সকালে ঘুম ভেঙে বিছানায় শুয়ে অনন্যা দেখতে পাচ্ছে জালনায় আলো ভরে আছে। বিছানা থেকে নেমে পর্দা সরিয়ে বাড়ির জানলাগুলো সব খুলে দেয়। বাইরে ঝলমলে আলো। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েক দিন বৃষ্টির পর আজ রোদ উঠেছে। আকাশটা অপূর্ব লাগছে। ঠিক যেন পুজোর আকাশ। দিগন্ত জুড়ে শুধু নীল। তুলোর মতো হালকা সাদা মেঘের ছোট্ট স্তুপটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে কার যেন হাসিমাখা মুখ। মনে পড়ে গেল ছোট্টবেলায় ঠাকুমার পাশে শুয়ে রূপকথার গল্প, রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে জানলা দিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকার দিন গুলো। আকাশে মেঘের মধ্যেই দেখতে পেত রাক্ষস খোক্ষস কখনো মেঘনাদ কখনো শিব ঠাকুর কখনোবা পরি। মায়ের কাছে বকুনি শুনে অভিমান হলেও জানলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তো। ছোটবেলার স্মৃতিমেদুর এলোমেলো কথা মনে পড়ে ভেতরে ভেতরে বেশ খুশি খুশি লাগছে। এমনিতেও শরৎকাল অনন্যার খুব রোমান্টিক লাগে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে অনন্যাকে গম্ভীর দেখে ইন্দ্রনীল জিজ্ঞেস করে
"তোমার ছেলের সাথে কথা হল? কবে আসছে?"
অনন্যা আরো গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয়
"আসছেনা।"
"কেন? পরীক্ষা-টরীক্ষা আছে নাকি?"
"আছে, দশমীর এক সপ্তাহ পর।"
"বাড়িতে বসেও তো পড়তে পারে।"
"বাড়িতে নাকি ওর পড়া হয়না। তাই এবার আসবে না।"
গিন্নীর মন ভার দেখে ইন্দ্রনীল বলে
"চলো আমরাই এবার ছেলের কাছে যাই।"
অনন্যা কোন উত্তর দেয়না।
"ব্যাঙ্গালোরের টিকিট কাটবো? যাবে? কয়েকদিন ঘুরেও আসা যাবে।"
"তুমি তো জানো পুজোর দিন গুলো আমার বাড়িতেই থাকতে ভালো লাগে। ওখানে পুরোপুরি অবাঙালি পরিবেশ। ভালো লাগবে না।"
অনন্যা জানে পুজোর সময় ছেলে না এলেও খুব ফাঁকা লাগবে বাড়িটা। কী যে করবে বুঝতে পারছে না। গলায় আরো অভিমান মিশিয়ে বলে
"ছেলেটা দিন দিন কেমন যেন ছাড়া ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। পুজোয় বাড়িতে মা বাবার কাছে আসতে ইচ্ছে করে না!"
ইন্দ্রনীল সান্ত্বনা দেয়
"মন খারাপ করছ অনু? যুগটা এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। তোমার তো খুশি হবার কথা, ছেলে পড়া ছেড়ে আসতে চাইছে না। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। আমাদের যুগ আর নেই যে পুজোর একমাস আগে থেকে সবকিছু বাদ দিয়ে পুজো নিয়ে মেতে থাকবে।"
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাবে ওরই বা কী দোষ। ছোটবেলায় আয়া মাসির কাছে, আরেকটু বড় হলে একা রেখে আমরা দুজন জীবিকার তাগিদে বেরিয়ে যেতাম। ওকে কতটুকু সময়ই বা দিতে পেরেছি। মা বাবা ছাড়া একা থাকতেই বেশী অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছোট থেকে শুধু পড়াশোনায় উৎসাহ দেখিয়েছি। পুজোর সময় হাত ধরে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যেতাম, পুজো প্যান্ডেলে কখনো ইনভল্ভ হতে দেইনি পাছে পড়ার ক্ষতি হয়। পড়া পড়া করে ছেলেটাকে সব সূক্ষ্ম আনন্দ অনুভূতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। এখন সে আমাদেরও ভুলতে বসেছে। অনন্যার বুক ঠেলে কান্না আসছে।
দেখতে দেখতে মহালায়া পার করে আজ ষষ্ঠী। সন্ধ্যাবেলায় পুজো মণ্ডপে ঢাকে কাঠি পড়ছে। চারদিকে পুজো প্যান্ডেলের আলোয় আলোকিত, দুরের গান ভেসে আসছে, লোকজন বেড়িয়ে পড়েছে। চারদিক একেবারে সাজো সাজো রব। কিন্তু আজ প্রদীপের নিভু নিভু আলোর মত অনন্যা-ইন্দ্রনীলের আন্তঃস্থলের সলতে পুড়ছে।
পরদিন ভোরবেলায় ডোরবেলের শব্দে অনন্যা ঘুম চোখে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। ইন্দ্রনীল দরজা খুলে অবাক! উচ্ছ্বসিত হাসিমাখা মুখে বাবাকে জড়িয়ে ছেলে বলে
"সারপ্রাইজ! মা কোথায়?"
ছেলের গলা পেয়ে অনন্যা তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে আসে।
"কিরে, চলে এলি? শরীর ঠিক আছে তো?"
"উঃ মা, শরীর ঠিক থাকবে না কেন? পুজোর দিনগুলো তোমাদের সাথে থাকতে ইচ্ছে করছিল। ভালো লাগলো না তাই চলে এলাম। খেতে দাও তো, খুব খিদে পেয়েছে।" ইন্দ্রনীল অনন্যাকে আড়চোখে দেখে। অনন্যা মনে মনে ভাবছে ইস্ ছেলেটাকে কি ভুল ভেবেছি।