সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
24-November,2022 - Thursday ✍️ By- সৌগত ভট্টাচার্য 457

দুই টাকার গল্প

দুই টাকার গল্প
সৌগত ভট্টাচার্য
^^^^^^^^^^^^^^

যদুদা আমাদের মেসতুতো দাদা! এক মেসে থাকতাম... যদুদার নামের আগে ক্যাওড়া বসল কি ভাবে জানি না। ছাত্র রাজনীতির সুবাদেই হয়ত। কলেজে ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মী ছিল যদুদা। কানাঘুষো শুনতাম, সংগঠনের প্রয়োজনে নাকি কলেজ থেকে তাঁকে পাশ করানো হয় না। সত্যি মিথ্যা জানি না! আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে পার্ট ওয়ান, সে বছর যদুদার কলেজে ফাইনাল ইয়ার। নিচু ক্লাসে পড়লেও আমাদের মেস পাড়ার ছেলেদের একটা বাড়তি সম্ভ্রম ছিল যদুদার প্রতি। অংক অনার্সের মেধাবী ছাত্র। এমনিতেও যাঁরা অংক পারে আর ইংরেজিতে কথা বলতে পারে তাঁদের দেখলেই আমার কেমন যেন একটু শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাবটা বেড়ে যায়। ক্যাওড়া যদু আমাদের থেকে বয়সে বছর তিনেকের বড়। সকালবেলায় গম্ভীর মুখে একটা চিনি দুধ ছাড়া চা আর ক্যাপস্টেন মিক্সচার ধরিয়ে টেলিগ্রাফ নিয়ে বসত যদুদা । 
"এই দেশটার আর কিছু হবে না বুঝলি!"
"কেন আবার কী হল?"
যদুদা খবরের কাগজ থেকে একটা ইংরেজি সেন্টেন্স ঝাড়া পড়ে বলল, 
"বিপ্লব বিপ্লব চাই বিপ্লব!"
"তো সেটা হচ্ছে না কেন যদুদা?"
"ব্যপারটা বুঝতে হবে, বিপ্লব আসলে একটা লাল রঙের ডবল ডেকার বাস। কিন্তু সেই বাস যখন রাস্তায় বেরোয়, মাথার ওপর এত ইলেক্ট্রিকের তার যে কোথায় যেতেই না বাসটা, যেতে গেলেই তারে লেগে যায়। তাই বিপ্লবও হচ্ছে না! একদম সিম্পল!" 
তারপর থেকে আকাশের দিকে তাকালে যত ইলেক্ট্রিকের তার দেখতাম সেগুলোকেই বিপ্লব না হওয়ার কারণ বলেই জানতাম। 

হাঁটতে হাঁটতে কখন গঙ্গার ধারে যে পৌঁছে গেছি আমরা কয়েকজন খেয়াল নেই। একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে যদুদা সিগারেট ধরিয়ে প্রশ্ন করে আপেল গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে সবচেয়ে সরল কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়? আমরা এক মিনিটও না ভেবে কেউ উত্তর দিয়েছিলাম মাধ্যাকর্ষণ কেউ বলেছিল পৃষ্ঠটান। যদুদা বলেছিল, সহজতম সিদ্ধান্ত হল,গাছটা আপেল গাছ। সত্যি এত সহজ ও সরল ভাবে ভাবা যেতে পারে! 

ফেরার সময় ময়দান পেরিয়ে আসছি। এমন সময় সুমনকে প্রকৃতি ডাকছে, ছোট ডাক! ময়দানে সেই ডাকে সাড়া দিলে পুলিশ এসে ধারার সম্ভাবনা প্রবল। যদুদা বলেছিল পুরোটা এক জায়গায় করবি না। আসে পাশে ঘুরে ঘুরে দুই তিন জায়গায় ইন্সটলমেন্টে ছাড়বি। সুমন জিজ্ঞেস করেছিল - কেন? 
- কারণ পুলিশ ধরলে বলতে পারবি যে, আমি একা করিনি আপনিও তো করেছেন, এই যে পাশের ঘাস ভেজা। যদিও সে কথা পুলিশকে  বলার বুকের পাটা আমাদের কারুর ছিল না। যদুদা ভরসা দিয়েছিল আমি আছি তো! একটু এগিয়ে আসার পর যদুদা বলে, এক মিনিট দাঁড়া। বলে নিজে একটা দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়, দেওয়ালে লেখা "এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ। করিলে ৫০ টাকা জরিমানা" কয়েক মিনিটের মধ্যে যদুদা ফিরে এসেছে প্যান্ট ঠিক করতে করতে। বললাম, 
"যদুদা করলে না কেন?"
"দেখলি না কি লেখা ছিল?"
"দেখলাম তো, কিন্তু ৫০ টাকার ভয়ে করলে না? নাকি পুলিশের ভয়ে? একটু আগেই ময়দানে তুমিই না পুলিশকে বুঝে নিচ্ছিলে!"
" বুঝলি না, পুলিশকে ভয়ের ব্যাপার নয় এটা!"
"তাহলে?"
"বোঝ একটা সরল বিষয়, ওখানে করে পঞ্চাশ টাকা ফাইন দেওয়ার থেকে, প্যান্টে করে ধোপার কাছে ধুতে দিলে অনেক কম খরচ পড়বে!"

শিয়ালদায় লোকাল ট্রেনে বসে আছি, জানলার ধারে যদুদা। নানা লোক এসে জিজ্ঞেস করছে দাদা রানাঘাট? দাদা শান্তিপুর? যদুও উত্তর দিচ্ছে। একজন এসে জিজ্ঞেস করে - দাদা বেলঘরিয়া হয়ে যাবে? যদু উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে। লোকটা ট্রেনে ওঠার পর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দেয়। আমরা সবাই জিজ্ঞেস করি তুমি বললে কেন বেলঘরিয়া যাবে, এটা তো গ্যালপিং ট্রেন, বেলঘরিয়া দাঁড়াবে না।  যদুদা উত্তর দিয়েছিল, লোকটা জিজ্ঞেস করেছিল বেলঘরিয়া হয়ে যাবে কি না! বেলঘরিয়ায় দাঁড়াবে কি না জিজ্ঞেস করেছিল কি? 

প্রায় এরকমই অভিজ্ঞতা হয়েছিল পাশের মেসের সুপ্রিয়র ওদের কলেজের স্পোর্টসের দিন। পরে সেই ঘটনা শুনেছিলাম সুপ্রিয়র থেকে। সুপ্রিয় তখন কলেজে নতুন। ক্যাওড়া যদুকে চেনে না। স্পোর্টসের ভলান্টিয়ার সুপ্রিয়। যদু একটা ক্যাম্পে বসে আছে। যদুর কাছে গিয়ে নাকি সুপ্রিয় জিজ্ঞাসা করেছিল এখান থেকে কি ভলান্টিয়ার ব্যাচ দেওয়া হচ্ছে? যদু সুপ্রিয়কে এনকোয়ারী কাউন্টারে পাঠিয়ে দেয়। সুপ্রিয় মাঠ পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে আবার যদুর কাউন্টারে এসে বলে এখান থেকেই তো ভলান্টিয়ারদের ব্যাচ দিচ্ছে, আমাকে ওখানে পাঠালে কেন? ক্যাওড়া যদু বলে, একদমই! এখান থেকেই ভলান্টিয়ার ব্যাচ দিচ্ছি, আমিই দিচ্ছি! কিন্তু এটা অনুসন্ধানের কাউন্টার না যে এখনে এসে সবাই জিজ্ঞেস করবে। এনকোয়ারীর জন্য আমরা আলাদা কাউন্টার খুলেছি!

তখন সুপ্রিয়র সঙ্গে যদুদার দারুণ সম্পর্ক। সুপ্রিয়ই বলেছিল এই গল্পটাও, যদুদার দায়িত্ব পড়েছে মেস পাড়ার ওদের কলেজে পড়া ছেলেদের ভোটের দিন কলেজে নিয়ে আসা। কথা মতো কাজ করেছে যদুদা। ভোটের দিন কলেজের গেটের সামনে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। গেটে দাঁড়িয়ে পুলিশের এক অফিসার স্টুডেন্টদের একজন করে আই কার্ড দেখছে আর ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে। কলেজের পক্ষ থেকে বারবার বলে দেওয়া হয়েছিল ভোটের দিন অবশ্যই কলেজ আই কার্ড সঙ্গে আনতে, নইলে পুলিশ ঢুকতে দেবে না। যথারীতি ক্যাওড়া যদু আই কার্ড আনেনি। আনেনি বললে ভুল হবে! কবে কোন ইয়ারের আই কার্ড কোথায় আছে, নাকি আদৌ নেই, সেটার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সুপ্রিয়দের এক এক করে কলেজে ঢুকতে দিলেও যদুকে কলেজের গেটে আটকে দেয় পুলিশ। পুলিশ আর যদুর মধ্যে যে তর্ক হচ্ছে সেটার মূল বিষয় হল যদু কলেজে ঢুকবেই, পুলিশ বলছে কি ভাবে বুঝব যে আপনি স্টুডেন্ট? বলছি তো আমি স্টুডেন্ট। তাহলে আই কার্ড দেখান। আরে বলছি তো... পুলিশ অফিসার আবার বলেন, আপনিই বলুন কি ভাবে বুঝব আপনি স্টুডেন্ট? ক্যাওড়া যদু পুলিশ অফিসারকে অবাক করে উত্তর দিয়েছিল, কি ভাবে বুঝবেন যে আমি স্টুডেন্ট?  আচ্ছা,
তাহলে আপনি আমাকে পড়া ধরুন, এটাই তো সিম্পল ওয়ে!

মেসের কাছেই ছিল একটা পোস্ট অফিস। পোস্ট অফিসের পেছনের দেওয়ালে লাগানো ছিল কলকাতা টেলিফোনের একটা কয়েন বুথের লোহার বাক্স। দুই টাকার কয়েন ফেললে কলকাতার মধ্যে লোকাল টেলিফোনে দুই মিনিটের জন্য কথা বলা যেত। এক সময় দেখা গেল সন্ধ্যার পর মেসের রাস্তাটা যত নির্জন হয়ে আসত, কয়েন বুথের সমানে ভিড় বাড়ত। একেক জন ফোন করলে আর ফোন ছাড়েই না। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেই যায়। কিন্তু কেসটা কি? আসলে ক্যাওড়া যদু একটা দুই টাকার কয়েনের সঙ্গে লোহার সরু তার ঝালাই করে লাগিয়ে মেসের দরজার সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। যার ফোন করার দরকার সে তার সমেত কয়েন নিয়ে টেলিফনের  বাক্সে ফেলে দিত, দুই মিনিট হওয়ার আগেই আবার তার টেনে সেই কয়েন উঠিয়ে নিত, আবার কয়েন হোলে একই তার বাঁধা দুই টাকার কয়েন নামিয়ে দিয়ে অনন্ত কথা বলে যেত সকলে। রাতের দিকে কথা বলা শেষ হলে তার বাঁধা দুই টাকার কয়েনটিকে মেসেজের সদর দরজায় ঝুলিয়ে রাখত কেউ একজন। 

এখন যদুদা একটা স্কুলের মাস্টারমশাই। মাঝেমাঝেই ফোনে কথা হয়। ফোন করলে ছাড়তে চায় না। কত কথা থাকে যদুদার, কত গল্প ... যদুদা সারাজীবন খুঁজে গেল, যে কোনো প্রশ্নের, যে কোনো সমস্যার, যে কোনো বাধাবিপত্তির সবচেয়ে সহজ সরল সমাধানটা কি! আমরা পারলাম না সহজতম সমাধানের রাস্তায় হাঁটতে!
সেদিন ফোনে কথা শেষে রাখার সময় জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি দুই টাকা দিয়ে ফোন রিচার্জ হয় যদুদা?

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri