সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
24-November,2022 - Thursday ✍️ By- শ্বেতা ভট্টাচার্য্য 263

ফিরবে না তা জানি

ফিরবে না তা জানি...
শ্বেতা ভট্টাচার্য্য
~~~~~~~~~~~~

বাবা...
      এ চিঠি কোনোদিনই তোমার কাছে পৌঁছোবে না জানি। তবু খুব লিখতে ইচ্ছে হ'ল। কখনও তো মনের কথাগুলো সেভাবে তোমাকে বলা হয়নি! তুমি চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা বসন্ত পার হয়ে গেছে। আজ আবার এক বসন্ত...ফাল্গুনমাস চলছে।বসন্তের ছোঁয়া ছোটো এই শহরের আনাচেকানাচে। চারদিক রঙে রঙে রঙিন প্রতিবারের মতোই। কোকিল ডেকে উঠতেও ভোলেনি, তবু...

কেন যে এ সময় আমার বড্ড মনখারাপ করে! জানো বাবা আজ নয়...সেই ছোটোবেলা থেকেই। শৈশবে, এমন কী কৈশোরেও ফাল্গুনচৈত্র মাস এলেই মনটা হু হু করে উঠত। উঠোনের ফুটিফাটা মাটির জ্যামিতি বুকের ভেতর তৈরি করত এক গভীর শূন্যতাবোধ, গলার ভেতর কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠত। দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। মা-ও বুঝতে পারত না কষ্টটা! বুঝবে কী করে আমি তো কখনও কাউকে বলিনি। আর বলব কী? আমি নিজেও যে বুঝতে পারতাম না...কী কষ্ট, কেন কষ্ট? শুধু মনে হ'ত কী যেন নেই, কী যেন থাকবে না। ওই যে বললাম এক গভীর শূন্যতাবোধ...সেই ভীষণ শূন্যতাবোধ ঘুণপোকার মতো মনটাকে কুড়ে কুড়ে খেতো।

চৈত্রের খরখরে রোদ মাটির জল শুষে নিত প্রবল তৃষ্ণায়। মাটি হয়ে উঠত ফুটিফাটা। উঠোনের বুক চিড়ে চিড়ে আলপনা এঁকে যেত সেই প্রখর রোদ।চিড়ধরা মাটিতে কত শত অবয়বই না ভেসে উঠত কল্পনায়! এলোমেলো ঝড়ে উড়ে আসত নদীর রূপোলি বালি। কিচকিচ করত বাড়িঘর। পর্ণমোচীর পাতারা উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে উঠোনে ভেসে আসত কোন সুদূর থেকে। ভরিয়ে ফেলত উঠোন, ছাদ, মাঠ, ঘাট। মাঠের মাঝের জমা পাতায় ঘূর্ণি লাগত থেকে থেকে। সেই ঘূর্ণি আমাকে আরো অবশ করে দিত। টেনে নিয়ে যেত কী এক অজানা, অদেখা কষ্টের কৃষ্ণগহ্বরে! সে গহ্বর আমাকে অনির্দিষ্ট কোন এক অতলে ক্রমাগত টানত। অবিরাম টেনেই যেত। সেখান থেকে পালানোর পথ বা উপায় কোনোটাই  খুঁজে পেতাম না। শুধু বুঝতাম আমি তলিয়ে যাচ্ছি।

বাড়ির পেছনে তোমার সাধের কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল আর অমলতাসের সারি। ফুলগুলো ঝরে ঝরে পড়ত মাতাল হাওয়ায়। লাল,গোলাপী, হলুদ, সবুজে মাখামাখি হয়ে যেত উঠোন। কুবো আর ঘুঘুর একটানা ক্লান্তস্বরে সব হারানোর কী এক ব্যথা।কোকিলের কুহুরবে বুকের ভেতর কীসের যেন এক খামচাখামচি। 

                        ...কোয়েলিয়া,
কোয়েলিয়া গান থামা এবার,
কুহুতান, তোর ওই কুহুতান,
ভালো লাগে না আর...

স্নানখাওয়া সেরে চুপটি করে ঘরে বসে থাকতাম। তুমি তখন কাজে। মা-ঠাম্মা ঘরকন্নায় ব্যস্ত। দাদু দিবানিদ্রায় বিভোর। মা জানালা দরজা ভেজিয়ে হাতের লেখা লিখতে দিয়ে চলে যেত। বন্ধ ঘরে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে যেতাম...এটা আমি। আমি "আমি" না হয়ে অন্য কেউ হ'তাম যদি,তবে কী হ'ত? তবেও কি আমি আমাকে "আমি" ভাবতে পারতাম? আমিই "আমি" হ'লাম কেন? আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে এই "আমি"টা কী হবে, কোথায় যাবে? এই ঘরবাড়ি,
নদীপুকুর, উঠোন,গাছপালা সব্বাই থাকবে, সব্বাই। শুধু আমি থাকব না। অমনি দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসত। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেয় লুটিয়ে পড়তাম। কখন ঘুমিয়ে পড়তাম টেরই পেতাম না। বিকেলে তুমি ফিরে মাকে জিজ্ঞাসা করতে -- কখন জ্বর এলো? মা উত্তর দিত -- কাজ সেরে ঘরে এসে দেখি মাটিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি গরম। 

আজ বহুদিন ঝাঁট পড়ে না ওই উঠোনে। ঝরাপাতা জমে জমে হয় তো ডাঁই হয়ে আছে উঠোন! চৈত্রের রোদ্দুরে ফুটিফাটা মাটির জ্যামিতিক কারুকাজ ঢাকা পড়ে আছে শুকনো পাতায়! হয় তো রোদ্দুর পড়ে না আমার প্রিয় সেই যৌথবাড়ির উঠোনে। সুপারি, নারকেল, বাঁদরলাঠি, কৃষ্ণচূড়ার দীর্ঘ ছায়ায় সারাদিন  ঢেকে থাকে সে আঙিনা। পাতার পর পাতা সরিয়ে মাটির গায়ে হাত বোলালে, হাত ভিজে যাবে জলে। আমাদের জন্য কান্না জমিয়ে রেখেছে সে সবার চোখের আড়ালে। তার হৃদয়ে সারাবছরই চৈত্র মাস।

বহু বছর হ'ল ছেড়ে এসেছি ওই ভিটে। তারপর আর ফিরে যাওয়া হয়নি। মালিকানা বদলেছে তার! বদল হয়েছে বেশ কিছু হাত। শুনেছি এখনও নতুন কোনো
অট্টালিকা গড়ে ওঠেনি ওই জমিতে। সে যে জমি বা পরিত্যক্ত বাড়ি নয় বাবা, সে-ও স্বর্গাদপি গরিয়সী। পিতৃপুরুষের প্রথম ভিটে। আমাদের ছেড়ে সে-ও ভালো নেই। চৈত্রের এই দিনগুলোতে তারও বুকের ভেতরটা হয় তো হুহু করে। আমার মতো তারও কি আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে ফেলে আসা দিনগুলোকে, চলে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতীক্ষায় সে কি আজও বসে আছে? চৈত্রের বায়ু যখন হা হা স্বরে বয়,তারও বুক বুঝি খা খা করে বাবা। প্রচণ্ড ইচ্ছে শক্তির জোরে ঠেকিয়ে রেখেছে নতুন ইমারত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা! 

পরিত্যক্ত ভিটে আর ফাল্গুন-চৈত্র মাস যেন পরস্পরের পরিপূরক বাবা! একজনকে দেখলে অপরের কথা মনে পড়ে যায়। যে হাহাকার চৈত্রের বাতাসে, সেই আর্তনাদ মনুষ্যবিহীন পোড়োভিটেতেও। দু'জনেই বলে... কে যেন ছিল, কে যেন নেই, কে যেন আসবে বলেছিল, কার যেন আসা হ'ল না।শবরীর অনন্ত প্রতীক্ষা! বসন্তেও তীব্র দহন,প্রবল একাকীত্ববোধ (যদিও আমি কখনই একা নই বাবা)

যত ফেলে আসা দিনের স্মৃতি এই পাতা ঝরার দিনেই মগজ থেকে হৃদয়ে ঝরে বাবা!

...আমার  জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে
ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে।...

কিন্তু যে যায়, সে যে যায় বাবা। আর তো ফেরে না।তুমিও কি আর ফিরবে? ফিরবে না জানি। ফিরে পাব না আমার শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের সেই দিনগুলোও। তবু কেন মন কিছুতেই প্রবোধ মানে না!
এ কি দুঃখবিলাস? 

মনে পড়ে... সূর্য যখন অস্তাচলে,ঝোড়ো বাতাসে অনেকটাই লাগাম... মণিকাকু ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে ঠাণ্ডা করত মাটি। একটা মৃদু হিসহিস শব্দ পেতাম মাটির জল শুষে নেওয়ার, আকণ্ঠ তেষ্টা মেটাত সে। 
বেঁচে থাকাকালীন যে আকণ্ঠ তেষ্টা, সে-ও বুঝি মেটানোর চেষ্টা করা হয় চিতাভষ্মে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে। নইলে সে আঁচ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মেটে না, সে তেষ্টা থেকেই যায়। নইলে সাতজন্ম কথাটা এসেছে কেন? মণিকাকুর জল ঢালা শেষ হ'তে না হ'তেই আমার গলা পিপাসায় শুকিয়ে উঠত বাবা! ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নিতাম।

সময় বয়ে যায় একই খাতে,একই দিকে; পড়ে থাকে কেবল স্মৃতি। তাকে ছোঁয়া যায় না, আঁকড়েপাকড়ে বুকের ভেতর টেনে নেওয়াও যায় না। মাথার কোনো ধূসর জায়গায় তার শুধু সাদাকালো অবস্থান। রঙীন অবয়ব ধরে আবার সামনে আসে কই? মেনে নিতে বড়ো কষ্ট হয় বাবা! বিশ্বাস করতে সাধ হয় চৈত্রের দিনগুলোতে ঠাম্মার হাত ধরে আবার মাঠে যাব। মাঠ ঘন হয়ে থাকবে বকুলগাছে। টুপটাপ ঝরে পড়বে তারার মতো ছোটো সাদা ফুল। দূরে কৈলাসকাকুর বাঁশিতে বাজবে অজানা মন কেমনকরা সুর। আবার আমার মন মুচড়ে উঠবে মায়ের জন্য। বাড়ি ফিরে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফু্ঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদব।সাক্ষী থাকবে ঝিরঝিরে বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠা প্রদীপশিখা আর তুলসীগাছ। 

...ফিরবে না তা জানি, তা জানি--
আহা, তবু তোমার পথ চেয়ে জ্বলুক প্রদীপখানি...

                                           ... মিতুন

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri