ফুলেশ্বরী
ফুলেশ্বরী
চিত্রা পাল
~~~~~~~
বারান্দায় থামটায় ঠেস দিয়ে বসে আছে ফুলেশ্বরী উদাস দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে। ভোর হলেই দুয়ারের আগলখানা খুলে এমন করে বাইরে এসে বসে। ওর দৃষ্টি যেন পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে কোন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। আজ তিন চারদিন হল এভাবেই ও চিন্তা ভাবনা করে চলেছে, এখনও কোনো কিনারায় আসতে পারেনি। বিষেণের প্রস্তাবটাতেও কোন সম্ভাবনাসূচক ইঙ্গিত দেয়নি। কি বলবে ও, এখনও বিষেণের সঙ্গে সামান্য সাধারণ কথা বলার পর্যায়েই আসতে পারছে না।
ওর সামনে বাড়ি থেকে কিছু দূরে বেশ বড়সড় এক বাঁশঝাড়। সে বাঁশঝাড়ের কচি আগা বসন্তের মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। সেদিকে দেখতে দেখতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুই বালক বালিকার ছুটোছুটি। দুজনেই বাসক ফুলের ডগা থেকে মধু খাচ্ছে। মা ভেতর থেকে ডাকে "ফুলু ও ফুলু উঠেছিস্।" মায়ের ডাকে যেন সম্বিৎ্ ফিরে পায়। মা বলে "যা না মা, গইলে থেকে রাঙিটাকে বের করে বাইরের খুঁটিতে বেঁধে দে না।" ধীরে ধীরে উঠে গোয়ালের বেড়ার বাঁধন খোলে।
ফুলেশ্বরী নাম রেখেছিল ওর ছোটকাকা। এমন বসন্তদিনেই ওর জন্ম। যেদিন জন্মেছে সেদিন ওদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে এত ফুল ফুটেছে, উছলে ওঠা চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্নার ফিনিক ছুটেছে, ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম করছে, তার মধ্যেই ওর আগমন এবাড়িতে। ফুটফুটে পরী যেন। পথ ভুলে এখানে এসে পড়েছে। এত ফোটা ফুলের মাঝে ফুলের মতো কন্যে দেখে ওর কাকা নাম রাখলো ফুলেশ্বরী।
ফুলেশ্বরী একটু একটু করে শশীকলার মতো সকলের আদরে বড় হতে লাগল। বসন্তে বসন্তে ও যেন হয়ে উঠল আরও সুন্দর। ফুলেশ্বরীকে আদর করে কেউ ডাকে ফুল, কেউ ফুলু। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ওর বড় ভাব। তবে সবচেয়ে বেশি ভাব মালতী আর বিষেণের সঙ্গে। কখন থেকে যেন শুধু বিষেণই হয়ে উঠল ওর সব খেলার সাথী।ফাগুন চৈত মাসে যখন মাঠগুলো ঘেঁটু গাছে ছেয়ে যায়, সেই ঘেঁটু ফুলে ও পেয়েছিল মধুর সন্ধান। কোন আমগাছে আগে গুটি বাঁধে, কোন ঝোপে এই এত্ত বড় বড় পাকা নোনা পাওয়া যায়, মিষ্টি যেন গুড়, সব ওদের নখদর্পণে। আসলে বাইরের অনন্ত প্রসারিত জগৎ ছিল ওদের দু হাতের বৃত্তে। ওরা অনায়াসে দেখেছিল, কেমন করে টুনটুনি পাখি ঠোঁটে করে পাতা সেলাই করে তাতে নরম শুকনো ঘাস পাতা বিছিয়ে রাখে ওর আগত বাচ্ছার জন্য। ডিম ফুটে বাচ্ছা বড় হয়ে কেমন করে উড়তে শিখে আর একটা ডালে গিয়ে বসে। এসবই ওদের কাছে অভাবনীয় আর অবাক করা।
বসন্তে আমের বোল যেমন প্রচুর ঝরে পড়ে গাছের তলায়, তেমন কত স্মৃতি যে ছেয়ে ফেলছে মনের গহনে তার শেষ নেই। তখন সেই আনন্দ-আঘাতে চঞ্চল হয়ে উঠত প্রাণমন। আজ শুধুই বিষাদ। বিষেণকে ফুলেশ্বরী বারণ করেছে আসতে, তবু আসে, শুধু একটা আর্জি নিয়ে "আমরা কি আবার শুরু করতে করতে পারি না?" ডাস্টার দিয়ে একেবারে ঝেড়ে মুছে দিয়ে আবার নতুন করে লেখা ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা যায়, হয়তো বা তেমনি বলতে চেয়েছে। সকালের নির্জনতা ওর মনকে এই ভাবনায় যেন অধিকার করে নিয়েছে। বিষেণের আবেদন ওকে এক কুহক, এক জটিলতায় নিয়ে যাচ্ছে। আজ যে ও সেই স্বপ্নযুগের অসম্ভবের কাল পেরিয়ে দিবালোকের স্পষ্টতায় বসে আছে, এখন বিশেষ করে ওর এই নিদারুণ অবস্থায় কি উত্তর দিয়ে কোন দিকে যাবে?
ফুলেশ্বরী আর বিষেণ যখন পুতুলখেলা থেকে জীবনখেলার সন্ধিক্ষণে সে এক বসন্তের দুপুরে ওদের ঘরে পাশের ছোট্ট নদী করলাতে নেমে দুজনে হাতে হাত রেখে নদীকে সাক্ষী মেনে, সে নদীর জল ছুঁয়ে কথা দিয়েছিল ওরা সারা জীবন একসাথে চলবে, এক মনপ্রাণ হয়ে। বাতাসে ছিল ঘেঁটু ফুলের গন্ধ। ওদের বাড়ির সামনের কাঁঠালগাছে দেখেছিল মুকুলিত ফুল থেকে ফলের আভাস। ওদের প্রাণধারা ছিল প্রসারিত।
কিন্তু জীবনধারা চলল উল্টো পথে। ওরা যে চেনেনি এ সংসারকে। তাই সুন্দর ফুলকে ছিঁড়ে নিয়ে ওর পরিবার ওকে দিল ব্যবসায়ী পরিবারকে। আর বিষেণ এ গ্রাম ছেড়ে শহরে ব্যাকুল মনকে জড়িয়ে নিল নিবিড় কাজের মধ্যে। বেশ চলছিল দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে।
কিন্তু না জীবনধারা যে বাঁধা গতে বয় না। ফুলেশ্বরীও ওই সংসারে জুড়ে গিয়েছিল। কোল আলো করে এলো ফুটফুটে কন্যাসন্তান। মেয়ের যখন চার বছর বয়স, সেবার শীতে ওর বর আর তার চারবন্ধু গেল পিকনিক করতে পাহাড়ে। ফিরেও আসছিল ঠিকঠাক, কিন্তু না কার্শিয়াংএর কাছে চাকা পিছলিয়ে গাড়ি পড়ল খাদে। দুজনের ওখানেই মৃত্যু, তারমধ্যে একজন ওর বর। একবছর পরে মেয়েও চলে গেল ওকে ছেড়ে, অনেক ওপর থেকে পড়ে গিয়ে আঘাতের জেরে। এর পরে আর আর দ্বিরুক্তি করেনি। সব ছেড়ে চলে এল এইখানে সেই ছোটবেলার ঘরবাড়িতে।
ক্যান্সার ধরা পড়ার পরে বেশি সময় নেয়নি বিষেণের বৌ। লাঙ ক্যানসারে সময়ও বেশি নেয় না। দুবছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে নাজেহাল বিষেণ ওর বাড়িতে এল বাবা মায়ের কাছে। এসে শোনে ফুলির কথা। এতদিন এত কথা বাড়ির লোকের সঙ্গে হয়েছে, ফুলির প্রসঙ্গ ওঠেনি। প্রথম দিকে ছিল অভিমান পরের দিকে নিজের পরিবারের সমস্যা, সব নিয়ে তাতেই ডুবে ছিল ও।
ফুলি এখানে আছে শুনেই ছুটে এসেছে ফুলির কাছে। কিন্তু এ কাকে দেখছে ও! এ তো সেই ফুলি নয়, এ যে ওর প্রেত। একজন মানুষের এইভাবে ক্ষয়? বাইরে বসন্তের আগমনে প্রাণময়ী ধরণী। তার আদরের নাম লেখা গাছেপালায় পত্রপুষ্পে। পলাশ শিমূল লালে লাল। মালতীলতার পাতা ঢাকা পড়েছে ফুলের সাজে। আগে দুবার এসেছিল বিষেণ। আজ ও একা আসেনি, আবার এসেছে ফুলির কাছে আবেদন নিয়ে সঙ্গে ছেলে। দুরন্ত ছেলে দৌড়ে যেতে বাগানে ইঁটে ঠোক্কর খেয়ে ব্যথায় জোরে কেঁদে ওঠে। ফুলি তাড়াতাড়ি ওকে কোলে জড়িয়ে ধরে। বিষেণও ছুটে এসেছে ছেলের কাছে। আজ এই উৎফুল্ল বসন্ত মাধুর্য্যে পাখির কলরবে ফুলি বোধ হয় কিছু খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। ফুলেশ্বরীর চোখে ভাসে আবেদনের সম্মতি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴