে দিন দুইয়ের বেশি নয় ! চোখ ফোটেনি এখনো। বাসাটির খড়কুটোর মোটা আস্তরণ আঘাত পাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে বিতান, " মা, ওদের খিদে পেয়েছে বুঝি ! খেতে চাইছে | বাটিতে করে একটু দুধ-ভাত দেবে তুমি? " ছানাগুলো মাকে কাছে পায়নি দীর্ঘক্ষণ। কে জানে সত্যি হয়তো খায়নি, বা খাওয়ানোর সুযোগই পায়নি মা পাখিটি ! মধুরিমা লক্ষ্য করল - নরম কচি ঠোঁট মেলে খেতে চাইছে কিছু। সঙ্গে অনর্গল কিচিমিচি। থামার নামই নেই। নিজের ছোট্ট দুই হাত আলতো করে বুলিয়ে ওদের কান্না থামানোর অনর্গল চেষ্টা করে চলেছে বিতান।
মধুরিমার হাসি পেল। ইস, তার চার বছরের ছোট্ট বিতান হঠাৎ কেমন অভিভাবক হয়ে গেছে আজ ! আদুরে আগলে রাখা এবং অগাধ নিরাপত্তার ভরসায় নকল মধুরিমা যেন। এত্তো মনোযোগ সহ উপলব্ধি করে নিজের শৈশব? "মা, কই নিয়ে আসো না - একটু দুধ-ভাত ! একটা চামচ এনো কিন্তু !".....
ভাবনায় ছেদ পড়ে মধুরিমার | "না বাবু, দেখছ না ওরা কত্তো ছোট ! এখনো মুখে ভাতই হয়নি যে ! কি করে ভাত খাবে বলো ? " এবার চিন্তিত হওয়ার পালা বিতানের | সত্যি তো, মুখে ভাত না হলে ওরা ভাত খাবেই বা কি করে? " পাখিদেরও মুখে ভাত হয়? কিন্তু মা, গাছের ওই পাখিটা যদি মা হয় - তবে ওদের বাবা কোথায়? অফিস গেছে বুঝি?" ছেলের এমনতর প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না মধুরিমা। উদাস ভাবে বলে উঠল, "কে জানে, হবে হয়তো !"...
আসলে সে ভাবছিল অন্য কিছু। এত্তো ছোট ছানা, দেখে বোঝা সম্ভব নয় - কোন জাতের পাখি ! আমগাছের ডালটার দিকে তাকাল, কই মা পাখিটা কোথায়? একটু আগেও ছিল, এখন এই কচি-কাঁচা গুলোকে কোথায় রাখবে মধুরিমা? " কি ভাবছো মা - এদের রাখবে কোথায় তাই না? ওই ঝাউগাছে বাসাটাকে আটকে রাখো, দেখবে ওদের মা ঠিক চলে আসবে !".....
হাতে চাঁদ পেলো আর এক মা। বিতান এত সহজেই সমস্যার সমাধান করে দেবে ভাবেনি। উঠোনের কোণে ঝাউগাছে ছানা সমেত বাসাটিকে রাখলো মধুরিমা। অত্যন্ত সাবধানে, কারণ বিতানের অনুসন্ধিৎসু চোখ লক্ষ্য রাখছে সবটাই | "মা আস্তে, দ্যাখো - আঘাত লাগবে !" মিনিট কয়েকের মধ্যেই আবার বিতানের গলার স্বর শুনে বাইরে এলো মধু। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলে উঠল, "মা,দ্যাখো - মা পাখিটি ফিরে এসেছে ! ছানাদের মুখে কত্তো চুমু খাচ্ছে!".....
সত্যি ফিরে এসেছে মা পাখিটি | চুমু নয়, ওদের মা যে এভাবেই খাওয়ায় - বোঝেনি বিতান। মধুরিমা দেখছে, হাল্কা হাওয়ায় ভরপুর বাসা সহ কেমন আস্তে-আস্তে দুলছে ঝাউগাছের ডালটি।