জলরঙের দিন
দেবপ্রিয়া সরকার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ঝমঝম,
ঝিরঝির, টিপটাপ...অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে গত দু’দিন ধরে। গুড়গুড়
করে মেঘের চাপা গর্জন কানে যেতেই ঘুমটা ভেঙে গেল প্রিয়মের। চোখ মিলে দেখল
খোলা জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি হাওয়ার
ঝাপটায় ঘরে ঢুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে পাশের টেবিলে রাখা কাগজ-কলম, বইপত্র।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে প্রিয়ম ছুটে গেল জানালাটা বন্ধ করতে। কিন্তু
কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই থমকে গেল। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল বর্ষার রূপ।
প্রিয়মের
ঘরের পাশে ছোট্ট সীমানা প্রাচীর আর তার পরেই বেশ খানিকটা ফাঁকা মাঠ। মাঠের
চারধারে সারিবদ্ধ অজস্র ছোটবড় গাছ। বৃষ্টির দাপটে সাদা হয়ে আছে চারপাশ।
অবিরাম বর্ষণে ভিজে চলেছে গাছগুলো। ছোটখাট একটা পুকুরের রূপ নিয়েছে মাঠটা।
বৃষ্টির এই শব্দ-গন্ধ-ছবি একেবারেই নতুন প্রিয়মের কাছে। ডুয়ার্সে এটাই তার
প্রথম বর্ষা।
এতদিন বর্ষা মানে প্রিয়ম জানত দু’ চারটে
দিন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি, কাদা প্যাচপ্যাচে পথঘাট। কলেজ ফেরতা প্রেমিকার
সঙ্গে কাকভেজা হয়ে ফুটপাতের টক-ঝাল ফুচকা অথবা পাপড়ি চাট। খুব বেশি হলে
নির্জন পার্কে গাছের আড়ালে আর্দ্র ঠোঁটে ছোট্ট কামড়। কিন্তু বিনীতার সঙ্গে
ব্রেকআপের পর বর্ষা তার কাছে শুধুই একটা ভেজা ভেজা মনখারাপের ঋতু। মেঘলা
মনকেমনের আষাঢ়-শ্রাবণও যে এমন সুন্দর হতে পারে ডুয়ার্সে না এলে জানাই হত না
প্রিয়মের।
-ডুয়ার্সসসসস! এত্ত দূর! এটা চাকরি নাকি নির্বাসন?
মাস
ছয়েক আগে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে নিয়ে
এটাই ছিল প্রিয়মের প্রথম প্রতিক্রিয়া। কিন্তু কে জানত কয়েকমাস যেতে না
যেতেই সেই ডুয়ার্সের প্রেমে এমন হাবুডুবু খাবে প্রিয়ম? জনা পাঁচেক বন্ধু
জুটিয়ে ছুটে বেড়াবে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত; কখনও মেঘ-পাহাড়ের টানে, আবার
কখনও ভরা পূর্ণিমায় জঙ্গল দেখতে। পাহাড়ি নদীর কুলকুল স্রোত, সবুজ চা
বাগানের ভেতর ছায়া ছায়া পথঘাট আচ্ছন্ন করে রাখবে তার সকল ইন্দ্রিয়কে। আর
ঝিল? তার কথাও কি ঘুণাক্ষরে ভেবেছিল কখনও?
বিনীতার
কাছে ধোঁকা খেয়ে তখন খানিকটা দেবদাসের মতো মনের অবস্থা প্রিয়মের। কোনও এক
দৈবিক চমৎকারে বিনীতার এন আর আই পাত্রের হাত ধরে আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার পরপরই
চাকরিটা পেয়ে যায় প্রিয়ম। তেমন হাইফাই কিছু না হলেও সরকারি চাকরি, তারওপর
এস আই এর মতো সম্মানজনক পদ! নিজের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল
অনেকটাই। চাকরির সূত্রেই প্রথম ডুয়ার্সে এসেছে সে আর প্রথম দেখাতেই প্রেমে
পড়ে গিয়েছে জায়গাটার।
অফিস চালসাতে। তাই ভাবল
এখানেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থেকে যাবে আপাতত। স্থানীয় সহকর্মীদের সহায়তায়
জোগাড়ও হয়ে গিয়েছে একটা ছিমছাম বাসা। দোতলার ওপর মাঝারি আকারের শোবার ঘর,
অ্যাটাচড বাথরুম। অর্ধেক কাঠ আর অর্ধেক কংক্রিটের দেওয়াল। মাথার ওপর টিনের
চালা। কোণের দিকে রান্নার জায়গা। সঙ্গে কাঠের রেলিং দেওয়া একফালি বারান্দা।
তার একার পক্ষে যথেষ্ট। সব থেকে মজার বিষয় প্রিয়মদের বাড়িটাই ওই তল্লাটের
শেষ দোতলা বাড়ি। তারপর আছে ফাঁকা মাঠ, ছোটখাট দু’চারটে বাঁশের বেড়া দেওয়া
ঘর, গাছের সারি আর সেগুলোর পেছনেই দৃশ্যমান সবুজ পাহাড়। রাত্রিবেলা জোনাকির
মতো টিমটিম করে আলো জ্বলে অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে। বৃষ্টির পর তার কোলে
আশ্রয় নেয় সাদা তুলোর মতো মেঘ আর হাড়কাঁপানো শীতের রাতে ওই পাহাড়টার গা
বেয়েই নেমে আসে ঘোলাটে কুয়াশা।
এমনই এক নরম
কুয়াশামাখা দিনে প্রথম ঝিলকে দেখেছিল প্রিয়ম। সাতসকালে ছাদের ওপর গুনগুন
করে কী একটা গান গাইছিল সে। প্রিয়মদের একদম উল্টোদিকের বাড়িটা শুভমদের। মাস
তিনেক হল বাড়ি ভাড়া নেওয়ার। এরই মধ্যে শুভমের সঙ্গে বেশ ভাল দোস্তি হয়ে
গিয়েছে প্রিয়মের। কিন্তু তাদের বাড়িতে কখনও কোনও মেয়েকে দেখতে পায়নি এতদিন।
কুয়াশার পর্দা ঠেলে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল মুখটা। বয়স বাইশ-তেইশের আশেপাশে
হবে। কোমর পর্যন্ত খোলা চুল। পরে প্রিয়ম জেনেছিল শুভমের জেঠতুতো দিদি ঝিল
ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে ক’দিন হল। যাওয়া আসার পথে দু’চারবার
চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি কখনও।
প্রথম পরিচয়টা হয়েছিল
রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন, শুভমের মারফৎ। ঝিল সেদিন একটা কাঁচা হলুদ রঙের
জামদানি পরেছিল। সঙ্গে মানাসই গয়না আর মাথায় হলদে গোলাপ। গান গেয়েছিল বেশ
কয়েকটা। ঝিলের শান্ত স্নিগ্ধ রূপের পাশাপাশি তার গানও মুগ্ধ করেছিল
প্রিয়মকে। সেদিনের পরিচয়ের পর দ্বিতীয়বার ঝিলের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ
হয়েছিল তাদের বাড়ির কালীপূজোয়। প্রথম কথা বলেছিল ঝিলই, সারাক্ষণ এমন হাঁ
করে কী দেখতে থাকেন বলুন তো?
আশেপাশে কেউ না থাকলেও
ঝিলের কৌতূক জড়ানো প্রশ্ন বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছিল প্রিয়মকে। নিজেকে সামলে
নিয়ে বলেছিল, না মানে তোমাকে দেখি আর ভাবি এমন সুন্দর গান কীভাবে গাইতে
পারো? যদি ভগবান আমাদেরও এমন প্রতিভা দিতেন তাহলে কী ভালোটাই না হত। তা
আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতারা কি শুধু তোমার গান শুনে ভাললাগা জানিয়েই
ক্ষান্ত থাকে, নাকি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব টন্ধুত্বও করা হয়?
একটা
কঠিন ভ্রূকুটি করে তার দিকে তাকিয়েছিল ঝিল। মুখটা গম্ভীর করে বলেছিল,
বন্ধুত্ব হয় কিন্তু এত সহজে না। এর জন্যে অপেক্ষা করতে হয় কিছুদিন।
-অপেক্ষা! বেশ, কিন্তু কতদিনের?
-অন্তত মাস দুয়েক তো সময় লাগবেই ভাবতে।
-সে নাহয় লাগল। কিন্তু মাঝে সাঝে খবরাখবর নেওয়া, ভাবনার গতিপ্রকৃতি জানা এসবের জন্যে অন্তত ফোন নম্বরটাও যদি...
-উঁহু, তার দরকার হবে না। প্রয়োজন হলে আমিই যোগাযোগ করে নেব।
এমন
কাটখোট্টা উত্তরের পর ঝিলকে আর বেশি ঘাঁটানোর সাহস হয়নি প্রিয়মের। গত
দু’মাসে এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন ঝিলের কথা ভাবেনি সে। অবশেষে গতকাল
অজানা নম্বর থেকে একটা ফোন এসেছিল প্রিয়মের কাছে। রিনরিনে গলায় ঝিল বলেছিল,
আজ বাড়ি এসেছি। আগামীকাল কি দেখা হতে পারে একবার?
-হ্যাঁ অবশ্যই। কিন্তু তুমি আমার নম্বর...
থতমত খাওয়া গলায় বলে উঠল প্রিয়ম।
-এস আই সাহেবের ফোন নম্বর পাওয়াটা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। কাল শীতলা মন্দিরের সামনে ঠিক বিকেল পাঁচটায় আসব আমি।
কথাটুকু
শেষ করতে না করতেই ফোন কেটে দিয়েছিল ঝিল। মুহূর্তের মধ্যে প্রিয়মের মনটা
তরতাজা হয়ে গেল। যেন বুকের ভেতর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল এইমাত্র। রাতের
দিকে কানে আসছিল ঝিলের গলা। অতুলপ্রসাদী গাইছিল সে,
“বঁধুয়া, নিদ নাহি আঁখি পাতে
আমিও একাকী তুমিও একাকী আজি এ বাদল রাতে...”
আজকের
মেঘ-বৃষ্টির সকালে ঝিল মেঘমল্লার রাগে সুর ভাঁজছে তানপুরায়। বৃষ্টির
আওয়াজের দাপটে থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে সেই শব্দ। সারাদিন প্রকৃতির পাশাপাশি
রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজেছে প্রিয়মের মনও। তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ গুটিয়ে সে চলে
এসেছে মন্দিরের সামনে। বৃষ্টিটা সামান্য ধরেছে, তবে আকাশে মেঘ রয়েছে
যথেষ্টই। যে কোনও সময় আবার তেড়েফুঁড়ে নামবে শ্রাবণ।
ঝিল
এখনও আসেনি। তাই বাইকটা স্ট্যান্ড করে একটা সিগারেট ধরাল প্রিয়ম। আবার
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল। ফাঁকা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে সিগারেটে লম্বা লম্বা
টান দিচ্ছে প্রিয়ম। একটা স্লেট রঙের ছাতা হঠাৎই নজরে এল তার। ধীর পায়ে
হেঁটে আসছে ঝিল। পরনে গাঢ় নীল চুড়িদার। মুখোমুখি দাঁড়াতেই ঝিলের লাজুক হাসি
চোখ থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। আর তখনই আরেকবার গর্জে উঠল আকাশ।
নেমে এল বিদ্যুতের ঝলকানি। মেঘ ঘন হয়েছে আরও। টিপটিপ বৃষ্টি ততক্ষণে রূপ
নিয়েছে অঝোরধারার। প্রিয়মের মাথার ওপর ছাতাটা ধরে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেদের
প্রাণপণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে ঝিল। পাশের কদম গাছটা নুয়ে পড়েছে ফুলের
ভারে। হাওয়ায় ভাসছে কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ। কালো মেঘের হাত ধরে অসময়ে নামছে
সন্ধ্যা। একটু একটু করে ফুরিয়ে আসছে একটা জলরঙের দিন।