নগেন ও একটি জলাশয়
নগেন ও একটি জলাশয়
জয়িতা রায় চৌধুরী মল্লিক
~~~~~~~~~~~~~~~
দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল নগেন। গভীর রাত। বাইরে ঘুটঘুটি অন্ধকার। নিঃস্তব্ধ চারদিক। থেকে থেকে বসন্তের উতলা বাতাসের শনশন আওয়াজ নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও। নদীর কাছাকাছি এই এলাকায় মোটে কয়েকঘর লোকের বাস। অভাব অনটনের সংসার সকলেরই। সারাদিনের খাটুনির ক্লান্তিতে আর কুপির কেরোসিন শেষ হয়ে যাবার আতঙ্কে সন্ধেরাতেই সকলে দুটো খেয়ে, শুয়ে পড়ে। তাছাড়া একবার ঘুমিয়ে পড়তে পারলে অন্ততঃ বেশ কয়েকঘন্টা অভাবকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। কিন্তু সেই নিশ্চিন্তের ঘুমটুকুও আজ বেশ কদিন ঘুমোতে পারছে না নগেন। অন্ধকারেই ধীর পায়ে বিলটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। এই বিলই ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস। সেই বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকেই এই বিল তাদের পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিল। নদী থেকে খাল বেয়ে জল এবং প্রচুর মাছ আসত এই বিলে। সেই মাছ ধরে বাজারে নিয়ে বিক্রি করেই তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছিল। ছোটবেলায় বাবার সাথে নগেনও আসত মাছ ধরা দেখতে। জাল ছুঁড়ে ফেলতেই জলের মৃদু আলোড়ন মুগ্ধ করত নগেনকে। এছাড়া বাবার জাল ছোঁড়ার ভঙ্গীটিও ভীষণ উপভোগ করত সে, পরবর্তীতে সে নিজেও সেই ভঙ্গী নকল করার চেষ্টা করেছে, বহুবার, কিন্তু কিছুতেই তা রপ্ত করতে পারেনি। বন্ধুদের সাথে এই বিলের জলে শরীর ডুবিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত নগেনের। এভাবে সেই ছোটবেলা থেকেই এই বিলের সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল তার। নদী থেকে জল বয়ে আসার খালগুলো বুজে গিয়ে বড় বড় সব ফ্ল্যাট উঠেছে এখন। বিলে জল আসার পথ বন্ধ করে দিয়ে আকাশ ছোঁয়া মানুষগুলো ঐসব ফ্ল্যাটে নিশ্চিন্তে, আরামে বাস করছে! এককালে জলভরা বিল আজ তাই শুকনো খটখটে। বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা মোচড় দিয়ে উঠল নগেনের। এই বিলটাকে কখন যে এত ভালবেসে ফেলেছে, সে নিজেও টের পায়নি। আজ এই বিরাট শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জলাশয়টি যেন ওর গুরুত্ব বেশি করে টের পাইয়ে দিচ্ছে নগেনকে। ওর ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা তো এই বিলটিকে ঘিরেই। ভীষণ মন খারাপের সময়গুলোতে এই বিলের ধারে এসে বসত নগেন। ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়ার ছোঁয়ায় সব মন খারাপ দূর হয়ে যেত তার। জীবিকা নির্বাহের নির্ভরতা ছাড়াও এই বিলটি একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল নগেনের বুকে, সেকথা যেন আজ বেশি করে অনুভব করতে পারছে সে। বিলটির, এই থেকেও না থাকার সাথে বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে নগেনের। এদিকে হাওয়ার বেগ হঠাৎ প্রচণ্ড বেড়ে ওঠায় নগেন টের পেল, ঝড় আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল বিদ্যুৎ চমক আর ঘন ঘন মেঘ গর্জন। বিদ্যুতের আলোয় শুকনো বিলটা চকচক করে উঠল। এক ঝলক আলোয় নগেনের মনে হল বিলটা যেন ডাকছে তাকে। নেমে গেল সে বিলের বুকে। একটু এগোতেই আচমকা তার পা আটকে গেল লুকানো জলের চোরা স্রোতে। টের পেল, ধীরে ধীরে বিল তাকে তার বুকের ভিতরে টেনে নিচ্ছে। একবারও বাঁচার চেষ্টা না করে, বিলের বুকেই, চোরা স্রোতে নিজেকে সঁপে দিল নগেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴