দ্বৈপায়ন বেদব্যাস ও যুবক সৌতির কথা (স্বপ্নে ও জাগরণে)
দ্বৈপায়ন : দেখ,এই জনহীন প্রান্তর। তুমি হাত ধরে আছ নতুন জন্মের। আমি সেই প্রাগৈতিহাসিক হয়েও প্রতি কাল প্রজন্মের হাত ধরে থাকা অভিভাবক কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তোমাকে নাম দিলাম সৌতি। যে হৃষিকেশ হরিকে প্রণাম জানিয়ে আমার মহাভারত কথা শুনিয়েছিল মহর্ষি শৌনককে।
সৌতি : বলুন ব্যাসদেব, ব্যাকুল হয়ে আছি... অনাগত ভবিষ্যৎ ছোটবেলার সে উজ্জ্বল আলো দেখাতে পারছে না।আমার চোখে আর শ্রুতিতেই কি নেমে এসেছে দূরাগত বিপর্যয় ধ্বনি! যেমন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধযাত্রার ঠিক আগে সম্পূর্ন হস্তিনাপুর যেমন শুনেছিল... অশুভ শব্দ, বজ্রধ্বনি ভূমিকম্প, উল্কাপাত, সারমেয়ের অদ্ভুত ক্রন্দন, রুধির কর্দম বৃষ্টিপাত!
দ্বৈপায়ন : বিপর্যয় মধ্যগগনে। নীল পাহাড়ের উত্তরের পরপর শ্বেতবর্ষ, হৈরণ্যক বর্ষ আর ঐরাবত বর্ষ থাকলেও এই যে দক্ষিণে আমাদের 'ভারতবর্ষ' গঙ্গা, সিন্ধু, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা, শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিতস্তা, যমুনার পুণ্য সলিলে মাতৃতুল্য এবং মহাফলপ্রদ। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের মতো বহু দেশ রাজ্যে পরিবেষ্টিত মানুষ অথবা রাজা পারস্পরিক শান্তির সম্পর্ক তৈরি না করে একে অন্যের ভূমি হরণ করেছে আগেও যেমন ঠিক তেমনি আজ পর্যন্তও কারো কামনার তৃপ্তি হয়নি। ঠিক সে কারণেই যুদ্ধ আর মৃত্যু সঙ্গে ধ্বংস... মানুষের হাহাকারে উদ্বেলিত দশদিক।
সৌতি : মহর্ষি,আপনি শুনেছেন আমাদের কান্না! মানুষ যে ক্রমশ প্রীতি সম্পর্ক হারিয়ে ফেলছে। পরস্পর অবিশ্বাস, ভ্রম, স্বার্থপরতায় চতুর্দিক বিধ্বংস। প্রকৃতি হারিয়েছে ভারসাম্য। নষ্ট করেছে সৃষ্টি বৃক্ষ নদী ভূমি। আসলে সুস্থতা থাকলেই তো পরস্পর সম্পর্কের বুনিয়াদ পোক্ত হয়। এই দেখুন আমরা গলা ছেড়ে সুর তুলে পথে বেরোনোর দরজা এঁটেছি ভয়ে.. স্রেফ ভয়ে।
দ্বৈপায়ন : কত লক্ষ কোটি কাল পর্ব জুড়ে হেঁটে চলেছি আমি আমরা... মানুষে মানুষে ঈর্ষা নামের দ্বন্দ্ব তো দূর হল না। উপরন্তু তোমাদের সভ্যসমাজ শুধু নয়, সর্বত্র ছড়িয়েছে সেই শস্যক্ষেতের উপর ধোঁয়ার প্রবল রেখার মতো পঙ্গপাল। গ্রামকে গ্রাম নিশ্চিহ্ন করেছে আর বংশবৃদ্ধি করেছে। সেই সোরোটোনিনে বংশবিস্তার কমতে না কমতেই ধারাল ক্ষুদ্র ভাইরাস কি আশ্চর্য ভাবে ঢুকে পড়েছে তোমাদের চৌহদ্দিতে... শরীরের ভিতরে... দেখেছ?
সৌতি : আপনি দেখলেন আমি আর কয়েকজন বন্ধু কিভাবে একে অন্যজন থেকে প্রায় ছ'ফুট দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছি,কেন!আমাদের পরস্পর নি:শ্বাসকে ভীতি। অথচ দেখুন মানুষকে বিশেষত রোগগ্রস্ত মানুষকে ঘর থেকে দূরে হেলথ্ সেন্টারে নিয়ে যাব বলেই এসেছি। বাতাস উত্তাল, মনে ভয়... এ মহামারী ভীত উন্মত্ত করছে শুধুই...
দ্বৈপায়ন : হুম্ উদ্দালকের মতোই তোমরা অকুতোভয়। বয়সী পিতা মাতার আশ্রয়।পুরাকালের মতো তোমাদের আমি ইচ্ছে করলেই বর দিতে পারি না। সে ক্ষমতা কবেই চলে গেছে। অথচ দেখ সে সময় ভাল কাজের ফল তারা সঙ্গে সঙ্গেই পেত। আর অন্যায়ের দন্ড পেত খুব দ্রুত। বিচারের নামে রাজার নীতির টানাপোড়েনের কোনো দাক্ষিণ্য ছিল না। তবে তোমরা যারা সৎকাজে বেরিয়ে পড়েছ কোন বাধা না মেনে, একদিন দেখবে তোমরাই কাজের প্রক্রিয়াগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছ আর খুঁজে নিয়েছ ঐ আকাশের নীল, নদীর কলতান, ফুলের গন্ধ আর মৌমাছির গুন গুন...
সৌতি : এই যে আপনি এসেছেন মহর্ষি... উজ্জ্বল সাদা পোষাক জ্বল জ্বল করছে।আপনি আমাদের মঙ্গল কামনায় অন্তত একবার ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য ক্ষয়ের এক যজ্ঞ আয়োজন করুন। মানুষের পরিবারকে বিপন্ন করে তুলছে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু কণা তাকে তুলে নিন।আবার নীরোগ করুন সমাজ, মনের যত কুয়াশার অন্ধকার মুছে যাক।
দ্বৈপায়ন : দেখ, যুগে যুগেই ছিল কষ্ট, অসহায়তা, দারিদ্র, অসুস্থতা, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু। কখনো অল্পসময় জুড়ে, কখনো বহুদিন। বুদ্ধদেবের সন্ন্যাস আর নির্বাণের কথা তো জান। গৃহবন্দী এই মনখারাপের আগল তোমাদের অনেককেই নিশ্চেষ্ট করেছে, শিক্ষার আঙিনায় স্তব্ধতা। সবুজ মাঠের ঘাস বর্ষার জল পেয়ে ঝক ঝক করছে। কলতান নেই। তোমাদের কবিই তো উচ্চারণ করেছিলেন মুক্তির গান 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে...'
সৌতি : ঠিকই মহর্ষি, আমরা তাঁর গান গাই, কবিতার শব্দে মুক্তি ঘটে আমাদের। একে একে এই য়ে আসে ডাকঘরের অমল, সুধা, অচলায়তনের পঞ্চক, মুক্তধারার অভিজিৎ।আমরা ছুটি প্রাণের আনন্দে। বন্ধুরা একটা গান গাই। শুনুন "আমরা দূর আকাশের নেশায় মাতাল ঘর ভোলা সব যত..."
দ্বৈপায়ন : আ: শ্রুতি জুড়িয়ে যাওয়া এই সুরই তো দেবে তোমাদের কর্মপ্রেরণা।রোগমুক্তি ঘটবেই। ক্ষুদ্র সে ভাইরাসকে কব্জা করতেই তো তোমরা মুখে মাথায় এঁটেছ মুখোশ, হাতে পড়েছ আবরনী। অথচ সেটাও কেমন শিল্পমন্ডিত করে তুলেছে মানুষই তো!
সৌতি : হ্যাঁ মহর্ষি। সব ধ্বংসের মধ্যেই তো সৃষ্টির কথা শুনি। এই দেখুন আমার বন্ধু মান্ডবী ঐযে অদ্ভুত বর্ণিল আচ্ছাদনে মুখ ঢেকে পাখির সজ্জায় নিজেকে সাজিয়েছে ওটার অনুপ্রেরণা ওর মা। এই দু:সহ অবস্থায় এটাকেই জীবিকা করেছেন। মান্ডবীর সাহায্যে অনলাইনে হাতের কাজের কর্মশালাও করেছেন।... অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছি আমি আমরা, কর্মসংস্থান হারিয়েছে কতজন!
দ্বৈপায়ন : এসব দেখে আমার তো ঐ বন্ধ মঞ্চালয়ের মঞ্চ অভিনয়ের কথা মনে পড়ছে।অদ্ভুত শিল্প সৌন্দর্যবোধ!কালো সময় থেকে বেরিয়ে আসবে ঠিক...
সৌতি : মঞ্চ যতই বন্ধ থাক মহর্ষি, আমরা ঐ অনলাইনেই পৌঁছে গেছি দেশ বিদেশের নাট্যদল আর দর্শকের কাছাকাছি। অভিনয় দেখে তাঁরা ধন্য ধন্য করেছেন। দেখুন মনের ভিতর টুকরো ক্ষীণ আশাটুকু তো আছে।একদিন পৌঁছবোই বিশ্বজয়ের পতাকা ধরে।
দ্বৈপায়ন : বিজয় আসন্ন তোমাদের। মনে রাখবে, সমস্তই ভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে ভূমিতেই বিনাশ পায়, ভূমিই পরম আশ্রয়।তবে তারজন্য উদারতা চাই, চাই স্থৈর্য, ধৈর্য, ক্ষমা, ভালোবাসা। একদিন দ্বার খুলবেই। যে হরি, যে বৃষ্ণি বংশীয় বিষ্ণু, কৃষ্ণ তিনি পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, সেই শঙ্খ বেজে উঠবে তোমাদের জয়যাত্রায়। তিনি যে কাজের কথা তাঁর বন্ধু ধনঞ্জয়কে বলেছেন বার বার,অলসতা ত্যাগ করে এগিয়ে যেতে বলেছেন। আমিও সে কথাই বলি-"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন/মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্তকর্মণি।"... দেখ সন্ধে হয়ে আসছে।যাওয়ার সময় হল।তোমাদের উপর বর্ষিত হোক সময়ের পবিত্র জল। রাতের আকাশে তাকাও আর মুক্ত আনন্দের গান গাও।
(দ্বৈপায়নের বায়বীয় শুভ্রতা আকাশে মেঘের সঙ্গে মিলিয়ে গেল)
সৌতি আর বন্ধুরা : বাতাসে দিয়েছে দোল।যত ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, উন্মত্ত ঝড় আসুক সব কেটে যাবে একদিন। তারুণ্য নেমেছে পৃথিবীর বুকে। আমরা পারবই নীরোগ পৃথিবী গড়তে। বিষন্নতা ঝরে যাক, শুকিয়ে যাক ভয়ঙ্কর ভাইরাস। শালমলী গাছের নীচে ঐযে গ্রাম, ঐযে কাকচক্ষু জল নদী, চল্ ওদের সবাইকে ডেকে নিই। হাতে হাত রাখি। কবির গান যে আজ প্রাণ..."ফিরে চল্,ফিরে চল্,ফিরে চল্ মাটির টানে-/যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।