প্রেমটুকু থাক
প্রেমটুকু থাক
ঈশিতা গুপ্ত
~~~~~~~~
সত্যব্রত একা বসে আছেন ব্যালকনিতে, তাঁর প্রিয় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে। তাঁর শরীরে আর আজ কোনো বল নেই, মাথা তুলতে পারছেন না, হাত পা মন সব যেন অবশ, এরপর? কি হবে তাঁর? ভাবার শক্তিও লোপ পেয়েছে যেন। মাথা হেলিয়ে দিলেন, চোখ বন্ধ করতেই গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। নাঃ, মুছলেন না আর, পড়ুক, কিছু অশ্রু ঝরে পড়ুক সুমির জন্য। এই কিছুক্ষণ আগে ওরা নিয়ে গেছে সুমির নিথর দেহটাকে। ৫৬ বছরের সঙ্গীকে যেতে দিতে হয়েছে তাঁকে। গত চারবছর ধরে সুমি একভাবে শুয়ে থাকতেন বড় খাটটাতে, ফিমার বোন ভেঙে ঠিকমতো জোড়েনি বলে হাঁটা চলার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন সুমিতা। চোখেও দেখতেন না শেষ কয়েকবছর। অথচ বই পাগল ছিলেন এই সুমিতাই। সেই ১৯৪৬ সালের স্নাতক তিনি, এক জেলা শহরের বিখ্যাত কো-এডুকেশন কলেজে পড়েছিলেন। তন্বী সেই যুবতীর চোখে চোখ মিলেছিল এক মেধাবী যুবকের। ঐ কলেজেই তৃতীয় বর্ষ ইংরেজি সাম্মানিকের ছাত্র তিনি। খুব নামডাক তাঁর - যেমন গানের গলা, তেমনি বিতর্কে ঝড় তোলেন সর্বত্র। কিন্তু সেই সপ্রতিভতা কোথায় হারিয়ে যায় ঐ বেণী দোলানো তন্বীকে দূর থেকে দেখেই। ঐ দেখাটুকুই সম্বল ছিল মাস কয়েক ধরে। কী আর করা? গুটি কয়েক মেয়ে যারা কলেজে পড়ত, তারা কোথাও আড্ডা দিত না, একা চলত না ফিরত না পর্যন্ত। প্রফেসরস রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত তারা, যখন যাঁর ক্লাস তিনি সঙ্গে করে ওদের নিয়ে যেতেন; সোজা প্রফেসরের সঙ্গে ঢুকত, ফার্স্ট বেঞ্চে বসে পড়া শুনত, আবার প্রফেসরের পেছন পেছন বেরিয়ে যেত। আর ক্লাস শেষ হতেই ঢাকা দেওয়া ফিটন গাড়িতে চড়ে চোখের সীমানার বাইরে।
সত্যব্রত সেই ক' মাস নিজের ক্লাস না করে ওদের সবগুলো ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চ দখল করে বসে থেকেছেন। মেয়েটি বেরোতেই ঝট করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পেছন পেছন হেঁটেছেন। গাড়িতে ওঠার সময় নজরে পড়ে এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। এরই মধ্যে চার চোখের দৃষ্টিবিনিময় হয়নি যে তা নয়। সেই দৃষ্টি যে অত্যন্ত পেলব, লাজুক সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু " আরো কাছাকাছি " যাবার উপায় আর হচ্ছিল না কিছুতেই।
* * * * * * * * * *
কলেজ প্রিন্সিপ্যালের রুমে ডাক পড়েছে সেদিন ডাকসাইটে সত্যব্রতর। সেদিন পার্ট টু পরীক্ষার ফর্ম ফিল-আপের শেষ দিন। সত্যব্রত কোনোরকমে ফিইস জোগাড় করে এসেছে ফর্ম ফিলআপ করতে। কিন্তু তার আগেই এই তলব।
-- গুড মর্নিং স্যর।
-- হ্যাঁ, বোসো আগে।
-- কেন ডেকেছেন স্যর?
--- তুমি এবছর মাত্র ৪০% ক্লাস এটেন্ড করেছ? অথচ, আমি লক্ষ্য করেছি তুমি রোজ কলেজ ক্যাম্পাসেই থাকো। লাস্ট দুবছরে যেখানে তোমার হানড্রেড পারসেন্ট উপস্থিতি ছিল, এবার এই অবস্থা কেন?
--- মাথা নিচু করে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কী উপায় সত্যব্রতর?
-- আমি তোমার নাম ডিসকলেজিয়েট লিস্টে তুলে দিতে পারতাম! কিন্তু তোমার বাবাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, তিনি কত কষ্ট করে তোমার পড়ার খরচা টানছেন আমি তা জানি। তাছাড়া তুমি আমাদের গর্ব। একটা অসাধারণ ফল আশা করি তোমার কাছ থেকে আমরা। আমি নিজে রসকষহীন অঙ্কের শিক্ষক হলেও তোমার সাহিত্যের বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যে জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। বলো কী কারণে এই অধঃপতন?
--- একটা ঘোরের মধ্যে থেকে ঝটকা খেয়ে বেরিয়ে সত্যব্রত বলে উঠল," আমি পরীক্ষা দেব স্যর। কথা দিচ্ছি ভাল রেজাল্ট করব, করতে আমাকে হবেই স্যর। আপনি আমায় সেই সুযোগ দিন স্যর, নাহলে আর কোনোদিন পরীক্ষা দেওয়া হবেনা আমার।" - বলে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল সে।
* * * * * *
-- বাবা নাও এই হরলিক্সটুকু খেয়ে নাও তো। তারপর শুয়ে পড়ো, বাবা! অনেক রাত হবে ওদের ফিরতে। আমি জেগে আছি ততক্ষণ।
মেয়ে রিমার কথায় ঘোর ভেঙে তাকালেন সত্যব্রত, দৃষ্টিতে অপার শূন্যতা। বললেন," নাঃ খেতে ইচ্ছে করছে না কিছু। আর, এখনই শোবো না। আসুক আগে ওরা।
বলেই চোখ বন্ধ করে আবার এলিয়ে দিলেন মাথা।
অনার্স পার্ট টু র রেজাল্ট বেরোনোর পর তিনি সোজা যেদিন প্রিন্সিপ্যাল স্যারের বাড়ি যান দেখা করতে এবং কৃতজ্ঞতা জানাতে, সেদিন তাঁকে আপাদমস্তক অবাক করে দরজা খোলে তাঁর স্বপ্নের সেই তন্বী। তিনি যখন আক্ষরিক অর্থেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন, সে তখন অনায়াস সপ্রতিভতায় তাকে বলেছিল --- আসুন, বসুন, বাবাকে ডেকে দিচ্ছি আমি।
--- কপাল থেকে ঘাম ঝরছিল তাঁর... গরম তো ছিলই, তার ওপর এই চমক, সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ সত্যব্রত যন্ত্রের মতো বসে পড়েছিলেন চেয়ারে।
এরপর নানা রোম্যান্টিক দৃশ্যর অবতারণা হতেই পারত, থাকতে পারত নানা নাটকীয়তা, কিন্তু তার কিছুই ঘটেনি। স্যর নিজেই উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁর বিদূষী ছোট কন্যাটিকে প্রিয় ছাত্রের হাতে তুলে দিতে।
সত্যব্রতর আর ইউনিভারসিটি তে পা রাখা হয়নি, জুটে গিয়েছিল সরকারী মোটামুটি ভাল চাকরি, সুমিতাকে নিয়ে চলে আসেন এ পার বাংলায়, কলকাতার এক প্রান্তে ভাড়াবাড়িতে শুরু হয় তাঁদের সংসার। সুমিও পেয়ে যায় একটা চাকরি। দুজনে মিলে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলেন এক স্বর্গোদ্যান। তিন সন্তান কে মনের মতো করে মানুষ করা, যতদিন সত্যব্রতর বাবা মা বেঁচে ছিলেন তাদের নিজের হাতে সেবা করা, দুই ননদের বিয়েতে উজাড় করে নিজের গয়না দিয়ে তাদের সাজিয়ে দেওয়া - সুমি কী না করেছে! বরং সত্যব্রত নিজেকে অপরাধী ভাবেন, কারণ - সুমির যথাযথ আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য তিনি দিতে পারেন নি, খেটে খেটে প্রাণান্ত হতে হয়েছে তার। চোখে গ্লুকোমা হয়েছিল, সঠিক চিকিৎসার অভাবে দৃষ্টি এত কমে গিয়েছিল যে খবরকাগজের হেডলাইন ছাড়া আর কিছু পড়তে পারত না সে শেষ এই কিছু বছর। গান শুনতে ভালোবাসত, রাত জেগে রেডিওয় ক্লাসিকাল মিউসিক শুনত। কতবার ভেবেছেন, বড় মিউসিক সিস্টেম এনে দেবেন, বা ডোভার লেন মিউসিক কনসার্ট এ নিয়ে যাবেন অন্তত একবার, - হয়নি তা। কোনো অভিযোগ ছিল না সুমিতার। আজ নিঃশব্দে চলে গেল তাঁব হাত ছেড়ে কতদূরে। তাঁর পাশের বালিশটা পড়ে আছে...সকালে ওখানেই মাথা রেখে চলে গেল সুমি। এখনও তার গন্ধ রয়ে গেছে। বালিশটা বুকে জড়িয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন তিনি। রিমা কাছেই ছিল, সেও বাবাকে জড়িয়ে বুক খালি করে কাঁদে কিছুক্ষণ। বাবাকে বিছানায় শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কখন ঘুমে তলিয়ে যান সত্যব্রত, সুমিকে ছাড়াই কেটে যায় তাঁর রাত, এই ছাপ্পান্ন বছরে একদিনও যা হয়নি।
* * * * * *
আজ সুমিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। এ ক' দিন প্রতি মুহূর্তে সত্যব্রত চরম একাকীত্বে ভুগেছেন। ছেলেরা বৌমারা, মেয়ে জামাই ব্যস্ত হাজারো আচার আচরণ নিয়ে। তিনি বুঝতে পারছিলেন না মানুষটার অভাব বড় না ঐ আচার আচরণ? বারণ করেছেন ওদের, "এসব দরকার নেই, তোমরা দুদণ্ড বসো, মায়ের কথা ভাবো, আমার কাছে বসো, আমায় স্মৃতিচারণ করতে দাও, ঐ হবিষ্যান্ন, ঐ কৃচ্ছ্রসাধন, কোনো শ্রদ্ধা নিবেদনের পথ নয়, " - কিন্তু কেউ শোনেনি তাঁর কথা। তাদের কাছে সমাজ, সংস্কার অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে, আদ্যন্ত মানুষটার থেকে।
তিনি অসহায় বোধ করেছেন, খাবার রোচেনি, ঘুম হয়নি, চোখ বুজে কেবল ভেসে উঠেছে সুমির শান্ত মুখ, নির্ভরশীল দুটো চোখ, ভেঙে পড়া গাল আর প্রশস্ত কপালের লাল টিপ। লাল পাড় সাদা শাড়িই ছিল তার একমাত্র পছন্দের। কোনো দাবী ছিল না তার, তাইই বোধহয়, কোনো বেশি কিছুই দেওয়া হল না তাকে। এ অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে ছিল তাকে। গতকাল জ্বর ছিল গায়ে, ডাক্তার ডাকা হয়েছিল, ওষুধ না খেতে চাইলেও ওরা ছাড়ে নি, জোর করে খাইয়েছে, তারপর শুয়ে শুয়ে ছটফট করেছেন অনেকক্ষণ। খাবার গলা দিয়ে নামেনি। রিমা নিজের হাতে হরলিক্স বিস্কুট এনে খাইয়ে দিয়ে নিচে বিছানা পেতে শুয়েছিল।
সারারাত সত্যব্রত কাল সুমির সাথে কথা বলেছেন। সুমি সেই আগের মতো তাঁর মাথায় জলপটি দিচ্ছিল, খুব বকছিল, খাওয়া দাওয়া না করার জন্যে। তারপর তাঁরই পাশটিতে রোজ যেমন গুটিসুটি হয়ে শুতো, তেমনই শুয়েছিল। তিনি সুমির উষ্ণতা গায়ে মেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছিলেন।
সকালে সবাই ব্যস্ত স্নান সেরে ভাড়া নেওয়া হলে যাবার জন্যে। জিনিসপত্র গোছগাছ করে দুই ছেলে, বৌরা তৈরি, রিমা ঘরের সব পর্দা টেনে দিয়েছে যাতে সত্যব্রতর ঘুম না ভাঙে এই হৈ চৈ এ। কী ভেবে মশারী তুলে একবারের জন্য বাবার গায়ের তাপ দেখতে গিয়েই আর্তনাদ করে উঠল সে। শরীর সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা। সবাই দৌড়ে এল। স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় তারা। তীব্রস্বরে কান্নাও আছড়ে পড়ছে না কারোর কণ্ঠে।
রাত্রে কথা বলতে বলতেই সুমির হাত ধরে অচিন দেশে পাড়ি দিলেন সত্যব্রত। আর একাকী নন তিনি। একাকীত্বকে বড় যে ভয় ছিল তাঁর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴