পাঙ্গা বটতলার কাছে পিচের বড় রাস্তাটা থেকে নেমেই গোকুলকে বললাম ভোর হতে দেরি নেই, গ্রামের পথ ধরতেই ঘুম ঘুম চোখে চায়ের দোকানে পাশে এসে দাঁড়ালাম। উনুনে বড় ডেকচিতে খিচুড়ি হয়ে গেছে আর ছোট মাছ ভাজা।
সদ্য গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর ঠিক করলাম ফরেন গুডস আর গিফট আইটেমের দোকান দেব। মেজদির গ্রামের বাড়ি পাঙ্গা বটতলা। তার কাছাকাছি রাণীনগরে বিএসএফ ক্যাম্প। জামাইবাবুর নিজস্ব জায়গা রয়েছে। আমি আর ভাগ্নে বিএসএফ ক্যাম্পে গেটের পাশে গিফট এর দোকান দিয়ে দিলাম। মনে আছে দোকান ওপেনিংয়ের দিনে প্রায় তিন হাজার টাকা সেল করেছিলাম। তখন রাণীনগরে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। কেমন একটা সন্ধে হলেই গা ছমছমে পরিবেশ। রাত্রি সাড়ে আটটার পরেই দোকান বন্ধ করে দিতে হত। তারপরে পাশাপাশি দোকানের মালিক- কর্মচারী, গ্রামের কিছু ছেলেরা বসে আড্ডা মারতাম। তাদের মুখে ভূতের কথা শুনেছি। আমি ভূতে বিশ্বাসী না বলব না। তবে হ্যাঁ দেখিনি। বুঝেছি। কয়েকবার আমার সাথে হয়েছে। রাতে আবার সেখানে চোরের উপদ্রব ছিল। তাই আমাদের গ্রুপ করে পাহারা দিতে হতো । এক একটি গ্রুপে বারো জন করে থাকত। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তরও দক্ষিণ দিকে তিন-চারজন করে আমরা রাত একটার পরে চলে যেতাম পাহারা দিতে। সপ্তাহে দুদিন আমার পাহারা দিতে হত। যেদিন পাহারা দিতাম সেদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে নিতাম। আর ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম। রাত একটার আগে দরজায় কড়া নাড়লে বুঝে যেতাম ডাকতে এসে গেছে। শুনেছি, নিশিরাতে একবার ডাকলে দরজা খুলতে নেই, দুবার কড়ানাড়ার পরে উত্তর দিয়ে দরজা খুলে দিতাম। এমন একদিনে চুপচাপ খেয়ে শুয়ে পড়েছি, রাত বারোটা হবে হয়ত। বিছানায় গুটিয়ে শুয়ে আছি। পুজোর পরে বলে ঠান্ডা লাগছিল। লাইট বন্ধ করিনি। এক সময় গোকুলের ডাক।
গোকুল পাশের দোকানে কাজ করে। খুব ভালো ছেলে। বয়স ষোলো কি সতেরো হবে। আমায় খুব ভালবাসত। আমি ওর ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম। ডাক শুনে ধরফরিয়ে উঠি।
গোকুল নাকি?
হ্যাঁ!
কটা বাজে?
একটা বেজে গেছে।
উফফফ! ভালো লাগেনা।
গোকুল মুচকি হাসল। দেরী না করে চল। পাহারা দিতে হবে। ওদিকে নারায়ন কাকু, গোপাল কাকু, তাপস জেঠু, জীবনদা, মানুদা চলে এসেছে। আজ রাতে খিচুড়ি আর মাছ ভাজা। হিরোদা পুকুর থেকে জাল পেতে মাছ ধরেছে। চাল ডাল ধুয়ে সব রেডি। আজ আবার চারজন বি এস এফ জওয়ানও আমাদের সাথে খাবে। ঘুমঘুম কন্ঠে উত্তর দিলাম রাখ তোর পিকনিক। দরজায় তালা মেরে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। চায়ের দোকানের সামনে আসতেই নারান কাকু আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিল। রুক্ষ স্বরে বলল, এত ঘুম তোর! সবাই এসে হাজির। তোর ঘুম ভাঙ্গে না। রাগে ভেতরে গজ গজ করতে করতে বললাম কোন দিকে যাব আজকে। আবার গোকুলকে ধমক দিয়ে বলল, অক্ষণ দাঁড়ায় আছোস কেন? যা পূব দিকে যা। পূব দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চ মেরে এদিক-ওদিক দেখছি। একটা খসখস শব্দে হঠাৎ চমকে উঠি। দোকানের পাশে কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে দুটো কুকুর। কি ব্যাপার এত রাতে? সামথিং রং? বিএসএফ জওয়ানের গলাটা শুনে বলে উঠলাম, "এয়সা কোই বাত নেহি, এক হপ্তা মে দোবার চোরি হুয়া, চোর পকড়না হ্যাঁয়। ইসলিয়ে পহেরা দে রাহা হু।"
বিএসএফ জওয়ানরা আমাকে আবার রাজ বলে ডাকত। কারণ তারা আমায় চিনত। আমার দোকানে অনেক জওয়ানরা এসে বসত, তাদের পরিবারের কথা, জীবন সংগ্রামের কথা, যুদ্ধের কথা বলত। কখনও সুখ-দুঃখের গল্প করত। যাইহোক, রাত আড়াইটে বেজে গেছিল। সেদিন আর পাহারা দিতে ইচ্ছে করছে না। সাথে দুজন মাতাল এসে যোগ দিতেই আমার মাথা গরম হতে শুরু করে। আমি গোকুলকে বললাম চল হিরোদাদাকে গিয়ে বলি ঘুম পাচ্ছে, চা বানাতে । চা খাবো। প্রসঙ্গত আমাদের পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি রাতে খাবারের ব্যবস্থা হত। চা, মুড়ি মাখা, খিচুড়ি, অমলেট, মাছ ভাজা, আলু ভাজা। আবার স্পেশাল ছিল মাংস-ভাত। তাই আর বেশি দূরে না গিয়ে চলে এলাম। চায়ের দোকানে বড় উনুনে সকালে পুরি ভাজা হয়। আর সে উনুনে আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা হত। এতে আমরা পাহারা দিতে উৎসাহিত হতাম। জীবন মুড়ি মাখতে আমাকে বলল। আমি মুড়ি চানাচুর মেখে, কাগজের ঠোঙ্গা করে তাতে সবাইকে দিলাম। জীবন চা বানাল। গোপালদাকে বলল খিচুড়িটা তোমার ডিপার্টমেন্ট। হঠাৎ দেখি একজন বিএসএফ দোকানের কাছে এসে দাঁড়াল, হাতে বোতল। কিছু বোঝার আগেই গোপালদা খুন্তি ফেলে দিয়ে বোতল নিয়ে দিল দৌড়। আর ওই জওয়ানও পিছন পিছন দৌড়। মানুদা আবার শান্তভাবে সাইকেল নিয়ে পিছন পিছন চলল। আমরা চা খেয়ে যে যার মত পাহারা দিতে চলে গেলাম।
এরপর আমরা ফিরে আসতেই খিচুড়ি রেডি আর ছোট মাছ ভাজা হচ্ছে। যে যার মতন শালপাতা নিয়ে বসে পড়লাম। মানুদা খিচুড়ি পরিবেশন করল। খিচুড়ি মুখে না দিতেই হিরোদা বলে উঠে এটা খিচুড়ি না পায়েস। চিনি দিয়ে ভরে রেখেছ। লবণ কোথায়? তাই তো। এত পায়েস নয়,অখাদ্য। আর মাছ ভাজাও চিনি দিয়ে ভরা। গোপালদা কাচ্চি খেয়ে সব ওলট পালট করেছে। লবনের প্যাকেট নিচে পড়ে আছে। আর সব চিনি ঢেলে দিয়েছে খিচুড়ি ও মাছ ভাজাতে। এরকম ঘটনা প্রায়ই আমাদের মধ্যে অনেকের হয়ে থাকে। গোপালদা দেশী খেয়েও তার দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি, যতদিন পাহারা দিয়েছিলাম। গোপালদাকে রাঁধতে দেখেছি, এবং হাসিমুখে পরিবেশন করতেও। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও ঐ ঘটনা এখনো মনে হয় সেদিনের। ওই দিনগুলো আমি খুবই এনজয় করেছিলাম। তবে একটা কথা স্বীকার করছি, চোর ধরতে গিয়ে কখন যে আমিও ওদের সাথে পুকুরের মাছ, মুরগির ডিম, গাছের ফলও চুরি করেছিলাম। ভাবলে এখন লজ্জা লাগে। তবে ওইসময় নিছক আনন্দের জন্য আমরা করতাম। সত্যি, চোর ধরতে গিয়ে আমরাই চোর হয়ে গেছিলাম।