এই অস্থির সময়ের ভয় ভাবনাগুলোকে আপাতত দূরে সরিয়ে একটু হেসে নিতে হলে, আমার সঙ্গী হয়ে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ অনেকগুলো বছর....
প্রায় একমাস ধরে দু'বেলা করে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার চাপের শেষে মন যেন প্রজাপতির আনন্দে ডানা মেলেছে তখন। ছোটখাটো সবকিছুতেই তখন আনন্দ আর আনন্দ। এই আনন্দের সবচেয়ে মিষ্টি সঙ্গী নিঃসন্দেহে প্রিয় বন্ধুরা..যাদের ছাড়া যে কোনো আনন্দই কিছুটা হলেও অপূর্ণ থেকে যায়। সবাই মিলে আনন্দ ভাগ করে নিয়ে কিছুটা সময় একসাথে কাটাবো বলে, আমি ও আমার বান্ধবী শুভ্রা সেসময়ের এক অলস মন্থর দুপুরে রওনা দিয়েছিলাম আমাদের আরেক বান্ধবী শিখাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সেটাই আমাদের দুজনের প্রথম বাড়ির বড় কাউকে ছাড়া এমনভাবে ঘুরতে বের হওয়া। শিখাদের বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। প্রথমে অকারণ আনন্দে কিছুটা হেঁটে হেঁটে সময় কাটিয়ে তারপর রিক্সায় কথার ফুলঝুরি আর অবাধ হাসির জোয়ারে ভেসে আমরা ঠিকানা অনুযায়ী নির্দিষ্ট জায়গার কাছাকাছি পৌঁছলাম। এদিকটা পুরো অচেনা আমাদের। তাই হারা উদ্দেশ্যে একে ওকে জিজ্ঞেস করে ওদের বাড়ির খোঁজ করছিলাম আমরা।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, শিখাদের বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল আমাদের আরেক বান্ধবী পিয়ালীর বাড়ি। ওরা দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিল আর সবসময় একসাথে থাকত বলে ওদের সবাই জোড়াশালিখ বলত। শিখা আমাদের বলে দিয়েছিল ওদের বাড়ি চিনে নিতে বাড়ির বড় কারো নাম না বলে ওদের দুজনের ডাকনাম 'বকুল' ও 'পিঙ্কু' বলে খোঁজ করলেই সহজেই ওদের বাড়ির হদিশ মিলবে। আমরাও তাই শুরু থেকেই সেভাবেই প্রশ্ন করছিলাম। শেষপর্যন্ত একজন প্রৌঢ় ওদের নাম শুনে বললেন ওরা ওনার প্রতিবেশী। এতক্ষণের খোঁজাখুঁজির পর ওনার সাথে গন্তব্যে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম আমরা। নির্দিষ্ট বাড়িটির উঠোনে পৌঁছে আমাদের দেখে এগিয়ে আসা এক ভদ্রমহিলাকে ঐ প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, 'বকুল আছে? এরা ওর খোঁজ করছে', আর খানিকটা গলা তুলে 'পিঙ্কু' 'পিঙ্কু' করে ডাক ছেড়ে বললেন, 'এই যে, এই পাশের বাড়িটাই পিঙ্কুদের। আমাদের আনন্দ আর ধরেনা!! এগিয়ে গিয়ে মাতৃস্থানীয়াকে ও আমাদের ত্রাণকর্তাকে ঢিপঢিপ প্রণাম ঠুকলাম দুজনে। মুখে একরাশ বিরক্তি ও চোখে কেমন একটা সন্দেহ নিয়ে মহিলা প্রশ্ন করলেন 'তোমরা বকুলকে চেনো?' আমাদের ঘাড় হেলিয়ে যুগলবন্দীর মাঝেই সামনের একটা ঘর থেকে আমাদেরই বয়সী অদ্ভুতদর্শন এক তালপাতার সেপাই হেড়ে গলায়, 'কে এসেছে', 'কি হয়েছে' করে বেড়িয়ে এল। ইতিমধ্যে সদর দরজা দিয়েও হাজির হলো আরেক নায়ক। আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা পথপ্রদর্শক ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, 'এই তো পিঙ্কুও এসে গেছে'। ভদ্রমহিলা ও দুই নায়কের মুখের অবস্থা তখন ছিল দেখার মতো আর আমাদের মুখের কি অবস্থা হয়েছিল তার বর্ণনা হয়ত সেসময় ওনারাই ভালো দিতে পারতেন!! ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতেই আমরা বুঝেছিলাম, ঘটনাচক্রে আমরা 'বকুল' ও 'পিঙ্কু' নামে দুটো ছেলের বাড়িতে চলে এসেছি.. সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে যারা শিখা ও পিয়ালীর মতো পাশাপাশি বাড়ির সমবয়সী বন্ধু। আজ থেকে প্রায় অনেকগুলো বছর আগে এভাবে বাড়ি বয়ে মেয়েরা ছেলেদের খোঁজ করতে গেছে.. এটা আশ্চর্যেরই ছিল বৈকি। তাই সমস্তটা বুঝবার পর ওদের ব্যবহার অবাক করেনি আমাদের।
ঘটনার বিড়ম্বনাকে ছাপিয়ে ততক্ষণে আমাদের হাসি বাঁধ ভাঙার উপক্রম করেছে। কোনোমতে ওদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাসির যত প্রকারভেদ আছে, সবরকম হাসি পাগলের মতো হেসেছিলাম আমরা দুজন মিলে....
শেষপর্যন্ত একজনের সাহায্যে শিখাদের বাড়িতে পৌঁছে বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা অনেকখানি রাস্তা এগিয়ে ভুল ঠিকানায় পৌঁছে অনেকটা সময় পার করে ফেলেছি। দিনের বাকি সময়টুকু আনন্দ, গল্প, কথা, মুখরোচক খাওয়া দাওয়ায় খুব সুন্দর কেটেছিল সেদিন। সবকিছুর মাঝেও ঘুরে ফিরে আমাদের ঐ মজার অভিজ্ঞতার গল্পই উঠে আসছিল আর হাসির তুফান উঠছিল থেকে থেকে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের স্মৃতির পাতায় যোগ করেছিল একটি আনন্দমুখর হাসিখুশি দিন।
২০২০ তো অনেক ভালো কিছু কেড়ে নিয়ে অনেক আশংকা, বিপর্যয়, বিপন্নতা, মৃত্যুর সাক্ষী রাখল আমাদের.... তবুও ইতিবাচক ভাবনায় থেকে মনে আনন্দ ও মুখে হাসি নিয়ে বরণ করে নিতে হবে নতুন বছরকে। 'হাসি', যার ভাষা সকলেই বোঝে, যা সমস্ত আনন্দের বহিঃপ্রকাশ.. সেই হাসি বেঁচে থাকুক সকলের মুখে। আনন্দময় হোক আগামীর পথচলা।