ঝাঁকুনি
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
--------------------------
এবার সত্যিই চিন্তা হতে লাগল। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে প্রমিত। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল বসে থেকে। একের পর এক ট্রেন বেরিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে দ্রুত। এদিকে হরিশের কোন দেখা নেই। লোক প্রায় নেই বললেই চলে। হাতেগোনা কয়েকটি লোক আর তল্পিতল্পা গোছাতে থাকা কয়েকজন হকার ছাড়া আর কেউ নেই লালগড় স্টেশন চত্বরে। স্টেশনের বাইরে আলো খুব কম। স্টেশনের হ্যালোজেনগুলোই যা আলো ছড়াচ্ছে।
একটা ছাগল প্রমিতের কাছাকাছি এসে একটা পাতা খাচ্ছে। এমন নিস্তব্ধতায় পাতা চিবোনোর শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। প্রমিতের ছটফটানি বেড়েই চলেছে। পায়চারি করতে লাগল উত্তেজনায়। হঠাৎ শোনা গেল ট্রেনের হুইসল। একটু আগেই স্টেশনমাস্টারের কাছে শুনেছে, এটাই শেষ ট্রেন। কী হবে এবার! হরিশের ব্যাপার কী!
হতাশ হয়ে বসে বসে শেষ ট্রেনটির চলে যাওয়া দেখল। এবার যেন ঝুপ করে অনেকটা অন্ধকার নেমে এল এই চত্বরে। পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে পাশে রাখল।
হরিশ হন্তদন্ত হয়ে এল।
"শেষ ট্রেনটিও বেরিয়ে গেল প্রমিতদা? "
প্রমিত অসহায়ভাবে মাথা নাড়ল। রাগ হলেও মুখে কিছু বলল না।
" সরি, বড্ড দেরি হয়ে গেল"।
" এখন কী করা যায়! স্টেশনেই রাত কাটাতে হবে?" জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল হরিশের দিকে।
" চলো, দেখি রুমতিদের বাড়িতেই একটা ব্যবস্থা করব। একটু কষ্ট হবে এই আর কি!"
প্রমিত চমকে উঠলেও ভাবল, কী বলা যায়! ওদের তো দিন আনতে পান্তা ফুরায়। এহেন অবস্থায় আরো দু'জন গিয়ে উদয় হলে কী হবে সহজেই অনুমেয়। হরিশকে কিছু বলা যাবে না। ও দুঃখ পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের জুনিয়র হরিশ রুমতিকে ভালোবাসে। একই গাঁয়ের মানুষ। হরিশের বাবা-মা নেই। এক দাদাও এখান থেকে চলে গেছে। তাই এখানে এলে রুমতিদের বাড়িতে দেখা করে। রুমতিরা খুব গরিব, আর পাঁচটা এখানের বাসিন্দাদের মতো। ওর বাবা, মা বিড়ি বাঁধে। ওদের পাতাছাওয়া ঘর। ঘর না বলে কুটির বলাই সঙ্গত। তবে হরিশের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা বাড়িতে জানে। কিছু একটা হলেই হরিশ ওকে বিয়ে করবে, এ পর্যন্ত ঠিক আছে।
হরিশের সাথে হেঁটে যেতে যেতে, প্রমিতের চোখ পড়ল আকাশে। মেঘের আড়াল থেকেও চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। কাল লক্ষ্মী পুজো। মাইলখানেক হেঁটে পৌছানো গেল রুমতিদের বাড়িতে।
রুমতির বাবা বাইরে বসে আছে। গ্লাসে করে কিছু একটা খাচ্ছে। প্রমিতের বুঝতে অসুবিধে হল না। হরিশ কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিল।
ওদের দেখে কিছুটা চমকে উঠল রুমতির বাবা।
" আরে! ট্রেইন মিস্ হই গ্যাছে বা"?
"হ্যাঁ। আজকের রাতটা এখানেই কাটাতে হবে। ভাবলাম স্টেশনে থাকার চাইতে......।"
" হা হা, ঠিক ঠিক। কেনু স্টেশনে থাইকবে। কষ্টো করিয়ে ইধারেই থাইকবে।"
কথাবার্তা শুনে হাতে একটা কুপি নিয়ে একটি মহিলা ও যুবতি বেরিয়ে এলেন। আবছা অন্ধকারেও প্রমিতের চোখ এড়ায় না যুবতীটির লাবণ্য।
রাতে সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ে হরিশ ও প্রমিত, এক ঘরে। অন্য খুপড়িতে রুমতি আর ওর মা। কিছুতেই ঘুম আসে না প্রমিতের। হরিশ বেশ নাক ডেকেই ঘুমোচ্ছে। প্রমিত দেখে এগারোটা বাজতে চলেছে। ঝিঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। গুটি গুটি পায়ে বাইরে এল।
রুমতির বাবা, দাওয়ায় বসে তখনো বিড়ি বাঁধছে। প্রমিতের খুব ইচ্ছে হল ওনার সাথে বসতে।
তারপর কীভাবে যে ভোর হয়ে গেল টেরই পাওয়া গেল না। প্রমিতও সে রাতে প্রথমবার সেই পানীয়তে চুমুক দেয়। রুমতির বাবার সারল্য, পরিশ্রম আর জীবনধারণকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে। কী সহজে মানুষকে আপন করে নিতে পারেন। কী নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও কী অমায়িক আতিথেয়তা। হৃদয় নিংড়ানো আন্তরিকতা। প্রমিতের মনে হচ্ছিল, জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতটি আজ ও কাটাল জঙ্গলে ঘেরা এই পর্ণকুটিরে। জীবনপাঠের প্রথম অধ্যায়টিও সে আজই অধ্যয়ন করল।
ফেরার ট্রেনে বসে মনে পড়ছে রুমতির বাবার কথা "মানুষ হইয়ে যারা মানুষের কথাই ভাইববে না, তারা কিমন মানুষ! ও তো দো পাইয়া জন্তু আছে। এত্ত লোভ কিনো আছে! জঙ্গল সব কাটি ফেলাইছে! মানুষকেও ছাইড়তেছে না! ইমন শিক্ষিত্ হবার চেয়ে অশিক্ষিত্ থাকাই তু ভালো আছে!"
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে খবরের কাগজের প্রথম পাতাটা দেখতে দেখতে, প্রমিতের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল "দো-পেয়ে জন্তু।"