সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

ঢেউ/অলক পর্না সেনগুপ্ত ব্যানার্জী

ঢেউ
অলক পর্না সেনগুপ্ত ব্যানার্জী
=======================

চুপ করে বসে একা একা ঢেউ ভাঙা দেখছিল মেঘনা। মেরিনা বিচের কোলাহল ছুঁতে পারছিল না ওকে। দূরে সার দিয়ে জাহাজ যাচ্ছে, কোথায় কে জানে!! বীচে কত লোক, অসংখ্য দোকানপাট, গিজগিজ করছে ভিড়। অচেনা ভিড় স্বস্তি দিয়েছে ওকে। অনন্ত জলরাশি থেকে একটা একটা করে ঢেউ তৈরি হচ্ছে আর পাড়ে এসেই ভেঙে পড়ছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। পড়ন্ত বিকেলের রোদ পড়ে যেন রূপোর সাজে সেজেছে সমুদ্র। বালুকাবেলায় নতুন নতুন ঢেউ ছুঁড়েই যেন তার আনন্দ!! আনমনে চেয়ে ছিল মেঘনা। কিন্তু হঠাৎ ভিড়ের মাঝে নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে ও। “আরে মেঘনা ম্যাডাম !! একা নাকি ?” এক সাথে ট্রেনে এসেছিল ওরা, রূপক। আগরতলায় বাড়ি। মৃদু হাসে মেঘনা। মনে মনে একটু বিরক্তই হয়। কথা বলতে ভাল লাগছে না ওর। “আপনার হাসব্যান্ড কেমন আছেন? কী বলল ডাক্তার?” –“হসপিটালে ভর্তি, কাল অপারেশন হবে।“ দায়সারা জবাব দিয়ে সমুদ্রের দিকে মুখ ফেরায় মেঘনা। “আগেও এসেছেন এ শহরে?” আবার প্রশ্ন করে রূপক।–“হ্যাঁ, চলি আমাকে হসপিটাল যেতে হবে” বলেই উঠে দাঁড়ায় মেঘনা, রূপককে আর কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে থাকে, বুঝতে পারে একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
মেঘনা আর প্রিয়াংশুর বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ'মাস। উত্তরবঙ্গের ছোট্ট এক মহকুমা শহরে দুজনেরই বাড়ি। একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ায় মেঘনা, প্রিয়াংশুও আগে সেখানেই পড়াত। সেখান থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব ও প্রেম। বছর দুই আগে প্রিয়াংশু সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা পেয়ে যায়। তারপর বিয়ে। প্রিয়াংশুর মা মারা গেছেন, বাবা ছেলের সংসার, অন্যদিকে মেঘনা দু'বোনের মধ্যে ছোট। মা বাবার আদুরে সংসার অনভিজ্ঞ আদ্যন্ত রোমান্টিক মেয়ে। বিয়ের পর পরিতোষবাবু ছেলের বৌয়ের হাতে সংসার দিয়ে দায়মুক্ত হলেন যেন। নতুন সংসারে এসে নানা বিষয়ে হোঁচট খেতে হলেও মেঘনা বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হল অন্য জায়গায়। যে কথা কারো সাথে শেয়ার করতে পারছিল না ও, ভীষণ রোম্যান্টিক মেঘনা উন্মুখ হয়ে থাকত প্রিয়াংশুর জন্য, কিন্তু একটা সময়ের পর কেমন যেন গুটিয়ে যেত প্রিয়াংশু। একদিন যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল ও। ভীষন ভয় পেয়ে গেল মেঘনা। আগেও প্রিয়াংশু বলেছে ওর তলপেটে প্রায়ই একটা চিনচিনে ব্যথা হয়। ইদানিং তলপেটে একটা পাউচ মতো মনে হচ্ছিল কিন্তু ওর ডাক্তার দেখাতে বড্ড অনীহা। সেদিন রাতে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হল। ভয়ে অনুশোচনায় যেন মরে যাচ্ছিল মেঘনা। নিজেকেই দায়ী করছিল। প্রিয়াংশুও ভেঙে পড়েছিল মনে মনে। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা, পাড়ার ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড়, ছোটখাটো অনেক প্রেম করার পর মেঘনার সঙ্গেই সম্পর্কটা দানা বাঁধে। কিন্তু এমন সমস্যা ওকে মেঘনার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দিচ্ছে না। ওর মনে হচ্ছে মেঘনাও ওকে দেখলে গুটিয়ে যাচ্ছে আজকাল। কাছের বড় শহর শিলিগুড়ি, সেখানেই ডাক্তার দেখাল প্রিয়াংশু। অনেক রকম টেস্ট করে রিপোর্ট দেখাতেই ডাক্তারের কপালে ভাঁজ পড়ল। -“আপনার মনে হয় একটা অপারেশন করতে হবে মিঃ বোস, আপনি আরেকদিন আসুন আমি আপনার রিপোর্টটা আর একটু স্টাডি করতে চাই… ও হ্যাঁ এরপর সাথে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন… ঘাবড়াবেন না ভয়ের কিছু নেই”। এক নিঝুম মন নিয়ে ফিরে আসে প্রিয়াংশু। বাবা, মেঘনা কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না। উৎকন্ঠায় একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে মেঘনা, প্রিয়াংশু শুধু জানায় নেক্সট দিন ওকে সাথে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু বলবেন সব।
তারপরই এই অপারেশন করতে ওদের চেন্নাই আসা। এখানকার একটি নামী বেসরকারি হসপিটালে ভর্তি হয়েছে প্রিয়াংশু। বাবা, মা, দিদি, মেঘনার শ্বশুর পরিতোষবাবু অনেক জোর করলেও কাউকে সাথে আনেনি । প্রিয়াংশুর আসল সমস্যার কথা বা সেটা যে কতটা গুরুতর সেটাই কাউকে জানায়নি ওরা। বলা ভাল মেঘনাই বলতে দেয়নি কাউকে। ভীষণ ভেঙে পড়েছিল প্রিয়াংশু। মেঘনার হাতদুটো ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল ও। -“মেঘ মেঘ তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও। আমি তোমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি…. এভাবে আমার সাথে থেকে নিজের জীবন আর নষ্ট কোরো না প্লিজ…”। আরো অনেক কিছু বলতে চাইছিল ও, মেঘনা থামিয়ে দিয়েছিল প্রিয়াংশুকে। -“এভাবে আমাদের ভালোবাসাকে ছোটো কোরো না প্রিয়াংশু। আমার কিছু হলে তুমি কি তাই করতে? আমি তোমার স্ত্রী, বন্ধুও। পাশে থাকতে চাই আজীবন। আমায় হারতে দিও না প্লিজ”। বলেছিল মেঘনা।
তবে আজ কেন এত ভয় লাগছে ওর। অটো ধরে বাঙালি বাজারের দিকে আসতে আসতে ভাবে, রূপকের সাথে একটু অভদ্রতাই করা হয়ে গেছে। ফের দেখা হলে সরি বলে দেবে। ভয় লাগে যদি মুখ ফসকে বলে ফেলে প্রিয়াংশুর কথা.… পি. এম. ডি. এস (পারসিসট্যান্স মুলারিয়ান ডাক্ট সিনড্রোম) এক অদ্ভুত অসুখ, জেনেটিক ডিসঅর্ডার। যেখানে পুরুষ অঙ্গের সাথে পেটে ইউটেরাস, ফ্যালোপিয়ান টিউব ইত্যাদি স্ত্রী অঙ্গও থাকে এবং শুধু থাকেই না দিনে দিনে তা জটিল আকার ধারণ করে। রোগীর শারীরিক-এর সাথে মানসিক সমস্যা জটিলতর হতে থাকে। মেঘনা জানে বিরল হলেও এমন ঘটনা ঘটে, কিন্তু ওর জীবনেই কেন? প্রিয়াংশু এখন প্রায় কথাই বলে না। গুম হয়ে থাকে। মেঘনাকে দেখলেও যেন বিরক্ত হয়। আজ দুপুরে যখন ও মেঘনার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল –“মেঘ আমি আর বাঁচতে চাই না। ও.টিতে আমার যেন আর জ্ঞান না ফেরে”। অবাক হয়ে জলভরা চোখে তাকিয়ে ছিল মেঘনা প্রিয়াংশুর দিকে। কোটরে বসা দুচোখে এমন বেঁচে না থাকার আর্তি এই পঁচিশ বছরের সাজানো গোছানো জীবনে কক্ষনো দেখেনি মেঘনা। প্রথম দিন শুনেই প্রিয়াংশু স্বগতোক্তি করেছিল –“আমি তাহলে কী?” এক তীব্র অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগতে থাকে ও, ডাক্তার অনেক বুঝিয়েছেন ও পুরুষই , এটা একটা ডিসঅর্ডার। কিন্তু চরম হতাশায় গাদাখানেক স্লিপিং পিলের মধ্যে উত্তর খুঁজতে চেয়েছিল, পারেনি।
বড় ক্লান্ত লাগে আজকাল মেঘনার। গেস্টহাউসে ফিরে কিছু কাগজপত্র নিয়ে আবার যেতে হবে হসপিটালে। ডাক্তারদের একটি টিম তৈরি হয়েছে এই বিশেষ অপারেশনের জন্য। তারা কথা বলবেন মেঘনার সাথে। টাকাপয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে জলের মতো। সবদিক সামলাতে সামলাতে মেঘনা নিজেই ডিপ্রেশনের এক অন্ধকার খাদে তলিয়ে যাচ্ছে যেন। কেউ নেই যার সাথে এসব কথা শেয়ার করতে পারে। প্রিয়াংশু কী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে শরীরে – মনে !! ও কি সারাজীবন পারবে প্রিয়াংশুকে ভালোবাসতে। এখনই কেন সংশয় দেখা দিচ্ছে?
গেস্টহাউস থেকে বের হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ও, হেঁটেই। সামনে দেখে রূপক –“কোথায় চল্লেন” আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে মেঘনা।–“হসপিটাল, আপনি?” –“আমিও”। ট্রেনের দীর্ঘ রাস্তায় গান গেয়ে মাতিয়ে রাখছিল রূপক। তখন অবশ্য মেঘনার শোনার মতো মন ছিল না। প্রিয়াংশুর খারাপ ব্যবহার আর অসহযোগিতা ওকে এক চূড়ান্ত অসহায়তায় ফেলে দিয়েছিল। রূপক এসেছে ওর মাকে নিয়ে। ওর মায়ের ক্যান্সার, ব্রেস্টে। এখন ছড়িয়ে গিয়েছে অনেকটা। ডাক্তার তেমন আশা দিতে পারছেন না। কথায় কথায় জানল অনেক ছোট বেলায় রূপকের বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই ওকে বড় করেছে। মা ছাড়া ওর কেউই নেই বলতে গিয়ে চোখের কোণে মুক্তোদানা জমে রূপকের। মেঘনার দৃষ্টি এড়ায় না। হসপিটালে পৌঁছে একে অন্যকে বাই বলে দুদিকের লিফটে ওঠে। রূপক লোকমুখে শুনেছে প্রিয়াংশুর অসুখের কথা, কিন্তু মেঘনাকে কিছু বলে বিব্রত করতে চায়নি। মেঘনার আত্মবিশ্বাসকে মনে মনে অ্যপ্রিশিয়েট করে রূপক।
ডাক্তারদের সাথে দীর্ঘ কথোপকথনের পর মেঘনা জানল প্রিয়াংশু বায়োলজিক্যাল ভাবে সক্ষম হবে না আর পিতৃত্ব লাভের। জানল দীর্ঘ এবং জটিল এক অপারেশন। এমনিতেই নাকি দেরি করে ফেলেছে ওরা। কারণ নিষ্ক্রিয় স্ত্রী অঙ্গে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সব থেকে ভয়ের কথা পেশেন্টের নিজের বেঁচে থাকার অনীহা!!
মেঘনা টের পাচ্ছে শূন্য হয়ে যাচ্ছে চারপাশে। গলা শুকিয়ে কাঠ। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে প্রিয়াংশুর কেবিনের দরজায়। ঘুমোচ্ছে প্রিয়াংশু। কত রোগা হয়ে গেছে!! চোখের নীচে গভীর কালি। আজ আর গেস্টহাউসে ফিরবে না ও। কাল ভোর সাড়ে পাঁচটায় ও.টিতে নেবে প্রিয়াংশুকে। মেঘনা জানে প্রিয়াংশু জেগেই আছে। মেঘনার যে অনেক কথা বলার ছিল…কেবিনের বাইরে ভিজিটরদের জন্য রাখা চেয়ারে বসে ক্লান্ত মনে ফোন চেক করতে থাকে, অনেক মিসড কল মা, বাবা, দিদি, শ্বশুরমশাই, একে একে কথা বলতে হয় সবার সাথেই।
কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল মেঘনার। -“চা খান একটু” শুনেই ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসে ও। রূপক!! অবাক হয়ে তাকায় মেঘনা “আপনি এখন? কটা বাজে” –“ভোর পাঁচটা। আসলে গতকাল রাতে আমিও মায়ের কাছে ছিলাম, ভাবলাম যাওয়ার আগে আপনার একটা খোঁজ নিয়ে যাই” চা হাতে নেয় মেঘনা। রূপকের মায়ের খোঁজ নেয়। “ মা ভাল নেই, লড়াই করছে, সাথে আমিও” বলে রূপক। লড়াই তো মেঘনাও করছে কিন্তু যার জন্য এই লড়াই সে কেন আগেই হার মেনে নিচ্ছে!! সিস্টার ডাকে মেঘনাকে। মিঃ বাসু আপনার খোঁজ নিচ্ছিলেন, আমরা বলেছি আপনি বাইরে বসে ছিলেন সারা রাত। প্রিয়াংশুকে নিয়ে যাবে ও.টি তে। মেঘনাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় প্রিয়াংশু। মেঘনা হাত বাড়িয়ে প্রিয়াংশুর হাতটা নিজের মুঠোয় নেয়। দুকূল ছাপানো নোনা জলের ঢেউ ভিজিয়ে দেয় ওদের দুজনকেই। হাত ধরে হাঁটতে থাকে প্রিয়াংশু মেঘনার। ও.টিতে ঢোকার আগে ফিরে তাকায় প্রিয়াংশু ওর মেঘের দিকে। এবার কিন্তু সেই দৃষ্টিতে ফিরে আসার আকুলতা দেখে মেঘনা। বন্ধ হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটারের দরজা। ফিরে এসে চেয়ারে বসে ও। সিস্টার একটা চিরকুট এনে দেয়, “মা সিরিয়াস তাই চলে গেলাম, যে কোনো প্রয়োজনে ফোন করবেন” একটা নম্বর দেওয়া নীচে। ব্যাগে রেখে দেয় মেঘনা। ওটির দরজায় লাল আলো জ্বলে ওঠে। মনে মনে নতুন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অনন্ত অপেক্ষা শুরু হয় মেঘনার…. আরোগ্যের, আরোগ্য ওর ভালোবাসার মানুষটির, ওর ভালোবাসার।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri