ডিনার সেট
ডিনার সেট
শিঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়
~~~~~~~~~~~~
হাল্কা নীল বর্ডার দেওয়া সাদা ডিনার সেটটা দেখে আজ অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল তিস্তার। সংসার জীবনের একদম শুরুতে অনেক দোকান ঘুরে পছন্দ করে ও আর অরুণ এই ডিনার সেটটা কিনেছিল। অরুণের প্রফেশন এবং জীবনযাত্রার সাথে মানানসই খুব আভিজাত্যপূর্ণ ডিনার সেটটা। অরুণ খুব শৌখিন প্রকৃতির একজন মানুষ। গতানুগতিক জীবন ওর তেমন পছন্দের ছিল না। টেবিল সাজিয়ে এই ডিনার সেটে রকমারি পদ রেঁধে পরিবেশন করে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছিল তিস্তা। নানা ধরণের স্যুপ, ডেজার্ট এবং চিকেনের রকমারি আইটেম রেঁধে ডিনারসেটে সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করাটা একসময় ওর হবি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ কেউ আসা মানেই নতুন ডিনার সেট।
সময় খুব দ্রুত বয়ে যায়। আজ ওদের সংসার জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত। যাদের সাথে নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল আজ তারা অনেকেই নেই। আবার অনেক নতুন সদস্য বেড়েছে পরিবারে। যেমন ওদের একমাত্র ছেলে ঋজূর বউ দিয়া আর তাদের মিষ্টি মেয়ে তিতির।
সংসার যাত্রাটা সবসময় যে শৌখিন, মসৃণ ছিল তা নয়। ঋজু হওয়ার পর থেকে নিজেদের ছোট্ট ছোট্ট শখ আহ্লাদগুলো নিজেদের অজান্তেই চাপা পড়ে গেল। সংসার আর ছেলে বড় করার দায়িত্ব পুরোপুরি তিস্তার ওপর ছিল কারণ অরুণের অফিসের চাপ ভীষণ ভাবে বেড়ে গেছিল। যাইহোক নিজেদের মূল্যবান সময়গুলো হারানোর বিনিময়ে ছেলেটা যে ভালো মানুষ হয়েছে এতেই তিস্তার তৃপ্তি।
আজ প্রায় ত্রিশ বছর বাদে ডিনার সেটটা বের হল। নতুন বাসনের নীচে চাপা পড়েছিল। একসময়ে অতিথি আপ্যায়নের জন্য যেটা অপরিহার্য ছিল আজ সেটা চাকচিক্যবিহীন অপাঙক্তেয় একটি জিনিষ।
আজকাল কেন জানিনা তিস্তার নিজেকেও সংসারে বড্ড অপাঙক্তেয় মনে হয়। একসময় তাকে ছাড়া এই সংসার অচল ছিল। এখন কেমন যেন কমজোরী, দিশেহারা লাগে নিজেকে। মনে হয় আর কিছু পাওয়ার নেই, এখন শুধু হারানোর সময়। মাঝেমাঝে অরুণের ওপরেও খুব অভিমান হয়। বিকেলে পার্কে কিছু অবসরপ্রাপ্ত মানুষজনের সাথে আড্ডা আর বাড়িতে থাকলে খবরের কাগজ পড়া, টি.ভি. দেখা ব্যাস! দরকার ছাড়া তিস্তার সাথে আর কোন কথা নেই।
তিস্তার খুব মনে পড়ে তাদের নতুন সংসার জীবনের কথা। যখন দুজনে একটু একা সময় কাটানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত। অরুণের সাথে কোন পার্টিতে যাওয়ার সময় তৈরি হওয়ার পর আয়না দেখার প্রয়োজন হত না। অরুণের চোখের চাউনিতে ও বুঝে যেত ওকে কেমন দেখাচ্ছে। ছোটখাটো আনন্দ, সারপ্রাইজ ওকে সংসারতরণী ঠেলার এনার্জি যোগাত। সময়ের সাথে সাথে দুজনের সেই মুহূর্তগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সাংসারিক কেজো কথায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওরা দুজন।
তবে ছেলে, বউমা, নাতনি ওদের আগলে রাখে। আজ ওদের উদ্যোগেই তিস্তা অরুণের পঁয়ত্রিশতম বিবাহ বার্ষিকী পালন হচ্ছে। দিয়া আর ঋজুর পাগলামির শেষ নেই। রীতিমত প্ল্যান করে অরুণ আর তিস্তার পুরনো বন্ধুদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদের নেমন্তন্ন করেছে। অরুণ আর তিস্তার পুরনো পছন্দের গান সারাদিন বাজিয়ে চলেছে। অরুণ এবং তিস্তাকে জোর করে সাজগোজ করতে বাধ্য করেছে। ওদের পছন্দের সব মেনু দিয়া নিজের হাতে রান্না করেছে। দুজনের পুরনো পছন্দের পারফিউম কিনে এনেছে। তিস্তা মন থেকে এই আনন্দযজ্ঞে সামিল হতে পারছে না কারণ অরুণের উদাসীনতা তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে তাদের মধ্যেকার ভালোবাসা হয়তো হারিয়ে গেছে।
যাইহোক তিতির এসে যখন বায়না ধরে বলল, "ঠাম্মা, তোমার সেই ডিনার সেটটা বের করো না, যেটাতে করে সুস্বাদু খাবার সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করে তুমি সবাইকে তাক্ লাগিয়ে দিতে।"
লজ্জা পেয়ে তিস্তা বলে, "এত নতুন বাসনের চাপে সেটা কি আর অটুট আছে?"
দিয়া আর তিতিরের জোরের কাছে হার মেনে নিয়ে তিস্তা বাধ্য হল তাদের শখের ডিনার সেটটা বের করতে। দামি ডিনার সেটটা জৌলুষ হারিয়েছে তাদেরই মতো। দিয়া ডিনার সেটটা ধুয়ে মুছে সাফ করে তিস্তাকে বলল, "আজ তুমি টেবিল সাজাবে"। বন্ধুরা সবাই যখন এল, অরুণ একগোছা বেলিফুলের মালা তিস্তাকে উপহার দিল, সাথে তিস্তার প্রিয় চকোলেট। তিস্তার এসব ছোটখাটো পছন্দের কথা অরুণ আজও মনে রাখে! সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। অরুণ বলল, "একদিনের অনিয়মে সুগার বাড়বে না।" তিতির এসে বলল, "আরে ঠাম্মা, একটা ফ্লাইং কিসি ছুঁড়ে দিয়ে দাদাইকে থ্যাঙক ইউ বল!" সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। তিস্তার মনে হল ভালোবাসা একবার দানা বাঁধলে তা আর হারায় না, মাঝে মধ্যে অনিয়ম করে তাকে অনুভব করতে জানতে হয়। ও অরুণকে বলল, "দ্যাখো এত চাপে থাকা সত্ত্বেও ডিনার সেটটা তে কোন চিড় ধরেনি। ঠিক আমাদের সম্পর্কের মতোই অটুট।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴