"কী রে কী করছিস? এ কী কান্ড!"
চমকে উঠলাম। ভীষণ থতমত খেয়ে ততক্ষণে তোতলাতে শুরু করেছি।
"কক্কীছু না! এই একটু গোগ্গোছাচ্ছি"
চোখ তো নয় যেন অত্যাধুনিক স্ক্যানার মেশিন। স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। উত্তরটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হয়নি বোঝাই যাচ্ছে, মুখের উপর থেকে চোখটা সরিয়ে এবার ধীরে ধীরে সন্দিগ্ধভাবে ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগল। মার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তো নিজেই দেখতে পাচ্ছি, বিছানার উপর, মেঝেতে, চেয়ারে যত্ততত্র নানা দর্শনের, নানা জাতের বই-খাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কলমগুলোরও একই অবস্থা। এতদিন এরা গাদাগাদি করে নানা ভঙ্গীতে পরস্পরের গায়ে হেলান দিয়ে কতকটা নিশ্চিন্তে বহাল তবিয়তে ছিল। কিন্তু আজকে আমার দ্বারা সবাই বাস্তুচ্যুত। আমার গর্ভধারিণী কস্মিনকালেও আমাকে কিছু গুছাতে দেখেনি। সেজন্য অবাক হওয়ারই কথা। ভালো করে তাকালাম। নাহ্! অবাক হওয়ার চিহ্ন নেই মুখে-চোখে। বরঞ্চ চোখ দেখে মনে হল ভেতরের উদ্গত হাসি প্রাণপণ চেপে আছে। অবশ্য মুখে তার কোনো প্রকাশ নেই। উল্টে আমাকেই অবাক করে দিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
"কিছু খুঁজছিস মনে হচ্ছে, কী হারিয়েছিস?"
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
"ক্কই কিছু না তো! কী হারাবো আবার! বইগুলো এলোমেলো অগোছালো হয়ে আছে। ওরকম দেখলে পড়ায় মন বসে না। কদিন পরেই পরীক্ষা না! সেজন্য ভাবছি একটু গুছিয়ে নিয়ে পড়তে বসব।"
কথাটা বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। কিন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। কেমন যেন উদাসীনভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
"ও, আচ্ছা, আমি ভাবলাম কিছু হারাল কিনা। কখনো তো এত গোছগাছ করে পড়তে বসতে দেখিনি। এবারই তো আর প্রথম পরীক্ষা দিতে দেখছি না!"
মানে? আমি মনে মনে ভড়কে গেলাম। কথাটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি। হারিয়েছে তো বটেই। বললেই এখন কুরুক্ষেত্র করবে। আসলে হারিয়েছে তো পরীক্ষার অ্যাডমিটটাই। সেদিন এনে টেবিলটাতেই রাখলাম। বারবার মনে পড়ছে টেবিলেই রেখেছি। আমি মোটেও অত অগোছালো নই। সবকিছু বেশ যত্ন করেই রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু তবু হারাই। ভাবলাম আছেই তো, হারাবে তো না! এখান থেকে আর যাবে কোথায়! আস্তে-ধীরে ফাইলে রাখব। কিন্তু দ্যাখো তো কান্ড! রাখব রাখব করে ভুলে গেলাম আর এখন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।
অন্যমনস্ক হয়ে দুঃখের কথাগুলি ভাবতে ভাবতে দেখি মা কখন চলে গেছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার খুঁজতে শুরু করি। এর মধ্যে মা দুবার ঘুরে গেছে, কিছু বলেনি। পরেরবার এসে শুধু একটা শাড়ির টুকরো হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে গেছে,
"গোছাচ্ছিস যখন তখন টেবিলটার ধুলোগুলোও একটু মুছে নিস। পেছনের কোণা-কাঞ্ছিগুলো এই কাপড়টা দিয়ে একটু ঝেড়ে দিস তো।"
হায়রে! কাকে কী বোঝাব! এদিকে টেনশনে আমার মাথাখারাপ হওয়ার অবস্থা, মুখে প্রকাশও করতে পারছি না, আমাকেই বলে কিনা ঝাড়-পোঁছ করতে! কী আর করব, করি, এসবই করি আর কি, মুখে যখন বলতেই পারব না।
বেলা গড়িয়ে গেল। স্নান হয়নি, খাওয়া তো দূরের কথা। এখন খুব নার্ভাস লাগছে। এতক্ষণ বিশ্বাস ছিল পাবোই তো, ঘরেই কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস টলে গেছে। সব ওভাবেই অগোছালো রেখে মেঝেতে বসে পড়েছি। এতদিন যা যা হারিয়েছি সব মা খুঁজে দিয়েছে। তেমনি বকাও দিয়েছে। কিন্তু অ্যাডমিটটা মা কোথায় পাবে! সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই। মাঝখান থেকে বলতে গেলেই বকা খাব। দুদিন বাদেই পরীক্ষা! বিধ্বস্ত লাগছে। আবার দরজাটা ফাঁকা হল। মা! নিরুদ্বিগ্ন মুখে এসে বলল,
"যা স্নানে যা। তোর দ্বারা গোছানো হয়ে গেছে। আমাকে কাজ করতে দে।"
তারমানে মার রান্না শেষ। মাকে কী করে বোঝাই। তবু বলতে তো হবেই। পেলাম না যখন। বলতে গিয়ে আমার গলা বুঁজে এল কান্নায়। কোনোরকম ডাকতে পারলাম,
"মা!"
আশ্চর্য! মা হেসে দিল। ভুরু নাচিয়ে বলল,
"হুম! কেমন লাগছে এখন! কতবার বলেছি সব জিনিস ঠিকঠাক রাখতে। একবার হারালে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না! তা শোনে আমার কথা! যা স্নানে যা। আর গোছাতে হবে না, তোর অ্যাডমিট আমি রেখেছি। মালতী সেদিন টেবিলের তলায় ঝাঁট দিতে গিয়ে পেয়ে আমাকে দিয়েছিল। সেও চার-পাঁচদিন হল, আর তুই তো খুঁজতেই শুরু করেছিস আজকে! বোঝাই যাচ্ছে পরীক্ষা নিয়ে কত চিন্তা! যা, স্নানে যা এবার।"