পাহাড়ের নিচে, এক সবুজ পাতার দেশে/শিঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়
পাহাড়ের নিচে, এক সবুজ পাতার দেশে
শিঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়
--------------------------------------------
জলপাইগুড়ি জেলার তিস্তা নদীর পূর্ব পাড় থেকে সংকোশ নদীর পশ্চিম পার পর্যন্ত এলাকা ডুয়ার্স নামে পরিচিত। ডুয়ার্স শব্দটির অর্থ দুয়ার বা দরজা। ভুটান থেকে হিমালয় পর্বত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে হলে মোট আঠেরোটি দরজা পেরোতে হয়। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে রিনরিনে আওয়াজ তুলে বয়ে চলা নদী, ঘন অরণ্য, নীল পাহাড় দিয়ে ঘেরা সবুজ চা বাগান ডুয়ার্সের অন্যতম আকর্ষণ।
আমার
নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় কারণ আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, এমনকি কর্মস্থল ও এই ডুয়ার্স। দৈনন্দিন জীবনের যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে এক হেমন্তের সকালে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক হল যেখানে ক্লান্ত লাগবে সেখানে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেব। যদিও প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্য ক্লান্তিকে হারিয়ে দেয়। বীরপাড়ার মেইন বাজার থেকে বেরিয়ে ডান দিকে বেঁকে দুপাশে চা বাগানের বুক চিরে যে পাকা রাস্তাটা চলে গেছে সেটা ধরে আমরা এগোচ্ছি। ভোরের হাল্কা কুয়াশার চাদরে মোড়া চা বাগান কেমন যেন রহস্যময়। লঙকাপাড়া, তেলিপাড়া, মোরাঘাট বাগান পেরিয়ে আমরা ডায়নার কাছাকাছি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার চাদর সরে গিয়ে সাদা মেঘরাশি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুটোপুটি খেতে শুরু করেছে। ডায়না পেরিয়ে আরোও খানিকটা এগিয়ে সোজা রাস্তা চলে গেছে মালবাজার এর দিকে। আমরা তো অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেব বলেই বেরিয়েছি, আমরা ডানদিকে টার্ন নিলাম। খানিক দূর যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম যে আমরা জলঢাকার দিকে এগোচ্ছি। এত বছর চা বাগানে থাকার ফলে কোনো রাস্তাই আর অচেনা নেই। দুইপাশে গভীর অরণ্য। গা ছমছমে পরিবেশ। হঠাৎ করে নিস্তব্ধতা ভেদ করে কানে আসে কোনো পাখির আওয়াজ। খানিকটা এগোনোর পর পেছনে তাকালে বোঝা যায় আমরা কতটা ওপরে উঠেছি। যত ওপরে উঠছি, নৈঃশব্দ্য আরও গাঢ় হচ্ছে। অরণ্যের একটা নিজস্ব সঙ্গীত আছে যেটা শোনা যায় না, অনুভব করা যায়। "Heard melodies are sweet, but those unheard are sweeter."
আমরা ঢুকে পড়েছি কুমাই চা বাগানে। চা বাগানের সৌন্দর্যে পাগল হয়ে নেমে পড়লাম। যদিও ক্লান্ত হলে নামার কথা ছিল। নীল আকাশের কোল ঘেঁষে পাহাড়ের সারি। তার নীচে সবুজ গালিচা পাতা চা বাগান। থরে থরে সাজানো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। নীচ থেকে অনেক ওপরে কটেজ মতো দেখা যাচ্ছে। ঠিক করলাম ওখানেই যাবো। সরু পিচের রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠেছে। চারপাশে রঙিন ফুলের ছড়াছড়ি। ওপরে গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা বিল্ডিং, নাম 'আতিথ্য'। দোতলা বিল্ডিং, একতলায় তিনখানা ঘর। অতিথিদের থাকবার জায়গা। সুন্দর বাঁশের আসবাব দিয়ে সাজানো কামরাগুলো। দোতলায় খাওয়ার ব্যবস্থা। আমরা একদম খোলা ছাতে এসে বসলাম। নরম রোদ আর শিরশিরে হাওয়া শীতের আগমন বার্তা নিয়ে আসছিল। 'আতিথ্য' র মালিক রামপ্রসাদ আন্তরিকতায় ভরপুর একজন মানুষ। হাসি মুখে, হাত জোড় করে আমাদের বললো, "তপাই খাজা মা কে খান চাহানুহুনছ?" ব্যবহার দেখে মনে হবে আমরা কোনো নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। খাবার অর্ডার করে ছাদ থেকে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর বুকে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। সাদা একদল মেঘ ভারত থেকে ভুটানের দিকে যাচ্ছে। আবার একদল মেঘ ভুটান থেকে ভারতের দিকে আসছে। যাতায়াতের পথে মেঘবালিকার দল একে অপরের গায়ে লেগে কি যেন বলাবলি করছে। পাহাড়, নদী, মেঘ, চা পাতা, রঙিন ফুল মিলে সে এক অসাধারণ কোলাজ। দেখে যেন আশ মেটে না। এরইমধ্যে রামপ্রসাদ দুপুরের খাবার নিয়ে হাজির। অন্য মানুষদের খুশি করার দায় সে নিজের কাঁধে নিয়েছে কোনো হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট কোর্স ছাড়াই। আর অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে সেটা সামলাচ্ছে। এই অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও ওর মুখের হাসিটা কিন্তু অমলিন।
'আতিথ্য'র কুকের রান্না মুখে লেগে থাকার মতো। ওর হাতের চাটনি খেতে আমাকে আরেকবার আসতেই হবে। খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে রামপ্রসাদকে বললাম, "তপাইকো আতিথ্য সতকারকো লাগি ধন্যবাদ।" প্রত্যুত্তরে আমাদের অনেকগুলো ফুলের চারা উপহার দিয়ে একগাল হেসে রামপ্রসাদ বললো, "ফেরি আওনুহোলা"। এই আন্তরিকতা, এই উপহার অমূল্য। গাড়ি যখন স্টার্ট নিচ্ছে দেখলাম সূর্য চারপাশে সিঁঁদূর রঙ ছড়িয়ে দিন শেষের জানান দিচ্ছে। একমুঠো ভালোলাগা, একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আবার ফিরে চললাম প্রাত্যহিক জীবনে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴