জলের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে সাইকেল থেকে নামল রমেশ। অন্ধকার পুরোপুরি নামেনি বলে কালুয়ার জলে শান্তভাবে শুয়ে থাকা পাথরগুলো দৃশ্যত এখনো স্পষ্ট। চপ্পল খুলে বসল নরম ঘাসের উপর। একবার তাকালো - খুলে রাখা চপ্পল জোড়ার দিকে , সুকতলা পেরিয়ে আঙুলের ছাপ পৌঁছে গেছে অনেক গভীরে। আঙুল-জীবাশ্ম যেন। নির্জন নদীতীরের ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে ঘামে ভেজা গেঞ্জি পর্যন্ত। ভালোলাগার অনুভূতি আর পরিশ্রমে চোখ বুজে আসছে রমেশের। আচ্ছন্ন অবস্থাতেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে - একজোড়া ব্যাকুল চোখ, উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছে তার জন্য। সকালে কাজে বেরোনোর সময় কানের কাছে মুখ রেখে বলেছিলো , "বাবা , পিঙ্ক জামা চাই আমার ! আজ আনবে তো ?" টিফিন ক্যারিয়ারে রুটি-গুড় ভরতে-ভরতে খিঁচিয়ে ওঠে অঞ্জলি , "রিয়া ! জানোনা বাবার পয়সা নেই ! একবার নতুন জামা না পরলে কিচ্ছু হবেনা ! যাও, বই নিয়ে বসো !" চোখের জল মুছতে মুছতে ছুটে পালিয়ে গেল সামনে থেকে। অভিমানী মেয়ে , অনেকবার ডেকেও সারা দেয়নি বাবাকে।
সৎপাল সিংয়ের ফার্নিচার কারখানায় করাত চালাতে - চালাতে একটুকরো আবদার বারংবার ফিরে আসছিল কানের কাছে। অন্যমনস্কতায় পেন্সিলের দাগ ভুলে করাত চালিয়েছে অন্যত্র। হাতুড়ের ঘা পড়েছে হাতে। হেডমিস্ত্রি - অনিলদা, সতর্ক করেছেন - "রমেশ , চোখে কম দেখলে চশমা নাও এবার !"
নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। পুজোর কাপড় সেখানে বিলাসিতা মাত্র। তবুও সৎপাল সিংয়ের কাছে আগাম কিছু টাকা আবদার করেছিলো গতকাল।গাঁধী-চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে দেখেছেন একবার , ওই পর্যন্ত। হ্যাঁ কিংবা না এর অনিশ্চিত দোলাচলে ঝুলে রইলো রমেশের বিনীত অনুরোধ ! মেয়ের একটি মাত্র পিঙ্ক জামার আবদার মেটাতে পারবেনা রমেশ ! অঞ্জলির রাগ মেয়ের আবদারে নয় , এক ব্যর্থ বাবার উপর। বোঝে সে। বোঝে বলেই কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য ! সামান্য ইচ্ছেকে সহজে নষ্ট হতে দেখে অভিমানী হয়ে ওঠে রিয়া। ব্যর্থতা - অপরাধী করে তোলে রমেশকে।
ওপারের ঘাটে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গোটাচ্ছেন দু'জন , সঙ্গে বড়োসড়ো দু'টি ব্যাগ। নদী পেরোবেন এবার। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে , দূরে - বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসছে মঙ্গল-শাঁখ আর উলুধ্বনি। পেছনের চরে বাঁধা গোরু নিয়ে ঘরে ফিরছেন অপরিচিত কোনো গৃহস্থ। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়েসী গোরুটা লেজ তুলে দৌড়তে শুরু করলো বাড়ির দিকে | মালিকের হাতে বন্দিনী মা-গোরু অবাধ্য সন্তানকে সতর্ক করতে থাকলো জোরে , "হাম্বা "......
পশ্চিমে বালিয়াড়ি অংশটায় প্রচুর কাশফুল, প্রতিটি কাশের আগায় একটি করে পাখি বসে। হাওয়ায় দুলছে কাশ , সঙ্গে পাখিটিও। সূর্যের শেষ আলো মেঘের ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসে ছুঁয়েছে কালুয়ার জল। মোহময়ী করে তুলেছে নদীকে।
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জল পেরিয়ে কাছে আসা দুই পথচারীর একজন হঠাৎই বলে উঠলেন, "আরে রমেশদা না ? তুমি এসময় এখানে কি করছো?" চমকে ওঠে রমেশ নিজেও, এ তো সোমনাথ ! ' পাশে আছি '-সংগঠনের জনপ্রিয় সংগঠক সোমনাথ দাস। "কিন্তু তোমরা এসময় হাঁটা পথে ?" জবাবের বদলে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে রমেশ।
-"পাশের গ্রামে শিশুদের পোশাক বিলি করে ফিরছি , তেলিপাড়া মোড়ে জটেশ্বরের বাস ধরবো। কেমন আছো দাদা ? রিয়ার পড়াশুনা ঠিকঠাক চলছে তো ? "
-" ভালো আছি।" খুব ছোট্ট উত্তর ছুঁড়ে দিয়েই সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেল সে। "রমেশদা, শোনো ! এটা ধরো - রিয়া আর বৌদির জন্য !" দু'টো প্যাকেট হাতে দিয়েই আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সোমনাথ এবং তার সহকর্মী। দেবদূতের মতো। বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো আজ। হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখে, নতুন পিঙ্ক ফ্রক পরে ছুটে এলো রিয়া। গলা জড়িয়ে ধরে বললো , "বাবা, জামাটা খুব সুন্দর ! মায়ের শাড়িটাও। মাকে খুব মানাবে দেখো ! " নির্বাক রমেশের দু'চোখ বেয়ে এখন বৃষ্টির অকাল বোধন, এই মেঘ-মুক্ত শরতেও।