ঝিমানডাঙার বামনীঝোরার তিরতিরে জলে গা- ধুয়ে ঘরে ফিরছিল চানমনি ওঁড়াও। ফি বছর ক্ষেত মাড়িয়ে যায় মহাকালের দল। কখন পথ রুখে দাঁড়ায় - ছমছমা মন চানমনির । দিনের বেলা ধানের খলানে নজর উড়ায় চানমনি, রাত ঘনালে টংঘরে বীটবাবুর বিলানো চকলেট বোম নিয়ে ধান পাহারা দেয় জগনু ওঁড়াও। রাত ঢললে চিমাইবস্তির পেছনের টিলার ঢাল বেয়ে নামে দাঁতালের দল। পা মাড়িয়ে, মাটি খুবলে, ধান উপড়ে মাইল ধরে জমি ডলে চলে যায় মহাকালের দল। আগের মত
পটকা-মশালে ডরায় না হাতিরা।
এবছর রবি এক্কা ধানের বদল আলু চাষের বুদ্ধি দিয়েছিল জগনুকে। সব জমিতে সব ফসল ঠিকমতো হয় না। তবু ধানের বদলে আলুর চাষ করেছিল ঝিমানডাঙা বনবস্তির চাষিরা। মহাকালও আবার স্বাদ বদলেছে। এবছর আলুও ছাড়েনি।
এসব বছরের গল্প। সেবার ভোট গেলে ঐ অঞ্চলের প্রধান বদল হল। নতুন প্রধান ভুটভুটি চড়ে বাড়ি বাড়ি ফিরে টিপসই নিয়ে হাজার করে টাকা বিলায়। শনিবার করে বাতাবাড়ি হাট শেষে বিলাতী মদ খাওয়ায় এলাকার মরদগুলোকে। ফ্রীতে বিলাতি গিলে উদ্দাম আনন্দে মাতে পুরুষেরা। পরদিন 'দেওবার'। রবি এক্কার খলানে মিটিং বসে। নতুন প্রধান বলে - এলাকায় উন্নয়ন হবে। বিজলীবাতির খাম্বা বসবে। নালা হবে। নালা হলে মহাকালের অত্যাচার আটক হবে। আর এখানে রিসর্ট হবে। শহরের বহু মানুষ আসবে রোদ পোহাতে। ওখানে এলাকার মানুষ কাজ পাবে। জমিগুলো লিজে নিবে বড়লোকেরা। টাকাও দেবে মেলা। কাজ হবে। টাকা হবে। সাঁইনঝেরবেলা নাচ হবে। গান হবে। দলবেঁধে আসর বসবে। বাইরের বাবুরা টাকা ছিটালে ধান-আলুর সমস্যা থাকবে না। মহাকালবাবার অত্যাচার বন্ধ হবে।
রাতের বেলা জগনু মিটিঙের সব কথা চানমনিকে বলে। জমি যে বাপঠাকুরের আদরের ধন। পাকা ঘর উঠলে মাটি পাব কই- আনচান করে জগনুর বুকটা। হাতের বাঁধনে এসে চানমনি বলে- এরকমই কোন পাকা ঘরে ওদের গ্রামের এক মহিলার গাল ধরে আহ্লাদ করেছিল এক শহরের বাবু,,সে নিয়ে বিরাট 'কিচাইন' হয়েছিল ওদের গ্রামে। চুপ করে থাকে জগনু। আবার চানমনি জানতে চায়- 'রিচর্ট '-কি রে জগনু,,? একসময় জগনুর উদলা গতরে ঘামসুখের গন্ধ নিতে নিতে চোখবোজে চানমনি। বন্ধ চোখের উপর স্বপ্ন নাচে। চানমনি দেখে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল ওদের উঠোনে। লাল জামা, ছোট ছোট দুই বেণীর ডগায় সবুজ ফিতে আর হাতে কাঁচের চুড়ি। চানমনি ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিল তাকে। একসময় চানমনির গভীর উষ্ণ বুকজলে জগনু আদরের ডুব দিলে স্বপ্ন ভাঙে চানমনির।
অনেকক্ষণ ধরে একটা বিড়াল ডেকে চলেছে। ঐ বিড়ালের ডাকে ঘুম ভাঙার পর কুপিটা ধরিয়ে ঘরের বাইরে বের হয় দুজনেই। দেখে একটা বাচ্চা বিড়াল কেঁদেই চলেছে দরজার কাছেই। চানমনি কোলে তুলে নেওয়ার পর বুঝতে পারে- এ তো বড় বিড়ালের বাচ্চা।
- বলিস কিরে ? আঁতকে ওঠে জগনু।
- হ দ্যাখ গায়ে কেমন কালা কালা দাগ।
- হ, তাই ত , এটা ত চিতার বাচ্চা।
- চল চল ঘর লে চল, বাইরে ছাড়লে রাতে কুত্তাগুলা ছিঁড়ে লিবেক কচিটাকে।
- কাল সকালে বীটবাবুর কাছে জমা দিব।
বুকে আগলে ঘরে এনে বাচ্চাটাকে কাপড়ের ওম দেয় চানমনি। চিতার বাচ্চা নিশ্চিন্তে ঘুমোয় চানমনির কাছে।
পরদিন ভোররাতে দরজায় আওয়াজ পেয়ে ঘুমভাঙে জগনুর। দরজার খড়খড়া শব্দ আর নাগাড়ে দেশী কুকুরের ডাক। জগনু দরজার হুড়কা নামায়। খানিক ফাঁক দিয়ে দেখে বাইরে একটি চিতা। দরজা খোলার শব্দে চিতা গিয়ে দূর উঠোনে দাঁড়াল। জগনু হাতে বল্লম নিয়ে চানমনির সাথে মাটির বারান্দার সামনে আসে। কোলে চিতার বাচ্চা। ওটাকে কোল থেকে নামিয়ে পিছিয়ে আসে চানমনি। ততক্ষণে মাদীচিতা বাচ্চাটাকে মুখে নিয়ে সোজা জংগলে।হতভম্ব দুজন। ঘরের ভিতর এসে জগনুর বুকে ঝাঁপায় চানমনি,,আব্দার করে বলে-- মুর একটা বেটি ছওয়া লাইগবেক।
বেশ কটা রিসর্ট হয়েছে গ্রামে। এখানে ওখানে পাকা ঘর। ঘরে শহরের বাবুদের স্ফুর্তির ফোয়ারা ওড়ে। মাঝে মাঝেই উদ্দাম আনন্দ উল্লাসে ঘুম ভাঙে চানমনির। নানা লোভেও জগনুর জমি নিতে পারেনি কেউ। প্রধান অনেক বোঝালেও জমি দিতে রাজি হয়নি জগনু।পাশের জমিগুলোর দিকে উদাস চোখে তাকায় জগনু। এখন আর বেশী চাষ হয় না, তবু জমিন তো বাপ-ঠাকুর্দার। এ জমিতে ধনীরাম ওঁড়াও আর মালতী ঘর বেঁধেছিল। এই জমিতে জন্ম জগনুর। জমি দেয়নি লিজে। এই ঝিমানডাঙা, চিমাইবস্তি, বামনীঝোরার মাটিজলে জগনু-চানমনির জীবন যৌবন। এখানে এখনও সাঁইনঝেরবেলা মাদল বাজে দ্রিদিম দ্রিদিম তাং তাং। চানমনির কোমর দোলে সব মেয়েদের সাথে। হাড়িয়ার হাল্কা নেশায় মাদলে তাল ঠোকে জগনু। রাতের বেলার চাঁদের আলো গড়িয়ে যায় চানমনির উঠোনে। একসময় ক্লান্ত গতরে নরম সুখের ঘুম নামে চানমনি জগনুর নেশাতুর চোখ জুড়ে। চানমনি ফিসফিসিয়ে বলে- বেটির নাম দিব চান্দমালা ওঁড়াও।