দেবীঘট
দেবীঘট
সঙ্গীতা মোহান্ত
----------------------
উত্তর কোলকাতার একটা ঘিঞ্জি এলাকায় আমার শ্বশুরবাড়ি। বাড়িতে গা ঘেঁষাঘেষি করে আমার স্বামীর ভাগের একটি ঘর, সেখানেই স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে আমার বাস। তবে মেয়ে একটু বড় হবার পর, রাত জেগে পড়াশোনা করে, অসুবিধে হয়। তাই আমাদের ঘরের পাশে যে ছোটো বারান্দাটা ছিল, বাড়ির সবাইকে বলে তিনপাশটা দেওয়াল দিয়ে ঘিরে মেয়ের থাকার মতো একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আমার স্বামী। উনিশ - কুড়ি বছরের আগুনের আঁচ, সাংসারিক আঁচ মিলেমিশে আছে আমার সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে ।
এমত আমি যখন প্রসিদ্ধ এক দোকানে গিয়ে বলেছিলাম, আমাকে দেবীঘট দেখান, ওরা একটা ছোটো তাম্র দেবীঘট নিয়ে এসেছিল। চোখে মুখে অহংকার নিয়ে বলেছিলাম, দূর্গাপূজোর ঘট। বড় ঘট আনুন। মনে মনে ভাবছিলাম, দোকানে সবাই ভাবছে আমাদের বাড়ীতে দূর্গাপূজো হয় ।
কৈশোর পেরোতেই আমার কেমন একটা অদ্ভুত রকমের স্বপ্ন কাজ করত মনের ভেতর। বিরাট এক সাবেকি বাড়িতে আমার বিয়ে হবে, বড় বউ হব আমি সেখানে। দূর্গাপুজো হবে বাড়িতে। সবাই আমাকে "গিন্নী মা" বা "বড় বউরানী মা" বলে ডাকবে ---। মানে, সিনেমায় সব দেখি যেমন। সাধারণ মেয়ের অন্তহীন আকাশকুসুম কল্পনার পরম্পরা আজ থেকে নয়। সেই রবিঠাকুরের আমল থেকে চলছে।
এক নগণ্য পরিবারের মেয়ে আমি। কি করে হবে সেই স্বপ্নপূরণ !
তাই আমার যেমন বিয়ে হওয়া উচিত, তেমনি হল। শ্বশুর শাশুড়ি দেওর ননদ নিয়ে ছাপোষা একজন সরকারী কেরানীর সাথে। সেখানে আর পাঁচটা এই ধরণের মেয়েদের বিয়ের পর যেমন জীবন কাটে, তেমন ধারাতেই বয়ে চলেছি আমি। মন পাওয়ার চেষ্টা, সংসারে অসম্মানিত হওয়া, শ্বশুরবাড়ির লোকেদের নানারকম কটূক্তি অবলীলায় হজম করে রাতে শুতে যাওয়া, আবার পরদিন সকালে সব ভুলে স্নান সেরে ঠাকুরের আসন দিয়ে চিত্তশুদ্ধি করে সংসারের কাজে লেগে পড়া। আবার কখনো কোনো একবার হয়ত জোর করে নিজের মতামতকে গ্রাহ্য করা বা অন্যকে গ্রাহ্য করানো।এমনি সাধারণ সব ঘটনাবলী দিয়ে আবৃত আমি ।
পরিবারের আত্মীয়-স্বজন, স্বামীর কিছু বন্ধুর স্ত্রীদের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে চলা বা মাঝেমধ্যে তাদের বাড়িতে যাতায়াতের সাথে সাথে দু - একটি ধনী পরিবারের সাথে জীবনের কোনো এক বাঁকে এসে পরিচয় হওয়া। কোনো অনুষ্ঠানে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পাওয়া এবং দশটি চেনাজানা মানুষকে জানান দিয়ে সেই বড়লোক বাড়িতে রওনা হওয়া ।
দূর্গাপুজোও হয় সেই চেনা -পরিচিত ধনীদের এক বাড়িতে। আমি চেয়ে - চেয়ে দেখি সে বাড়ির বউদের। গয়না শাড়ী পড়ে তারা ঘুরে বেড়ায়। তদারকি করে পুজোর কাজে, আবার অতিথিদের সাথে কেমন হেসে গল্প করে ঘুরে ঘুরে! যত্ন - আত্তি করে কত লোকজনকে খাওয়ান তারা ফি বছর ।
সপ্তমী থেকে দশমী প্রতিদিন যাওয়া তাদের বাড়ি। তবে প্রতিবার যে চারদিনই যাই, এমন নয়। দশমীতে বিসর্জনের দিন যখন ওদের সাথে হেঁটে যাই, ঐ বাড়ির অনতিদূরে বড় একটি পুষ্করিণীর দিকে; চারিদিকে ধুনুচির ধোঁয়া, ঢাকের আওয়াজ, বাড়ির ছেলেপুলেদের নাচ - তারমধ্যেই প্রতিবার, বার - বার আমার চোখ চলে যায় ঐ বিশাল দেবীঘটের দিকে।
বাড়ির ষাটোর্ধ্ব বড়ছেলে ঐ বিশাল জলপূর্ণ ঘটকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছেন প্রতিমা বিসর্জনের পথে, প্রতিমার সাথে, বাড়ির নিয়মে। বিসর্জনের পর তিনি ঐ পুষ্করিণীতে অবগাহনে করে, আবার বিসর্জনের জল ভরে সেই দেবীঘট নিয়ে একইরকম ভাবে বাড়িতে ফেরেন। স্নেহময় বড় দাদা। আমার বড় শ্রদ্ধার মানুষ। আমারও দাদা। ভালোবাসেন উনি আমাকে। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। আবার হয়ত এমনও হতে পারে, উনি হয়ত সবার সাথে এমন ভাবেই চলেন। আমিও তার মধ্যে একজন। আসলে বিয়ের পর আমরা সাধারণ মেয়েরা এমন ভাবে একটা শিকড় বর্জিত জীবন যাপন করি! তাই যদি একটা টানা কাল ধরে কেউ আমাদের সাথে স্নেহের সুরে কথা বলেন বা ভালো ব্যবহার করেন, আমরা স্থির সিদ্ধান্তে চলে আসি বা ভেবে নিই, সে আমাকে "ভালোবাসে"।
সেবার দশমীর দিন বাড়িতে ফিরে রাতে শোবার সময় স্বামীকে বললাম --- ওদের বাড়ির দেবীঘটটা বড্ড বড়, তাই না গো ! দাদার বড় কষ্ট হয়। সম্পূর্ণ মুখ কেমন লাল হয়ে যায়, দেখেছো !
আমার কথায় আমার স্বামী একমত হলেন।
বললাম --- দাদা বলছিলেন এবার ঘটটা পাল্টাতে হবে। একটু ছোটো আনতে হবে ।
আমার স্বামী বললেন --- শুনেছি।
আমার স্বামী খুব অল্প কথার, আবেগবিহীন মানুষ। আনন্দ পেলেও বোঝা যায় না, কষ্ট পেলেও বোঝা যায় না ।
এবার আমি ওনার গা ঘেঁষে বসে বললাম --- শোনো না, আমরা তো এত বছর ধরে ঐ বাড়ির পুজোতে খালি হাতেই যাই ।
আমার কথায় উনি অবাক হয়ে বললেন --- খালি হাতে যাবো নাতো, কি নিয়ে যাবো!
বললাম --- না মানে আমি বলছিলাম যদি, পরের বছর আমরা একটা দেবীঘট দিই, আরেকটু ছোটো ! দাদার একটু কম কষ্ট হবে গো। দুদিন আগে গিয়ে দিয়ে আসব !
উনি আঁতকে উঠলেন --- না - না ওসব করতে যেওনা। তাছাড়া ঐ ঘটের প্রচুর দাম হবে। আমি আরেক ধাপ সাহস নিয়ে বললাম --- টাকা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সংসার - খরচ থেকে বাঁচিয়ে আমি কিনব ।
আমার স্বামী বললেন --- আমি তাও ওদের একবার বলি কথাটা। তারপর সিদ্ধান্ত নিও। আমি বিস্ময়ে বললাম --- তোমার কি কোনোদিন বুদ্ধি হবেনা ! ওরা কি বলবে , হ্যা দাও !
আমার স্বামী আর কথা না বাড়িয়ে বললেন --- দেখো কি করবে !
পরের বছর দূর্গাপূজোর আগে আমি মেয়েকে নিয়ে দোকানে গেলাম দেবীঘট কিনতে। মনে একরাশ আনন্দ। আমার সেই কবে থেকে সাধ, বাড়িতে দুগ্গাপুজোর ! বাড়িতে পুজো না হোক, অন্তত ঘট তো দিতে পারছি মা দূর্গার নামে !
দোকানে গিয়ে, যেটা পছন্দ হল, তার দাম শুনে তো আমার চোখ কপালে! বলে কিনা, একশ টাকা কম সাত হাজার !
কিন্তু দোকানে ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউ যেন বুঝতে না পারে আমার এই অনভ্যাসের কথা। দূর্গাপুজো , তাই এদিক - ওদিক থেকে খুঁজে- পেতে ব্যাগে একটু বাড়তি টাকাও নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সব কুড়িয়ে - কাচিয়ে সেই ঘট কিনলাম। বড়লোক বাড়িতে দেবো বলে কথা। একটু যুৎসই না হলে চলে! তাছাড়া, আমরা সাধারণ লোকেরা বড়লোকদের কিছু দেবার কালে অনেক সময় সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও, তাদেরকে মূল্য দেবার সাথে সাথে নিজেদেরকেও তাদের কাছে মূল্যবান করে তোলার আপ্রান চেষ্টা করি। কোনো গরীবের ক্ষেত্রে আমাদের সে বালাই থাকে না । তাদের একটা কিছু দিয়ে দিলেই হল। তাদেরকে মূল্য দেওয়া বা তাদের কাছে নিজেকে মূল্যবান প্রমাণ করার কোনো তাগিদই থাকে না ।
স্বামীকে ফোন করলাম --- ঘট কেনা হয়ে গেছে। তুমি অফিস থেকে ওদের বাড়ি সোজা চলে এসো। আমরাও এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
আমার স্বামী শুনে বললেন --- সে কি ! তুমি সত্যি - সত্যি কিনলে নাকি?
আমি অবাক হয়ে উল্টো তাকে প্রশ্ন করলাম --- কেনো তোমাকে আগে বলিনি আমি ?
উনি কয়েকমূহুর্ত চুপ করে থেকে বললেন --- ঠিক আছে । আমি আসছি ।
সম্পূর্ণ রাস্তা বাসে যেতে - যেতে ভাবছি, কি খুশীই না হবেন ওরা। বিশেষ করে দাদা। এত বড় একটা জিনিস আমি কিনে নিয়ে যাচ্ছি ।
বাস থেকে নেমে দেখলাম আমার স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বললেন --- তোমরা রিকশা করে চলে যাও। এত বড় ভারী জিনিস নিয়ে হাঁটতে পারবে না। আমি হেঁটে চলে যাচ্ছি।
আমি ধমক দিয়ে বললাম --- কি বলছো! তুমি আরেকটা রিকশা করে নাও।
বাড়ির প্রধান গেট খুলে ভেতরে ঢুকে কলাপসিবল গেটের সামনে গিয়ে কলিং -বেলএ চাপ দিলাম। আমার মন - শরীর উত্তেজনা আর আনন্দে টলমল করছে।
বাড়ির পুরোনো কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিলে, আমরা করিডোর পেরিয়ে সে বাড়ির বিশাল বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম।
বাড়ির লোক খবর পেয়ে, আমাদের দেখে কিছুটা অবাক। খবর দিয়ে যাইনি।
এখনকার দিনে কোনো বাড়িতে যেতে গেলে আগে থেকে খবর দিয়ে যেতে হয়। নিদেনপক্ষে, যেদিন যাবো সেদিন সকালবেলায় ফোন করে জিজ্ঞাসা করে যেতে হয়, তাদের কোনো অসুবিধে হবে কিনা, আমরা যদি আসি ! কিন্তু আমরা কোনোটাই করিনি। সারপ্রাইজ দেবো বলে।
বাড়ির লোক যে দু - একজন এসেছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বললাম --- বড়দা কোথায়? দেখুন বৌদি, আপনাদের জন্য কি নিয়ে এসেছি !
কোমল কন্ঠে হেসে বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন --- তুমি আবার কি নিয়ে এসেছো? কাগজে মোড়া জিনিসটির দিকে তাকিয়ে বললেন --- এটা কি ?
আমি অতি- উৎসাহ নিয়ে বললাম --- এ বাড়ির দূর্গাপুজোর জন্য দেবীঘট। মনে মনে টের পেলাম, ঐ উৎসাহে যেন কিঞ্চিৎ গর্ব কাজ করছিল।
আমি আবার বললাম --- আপনাদের ঘটটা একটু বেশী বড় তো ! গতবছর দাদা বলছিলেন আরেকটু ছোটো ঘট আনতে হবে। তাই আমি কিনে নিয়ে এসেছি।
ঘরের ভেতর বজ্রপাত হলেও বোধহয় মানুষ এরচাইতে কম স্তম্ভিত হয়; আমার কথা শুনে ওরা যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
বড়দা এলেন। বাড়ির অন্যান্য ভাই, তাদের স্ত্রীরা এল এরকম একটা অদ্ভুত রকমের বার্তা পেয়ে। ওরা সবাই এ - ওর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। একটা রহস্যময় বাতাবরণ ঘরের ভেতর।
আমি বড়দার দিকে তাকিয়ে বললাম --- আমি দেবীঘট কিনে নিয়ে এসেছি, বড়দা । যেটা আছে, তার চাইতে একটু ছোটো ।
বড়দা গম্ভীর কন্ঠে আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন --- মানিক, তোমরা আমাদের বাড়ি নিয়ে এত বড় একটা ডিসিশন নিয়ে নিলে! তোমার স্ত্রী না হয় বোঝেনি। তোমার তো এটুকু চেতনা থাকা অন্তত উচিত ছিল! চাকরী - বাকরী কর!
এই প্রথম আমি বড়দার কন্ঠস্বর ও কথায় বুঝি একটু কেঁপে উঠলাম। আমার কান দিয়ে গরম হাওয়া বেরোচ্ছে। শরীরে ঘাম দিচ্ছে ।
আমি বললাম --- বড়দা, ও আমাকে বলেছিল আপনাদেরকে জিজ্ঞাসা করার কথা। আমি করতে দিইনি। আপনাদের তো ঘট কিনতেই হত। তাই আমি নিয়ে এসেছি।
বড়দা বললেন --- ঠিক হয়নি। না বলে - কয়ে, জিজ্ঞাসা না করে; এরকম একটা কাজ করা।
আমি খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে জিজ্ঞাসা করলাম --- নেবেন না বড়দা? আমি অনেক আশা করে নিয়ে এসেছি।
পাশ থেকে আরেক ভাই হেসে বললেন --- আমাদের বাড়ির দূর্গাপুজোয় আপনাদের দেওয়া ঘট বসানো হবে বৌদি? এ কখনো হয়?
আমি বললাম --- কেনো আমি দিই তো পুজোর জিনিস অনেককে। এরকম না হলেও, দিই ছোটোখাটো। ওরা নেয় তো!
উনি বললেন --- সবকিছু এক নয় বৌদি। আপনারা পুজোর সময় প্রতিদিন আসুন, থাকুন আমাদের সাথে; আমরা খুশী হব।
আমার স্বামী আমার পাশে বসে শেষ চেষ্টা করলেন । বললেন --- আপনাদের যদি এরকম কিছু থাকে যে আপনাদের দূর্গাপুজোর ঘট আপনারাই কিনবেন, তবে একুশ টাকা বা একান্ন টাকা মূল্য ধরে দিন না হয়! ও অনেক আশা করে নিয়ে এসেছে তো ! তাই বলছিলাম ।
আমার স্বামীর কথায় উনি হেসে বললেন --- আপনারা এ জিনিস বুঝবেন না, মানিক দা।
আমার একাদশ শ্রেণীর মেয়ে আজ বেশ ভালো একটা পোশাক পরে এসেছিল, এই বাড়িতে আসবে বলে।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বসে ছিলাম হতভম্ব হয়ে। আমার পাশে মেয়ে বসে রয়েছে। ওর বাবার স্বভাব পেয়েছে। দরকার পড়লে কথা বলে। আমার পিঠে হাত রেখে বললো --- মা, চল।
ফেরার সময় ঘটটা চতুর্গুণ ভারী হয়ে গেছে।
মেয়ে বললো --- আমাকে দেবে?
বললাম --- না, থাক। খুব ভারী।
আমার স্বামী কিছু না বলে, আমার হাত থেকে ঘট নিয়ে নিয়েছে। বললেন --- টাকা তো ফেরৎ দেবে না।
আমার তখনো ঠিক মতো সম্বিত ফিরে আসেনি। অভিজাত মানসিকতার অভাব আমার চিরকালীন নিম্ন সাধারণ অস্তিত্বে। আমি কি করে জানবো আভিজাত্যের মাপকাঠি ! কোনোরকমে বললাম --- ফেরৎ নেবে না তো। জোড়াতে আঠা লাগানো হয়ে গেছে। ঘটের যে জোড়া থাকে, তাতে।
শুনে উনি বললেন --- তাও যদি একবার রিকোয়েস্ট করে ____ , টাকা একটু কম দিয়েও নিয়ে নেয় !
মেয়ে বলল --- দরকার নেই ফেরৎ দেবার।
বাড়িতে সবাই আছে, বকাবকি করবে তো এটা নিয়ে ঢুকলে! আমি কি করবো এখন ! ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার স্বামী বললেন --- দাঁড়াও, একটা ট্যাক্সি করে নিই। আর বাড়িতে আমি অফিসের কথা বলে দেব। বলব, সবাই মিলে চাঁদা তুলে কেনা হয়েছে, একজনের গিফট। চিন্তা কোরনা ।
বললাম ---- আবার ট্যাক্সি করবে কেন! চল বাসেই চলে যাই।
----- না, থাক। ট্যাক্সিতেই চল।
সময়ের সাথে সাথে বছর গড়িয়ে চলেছে আমার একের পর এক। শুধু মাঝেমাঝে চোখে পড়ে, আমার মেয়ে খাটের তলা থেকে ঘটটা বের করে কাগজ খুলে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে, আবার কাগজ মুড়ে রেখে দেয়। আমি মেয়েকে হেসে বলি, কি যে করিস তুই ! কেন বার - বার ওটাকে বের করিস, আর মুছে রেখে দিস ! মেয়ে আমার কথার কোনো উত্তর দেয়না।
আজ সকাল থেকে সারা বাড়ি জুড়ে তুলকালাম অবস্থা। কিছু পাড়া - প্রতিবেশী, দুই -চারজন নিকট আত্মীয় -স্বজন, বাড়ির সব লোক মিলে সম্পূর্ণ বাড়িকে একেবারে মাথায় করে রেখেছে। হৈ - হুল্লোরে বাড়ি মাতোয়ারা।
বাড়ির সামনেটায় বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে আমাদের। আমার মেয়ে সেখানে এবার দূর্গাপুজো করছে। গতকাল ও আমাকে দিয়ে খাটের তলা থেকে দেবীঘট বের করিয়ে কাগজের মোড়ক খুলিয়ে তেঁতুল আর গঙ্গামাটি দিয়ে মাজিয়ে রেখেছে। আমি যখন ঘট ধুয়ে মুছে উপুড় করে রাখছি, পেছনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছিল।
আমি বললাম --- কিছু বলবি ?
---- আগামীকাল ষষ্ঠী! দেবীর বোধন। দেবীঘট বসবে, মা।
আমি মনে মনে বললাম --- আমার জ্যান্ত দূর্গা! আমার জ্যান্ত দূর্গা!
জয়েন্টে ভালো রেজাল্ট নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে গতবছর চাকরী পেয়েছে সে।
মাস তিনেক আগে একদিন রাতে ঘরে এসে আমাকে বলল ---- আমি আর তুমি গিয়ে দোকান থেকে প্রতিমাসে ঠাকুরের কিছু বড় থালা বাসন কিনে আনব।
আমি অবাক হয়ে বললাম --- ওমা! ঠাকুরের বড় বাসন কিনবি কেন? বাড়িতে আছে তো পুজোর বাসন! বড় - বড় বাসন দিয়ে কি করবি?
সে কথার উত্তর না দিয়ে, বলল --- এবারেরটা খুব ছোটো করেই করব। আস্তে - আস্তে বড় করব।
আমি বললাম --- কি করবি? কি পুজো করবি?
বলে --- দূর্গাপুজো।
আমি বিস্ফারিত চোখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছি। আমার স্বামী স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত - পা কাঁপছে আমার। পর পর দুদিন আমি কারো সাথে কথা বলতে পারিনি - খেতে পারিনি। সেটা ভয়ে না আনন্দে, আমি জানিনা।
রোজ রাতে শুতে যাওয়ার আগে মেয়ের আর আমাদের ঘরের মাঝখানের দরজাটা দিয়ে মেয়েকে একবার দেখে যাই আমি। গতকাল রাতে পুজোর সব ফর্দ মিলিয়ে গুছিয়ে - গাছিয়ে ঘরে যেতে অনেক রাত হল। গিয়ে দেখলাম, আমার স্বামী ঘরে নেই। হয়ত, পুজোর প্যান্ডেলেই আছেন।
মেয়েকে দেখতে ওর ঘরে এসেছি।
রাতের নীল আলোয় ভরা ছোট্টো খুপরি সেই ঘরটায় তক্তপোষের উপর আমার মেয়ে ঘুমোচ্ছে আর তার শিয়রের কাছে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন তার পিতা। জন্মদাতার গাল বেয়ে অশ্রুধারা।
এ কোন অশ্রু?
আনন্দের অশ্রু! না, বেদনার জমানো অশ্রু! তৃপ্তির অশ্রু?
আমি বুঝতে পারিনি। ফিরে এসেছি নির্বাক হয়ে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴