সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

ধুয়ে যাওয়া অক্ষর/মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

ধুয়ে যাওয়া অক্ষর
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
===================

সকালের জানলা খুললেই একঝাঁক রোদ্দুর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাখিদের রাজত্ব তখন। এ ছাদের রঙিন ডালিয়া ও ছাদের নতুন ডালিম পাতা, লাল ফুল, আমের ডালে নতুন মুকুলে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ আর এ কাচের জানলায় ওদের সবটুকু বিশ্রাম। বুলবুলি, দোয়েল, চড়ুই।জানলার হু হু মন উদাসী বাতাস শরীরে মেখে নেয় পঞ্চমী ওদের মতোই। যদিও ঠান্ডা চলে যাওয়ার আগে শিরশিরিনি অনুভূতি জ্বরো ভাব জাগায় গলার কাছে কিংবা মাথা ভার হয়ে আসে তবু...ওরে বসন্ত আমি বসন্ত ছুঁয়ে মরি। আজকের রোদ্দুর এসে পড়ল হলদে আর সবুজ টানের শাড়িটার উপর। অসংখ‍্য ছবি যেন। সে বছর বসন্ত গানের উৎসবের রিহার্সাল জমে উঠেছিল পাড়ার মোড়ে ঈশানদের বাড়ী। ঈশান আর বিষাণ দুই ভাই।ওদের মা পঞ্চমীদের চোখে সে সময়ের আধুনিকা নম্বর ওয়ান। বাড়িতে দু'ভাই ছাড়াও দুই দিদি।অদ্ভুত গলার স্বর। সুরেলা আর মন্দ্র সপ্তক, মধ‍্য আর তার সপ্তকে অপূর্ব খেলে ওদের কন্ঠ।সে বয়সটাই এমন সবকিছুতেই মুগ্ধ হওয়ার পালা।
পাড়ায় লেগেই থাকত সেই পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করে বর্ষবিদায় পর্যন্ত চৈত্র তপনের নানা অনুষ্ঠান। সঙ্গে স্কুলও সঙ্গত করত বটেই। ক্ষুদে এক মানুষকে কি করে এক বৃহৎ রাজ‍্যের কারিগর বানিয়ে দেওয়া যায় তা পঞ্চমীদের স্কুল এক উদাহরণ। সদ‍্য ভাষা দিবসের রেশ ফুরিয়েছে কি ফুরোয়নি, নাটকের রিহার্সাল চলছে রবীন্দ্রনাথের"বসন্ত"এর। গীতিনাট‍্যের সঙ্গে নৃত‍্য সহ বড় প্রিয় হয়ে উঠেছে রিহার্সালের সময়গুলো। ঈশান আর বিষাণ দুজন মিলে আবার 'ঝর ঝর ঝরে রঙের ঝরনা' গানটা শিখছে ওদের মার কাছে। ছোট একতলা বাড়িটা পঞ্চমী আর পঞ্চমীর বন্ধুদের কাছে কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন। পঞ্চমীও গান শেখে, গানের মাষ্টারমশাই আসেন ওর, কিন্তু ঐ বাইরের খেলা ফেলে মোটেও সারেগামা সাধতে বসতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মার ভয়ে শনিবার করে বাইরে খেলা বন্ধ। চারটে না বাজতেই মাষ্টারমশাই একেবারে দরজায়। পঞ্চমী বসন্তে নাচের দলে। কখনো আমের মঞ্জরী, আবার উদাস হাওয়া। বসন্ত পথিকের ভূমিকায় মোনা। ঈশান বিষাণের ছোড়দি। বড়দি বকুল খুব আসে না রিহার্সালে। পড়া নিয়ে ব‍্যস্ত। কখন যে সদ‍্য কৈশোরের দিনগুলোয় ওরা সবাই বন্ধু হয়ে এপাড়া ওপাড়ায় পাতা আনা খেলার সঙ্গী। চোর বনে গিয়ে কোন জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া। এই একা আর একসঙ্গে হারিয়ে গিয়ে কিছু ভাল লাগা মুহূর্ত ভীড় করে থাকে। আর ঈশান, বিষাণের দুষ্টুমী ভরা ভালোলাগা বন্ধুদের মধ‍্যে ছড়িয়ে গিয়ে ওদের দল আরও মজবুত হয়ে উঠেছে।বিশেষ করে গান বাজনা যেন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে ওদের বাড়িকে ঘিরে। পঞ্চমী বেশ বোঝে ওদের বাড়ি গেলেই মাসি সেদিন বানানো সবচেয়ে ভাল খাবারটা তাকে দেবেন। পঞ্চমীও আহ্লাদে আটখানা যেন।খোলা উদাস প্রকৃতিকে এতই ভালোবেসে ফেলেছে ওদের দল যে কোথায় কোন গাছ কোন সময় কোন ফুল, নদীর ধারে ভাঁট ফুল ধুতরোর নাড়ী নক্ষত্র জেনে গেছে।ভূতচতুর্দশীতে, শিবপুজোয় কিংবা বৈষ্ণব কীর্তনে মহোৎসবে কি কি রীতি, ধর্মীয় আচার সব জানা। কি কি ফুল দরকার সব যোগাড় করে ওরা প্রস্তুত। প্রকৃতির নানা পরিবর্তন, রূপ, রঙ সব চিনে চিনে ছুঁয়ে বড় হয়ে ওঠা পঞ্চমীর। ঈশান বিষাণের দুষ্টুমীর আড়ালে পঞ্চমীর মন ঐ বাড়িটায় গানে গানে ক‍্যারাম খেলার খুট খুট শব্দ আর পুতুল বিয়ে এবাড়ি ওবাড়ি...কি যে গেঁথে যাওয়া ছবি। খেলার মাঝখানে বিষাণ কতদিন পঞ্চমীর দুটো হাত আগলে ধরে চুপ করে থাকে, তখন কোথায় তলিয়ে যায় সূর্য আলোর অস্ত রঙ, হাত ছেড়ে ছুটে যায় বাড়ির দিকে। বুকের ভিতর ধুকপুক শব্দটা পঞ্চমী টের পায়। ঈশান কোনো কোনো দিন সন্ধে নামার আগেই বিষাণকে হাত ধরে নিয়ে যায়।পঞ্চমীর শরীর মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে ভয়ে না আনন্দে বোঝে না সে।
     কখন শৈশব কৈশোর পেরোয়, বন্ধু মুখ ঝাপসা হয়, দূরত্ব বাড়ে। খেলাগুলো বদলে যেতে থাকে। মায়ের পাহারা আর ঘেরাটোপে মন্দ্র গম্ভীরে পঞ্চমী গায় 'যদি তারে নাই চিনি গো সেকি...' অথবা 'বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'
পৃথিবীতে কত কি বদলে যায়! মানুষ বদল, স্বভাব বদল, মন বদলের পালা। সে ছবিগুলো পঞ্চমী এই কাচের জানলার জলছবিতে মিলিয়ে নেয়। ওদের বসন্ত উৎসবের ঠিক পরের বছর, ঠিক এইরকমই পাতা ঝরছিল সেদিন। অনেকদিন বন্ধুরা একসঙ্গে হয় না। দৌড়ে খেলার পাটও কেমন চুপচাপ, হঠাৎ কে যেন বড় হয়ে যাওয়ার ফরমান দিয়েছে।... এমনি হঠাৎ কে যেন ফিস ফিস বলল কানে, 'জানিস, বিষাণরা আজ চলে যাচ্ছে। ওদের বাড়ির সামনে লরি দাঁড়িয়ে ...'। পঞ্চমীর হালকা পাখির মতো বুক সে ফিস ফিস খবরে আছড়ে পড়েছিল কিনা এখন আর মনে করতে পারে না। তবু বসন্ত এসে দাঁড়ালে সেও গিয়ে দাঁড়ায় সেদিনের মতো নিজের বাড়ির রোয়াক ছেড়ে ওদের খেলার মাঠের কাছে।সেখান থেকে দু পা হাঁটলেই দেখতে পায় সাদা একতলা বাড়িটার দরজায় রাস্তার উপর বড় লরি। তাতে অজস্র জিনিস। হ‍্যাঁ ওদের খেলার বড় ক‍্যারাম বোর্ডটাও কাগজে প‍্যাকিং হয়েছে। দাঁড়ানো ছোট গাড়িটায় ওদের বাড়ির লোকজন। লরিটা ধূলো উড়িয়ে সব ঝাপসা করে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।পাড়ার মানুষের সঙ্গে ওদের প্রকৃতিগত প্রভেদ ছিল বলেই বোধহয় ওদের উঠে যাওয়া শহর, ঠিকানা পঞ্চমী বা অন‍্য বন্ধুরা কেউ খবর রাখেনি। শুধু জেনেছিল ওদের বাবা যে শহরে চাকরি করে সেখানে চলে গেছে ওরা। এখানকার পাট চুকিয়ে। পঞ্চমীর গলার কাছে এসে ঠেকেছিল কেমন অভিমান। বন্ধুত্বের সুতোটা তো বেশ মজবুত হয়ে উঠছিল তাহলে ওদের দলটার বয়স কয়েকবছর বেড়ে গেছে বলে মনের সুতোও ছিঁড়ে ফেলতে হবে! মনের ভিতর সেদিন পাক খেয়েছিল বসন্ত উৎসবের আবীর ছোঁয়া রামধনু। অদ্ভুত পা মিলিয়ে হেঁটে চলা, হলদে শাড়ির আঁচল বিষাণের আঙুলে বেঁধে নেওয়া... সব লুকোনো অনুভূতি।
*   *   *
তারপর! কত গ্রীষ্ম, কত প্রিয় বর্ষায় বৃষ্টি জল আর মেঘে ধুয়ে গেছে কথা কাহিনী। কত কচি মুখে কি তীব্র যাপনের ইতিহাস ভেঙে ভেঙে টুকরো কথা লিখে যায়। মুখের প্রতি ভাঁজে জমে ঘাম রক্ত আর বয়সের সাতকাহন।কাছের মানুষের নিত‍্যদিনের চলন অভ‍্যেসে জীবন হেঁটে যায়। নানা সমাজ শিক্ষা, নীতি শিক্ষায়,অভিজ্ঞতায় এক একজন স্বতন্ত্র মানুষের কথা তৈরি হয়।
সেদিনও ঠিক এমনই লালচে শুকনো পাতা গড়িয়ে যাচ্ছিল কলেজ গেট পার করে।পঞ্চমী প্রফেসরস্ রুম থেকে সদ‍্য তৈরি করা নোট কারেকশন করে করিডর দিয়ে হেঁটে ক্লাসরুম থেকে ব‍্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। ক্লাস শেষ, ঘড়িতে সাড়ে চারটে। ফিরতে হবে, হাঁটার গতি সবে বেড়েছে।
ক্রিং ক্রিং আর চাকা ঘষে যাওয়ার শব্দে থমকে দাঁড়িয়েছিল। ডবল বাইক করছে সাইকেলে ঋভু। সামনে এ কে! রুক্ষ, শুকনো চোয়ারে চেহারা ছেলেটার। পাতলা গোঁফ, গোঁফের আড়ালে অল্প হাসি... হাসবে কিনা ভাবছে...  ঋভু পঞ্চমীদের বাড়ির উল্টো দিকেই থাকে। ওই বলে- চিনতে পারছিস না তো! পঞ্চমীর চোখে অজস্র বিস্ময় আর অস্বস্তি। 'বিষাণ'।
বসন্তের পাখিটা কি ডেকেছিল! পঞ্চমী জানে না। ঋভুই বলে যায়, ও মামাবাড়ি এসেছে কলকাতা থেকে, তোকে দেখতে চেয়েছিল তাই এনেছি।
জীবনের হিসেব মেলেনি কোনোদিন। দশ বা পনেরর ব‍্যবধান কত অপরিচয়ের অন্ধকারে ডোবে। মনে পড়ে এর আগেও ঋভু পঞ্চমীর হাতে টুকরো কাগজে 'বিষাণ পাঠিয়েছে' বলে ভাঁজ করা কাগজের টুকরোর কালো অক্ষর গুঁজে দিয়েছিল। উত্তরও চেয়েছিল। খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়নি তা নয়। ঠান্ডা হয়ে আসা হাতের মুঠিতে ঐ ভাঁজ করা কাগজের প্রতিটি অক্ষর এখনো ছবি। পড়েনি, পড়তে চায়নি। লুকিয়ে টুকরো টুকরো হয়েছে সে কাগজ, ভেসেছে বড় শেওলা ধরা যৌথ বাড়ির বাথরুমের বড় চৌবাচ্চার জলে। ঠিক ছোট ছোট বানানো কাগজের নৌকোর মতো। সময়ই বাতাসে ভাসিয়ে দেয় সব। সে টুকরো অক্ষরের মতো পঞ্চমীও সাইকেলের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল দ্রুত বড় রাস্তায়।
পিছনে অচেনা স্বর "শুধু দেখে গেলাম"
বসন্ত বাতাস ঠিক এমনি এখনো কাচের জানলায় ঝাপটে মরে। পঞ্চমীর হলদে আঁচল আরও পুরোনো হয়। বাতাসে রঙিন পাতারা আজও উড়ে এসে বারান্দায় কী কথা যেন বলে....

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri