ফুলকি
ফুলকি
সুমনা দত্ত (ঘোষ)
^^^^^^^^^^^
বাসে জানালার পাশে বসে ফেসবুক ঘাটাঘাটি করছিলো শ্রীময়ী। বাড়ি থেকে দূরের স্কুলে চাকরি করার সুবাদে সে এই বাসের নিত্যযাত্রী । এখানে বাস প্রায় মিনিট পনেরো দাঁড়ায়। সকাল থেকে ব্যস্ততার কারণে ফেসবুকটা দেখা হয়নি আজ , তাই সময় পেতেই একবার ফেসবুকে ঢুঁ মেরে আসা। এসবের মাঝেই হঠাৎ আঁচলে একটা টান লাগতেই ফিরে তাকালো শ্রীময়ী। একটা দশ এগার বছরের মেয়ে, গায়ে ছেড়া জামা হাত পেতে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মাইজি দুই দিন কিছু খাইনি কুছ
পয়সা দাও না। মেয়েটিকে দেখে খুব কষ্ট হল। আহা রে! ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে শ্রীময়ী বলল তোর নাম কি ? মেয়েটি বলল ফুলকি। আগ্রহ নিয়ে শ্রীময়ী বলল তোর বাবা মা কোথায়? তুই কোথায় থাকিস? মেয়েটি চুপ করে থাকে। শুধু যেন কিছু টাকার প্রত্যাশায় সে দাঁড়িয়ে। টাকাটা বের করে শ্রীময়ী বলে শোন ,আমার সাথে যাবি ? স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো, আমার বাড়িতে থাকবি-খাবি। ফুলকি কিছু বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ ফুলকির দৃষ্টি একটু দূরে এক মহিলার দিকে পড়ল। টাকাটা হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়েই হাওয়া হয়ে যায় সে ।
সেদিনের পর থেকে শ্রীময়ী খেয়াল করেছে ওকে দেখলেই ফুলকি এড়িয়ে চলে। সত্যি মেয়েটার উপড়ে একটা মায়া পরে গেছে। সেদিন কোন এক কারনে স্কুলটা তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছিল শ্রীময়ীর। স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতেই দূর থেকে দেখল ফুলকি এক ভদ্রলোকের হাত-পা ধরে ভিক্ষে চাইছে। আজ নিজেই ফুলকির দিকে এগিয়ে গেল শ্রীময়ী। খপ করে পেছন থেকে ওর হাতটা ধরে নিল। ফুলকি খানিক হতভম্ব হয়ে পড়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। শ্রীময়ী কিছু বলার আগেই একজন গুন্ডা মতো মধ্যবয়স্ক লোক সামনে এসে দাঁড়ায় আর গম্ভীর গলায় বলে মাইজি ধান্দার সময় বিরক্ত করবেন না তো! ওকে ছেড়ে দিন শ্রীময়ী অবাক হয়ে বলল ধান্দা! এইটুকু মেয়ে এইভাবে ভিক্ষা করছে! লোকটি চাপা স্বরে বলল আমার মেয়ে ভিক্ষা করবে না ঘুরে বেড়াবে সেটা আমি বুঝে নেব। আপনাকে ভাবতে হবে না। শ্রীময়ী ঠান্ডা মাথায় বলল দেখুন হয়তো আপনার অর্থনৈতিক সমস্যা আছে তাই বলে....! আর এখন তো স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিল মানে খাবার দেয়। লোকটি এবার রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, সে তো এক বেলা। আর তারপর ? শ্রীময়ী কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে দিয়ে লোকটি বলল আপনি নিজে পয়সা খরচা করে পড়েছেন আর এখন কত কামাই করেন? আমার মেয়ে কোন রকম খরচ ছাড়াই প্রতিদিন তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা কামাই করে। এবার আপনি হিসাব করেন মাসে কত হলো। আর ওই পড়াশোনার ভূত ওর মাথায় ঢোকাতে হবে না বুঝলেন। ছাড়ুন ছাড়ুন ওকে ছেড়ে দিন। ফুলকি হাতটা আলগা হতেই দৌড়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার পর থেকে শ্রীময়ীর সাথে আর ফুলকির দেখা হয়নি। মাঝে কেটে গেছে কয়েক বছর।
নতুন স্কুলে বদলি হয়েছে শ্রীময়ী আজ পুরনো স্কুলে তার শেষ দিন। ভারাক্রান্ত মনে কচিকাঁচা মুখগুলো মনে করে চোখের জল আসছিল। চশমার কাঁচটা মুছতে মুছতে হঠাৎ আঁচলে একটা টান অনুভব করলো শ্রীময়ী। মাইজি কিছু টাকা দেবেন? বাচ্চাটার দুদিন ধরে জ্বর কিছু খায়নি। শ্রীময়ী মুখ তুলতেই দেখল সামনে ষোল-সতের বছরের একটি মেয়ে কোলে পাঁচ ছয় মাসের একটা বাচ্চা। শ্রীময়ীকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল মেয়েটা। মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল পাশ কাটিয়ে। শ্রীময়ী ডাকলো ফুলকি! ফুলকির চোখে জল, সে ফিরে তাকালো। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না শ্রীময়ী বলল একি অবস্থা হয়েছে তোর আর এই বাচ্চাটা !ফুলকি মাথা নিচু করে উত্তর দিল আমার মেয়ে। শ্রীময়ী বলল মানে! ফুলকি বলল বাপটা গাড়িচাপায় মরে গেল, মা একটা বুড়ো লোকের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। তারপর বোনকে নিয়ে অন্য মরদের সঙ্গে পালিয়ে গেল। লোকটা না দিনরাত নেশা করে আমাকে মারত। তাই মেয়েকে নিয়ে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। এখন আগের মতই ভিক্ষা করি। তবে আগের মত কামাই হয়না। শ্রীময়ীর চোখে জল এসে গেল। একটা পাঁচশ টাকার নোট ফুলকির হাতে গুঁজে দিল। ফুলকি ফিরে যেতে যেতে ঘুরে তাকায় তারপর হঠাৎ চোখ দুটো চকচক করে উঠলো বললো মাইজি যত কষ্টই হোক আমি আমার মেয়ে সরস্বতীকে স্কুলে ভর্তি করাবোই বলেই এক নিমিষে মানুষের ভিড়ে ফের হারিয়ে গেল ফুলকি। শ্রীময়ী জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখল একটা পাখি অনেক দূরে উড়ে বেড়াচ্ছে ডানা মেলে। বাসটা ছেড়ে দিল খুব দ্রুত গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছে শ্রীময়ী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴