সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
04-December,2022 - Sunday ✍️ By- সুদীপা দেব 220

গার্হস্থ্য স্রোত/সুদীপা দেব

গার্হস্থ্য স্রোত
সুদীপা দেব
===========

ঘুম ভেঙে সকালে দরজা খুলে দীনেশ দেখে ঝলমলে আলোর বন্যা। সোনালী রোদ ঠিকরে পড়ছে উঠোনের পশ্চিম দিকে রাখা ভ্যানের হাতলে। আকাশটা কী অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে! এত অপূর্ব নীল রং সে আগে কখনো দেখেনি। মা কালী, মাসানপাটের বাবা এদের কারো গায়ের রঙের সাথেই মেলেনা। দিগন্তজোড়া নীল মখমলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে দুধসাদা মেঘের স্তুপ। কী অপরূপ দৃশ্য! আহা,আকাশ তো নয় যেন স্বর্গের রূপসজ্জা।
স্বামীকে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মালতী বলে
–মাইনোর বাপ, কি করেন? মুখ হাত ধোন। কাজৎ যাইবেন তো?
–আকাশ খান একবার দেখ মালতী! সাদা ম্যাঘের রথৎ চড়ি মা দুগ্গা আসির ধইচ্চেরে। মন কয় পিথিবীটা আইজ কত সুখী!
স্বামীর কথা মালতীর মনে ধরে না। এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে সে বুঝেছে অর্থের অভাব না থাকলেই সুখ। ওইরকম ভাবের ঘরে সুখ থাকে না। মালতীর চোখেমুখে বিরক্তির গনগনে তাপ দীনেশের নজর এড়ায় না। মালতী বলে
–মা দুগ্গার সময় হইলে চলি আসে।ছাওয়ালগুলোর কাপড়-জামা তো হইল্ না এলায়ও। মোর কথাতো ছাড়িই দিলুঙ হয়।
মালতির বক্রবাণ না শোনার ভান করে দীনেশ কলতলায় যায়। ফিরে এসে চুপচাপ চা-রুটি খেয়ে নেয়। মালতীও আর কথা বাড়ায় না। সকাল সকাল স্বামীর সাথে বচসায় জড়াতে ইচ্ছা করে না। মানুষটা তো আর খারাপ নয়। একটু ভাবুক প্রকৃতির। ভ্যান নিয়ে আপন মনে গান গাইতে গাইতে গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছে যায়। শহরে এক ফার্নিচারের দোকানে সে বাঁধা কাজ করে। মালিকের ছেলে গত বছর তার পুরনো মোবাইল ফোনটা দীনেশকে দান করেছিল। ওটা সাথেই রাখে। সুবিধাও হয়েছে। দোকানের ভাড়া না থাকলে সে আর বসে থাকে না। কাছাকাছি অন্য কোথাও ভাড়া নিয়ে যায়। সময়মত মালিক ফোনে ডেকে নেয়। মালিক বিরক্ত যে হয় না তা নয়, তবে দীনেশের এই প্রয়োজনটুকু প্রচ্ছন্নভাবে মেনে নিয়েছে।
আজ মালতীর কথাগুলো দীনেশের বুকে কাঁটার মতো খোঁচা দিয়েছে। জগৎ সংসারে এইরকম কতশত খোঁচা লাগে। কখনো কখনো রক্ত ঝরে, ক্ষতও হয়। তখন গলায় সুর তুলে একা হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বালাভূতের চরে। হৃদয়ভেজা সুর গদাধরের ঢেউয়ে মিশে তার ক্ষতে প্রলেপ দেয়, তাকে শান্ত-পরিণত করে। দীনেশ ফিরে আসে বৃদ্ধ মা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কাছে, ফিরে আসে শহরে তার মালিকের কাছে। এই তো সেদিন, ভ্যানটা একটু আড়াআড়িভাবে দোকানের সামনে রেখে ছিল। এক বাইকওয়ালা বাবু তাকে যথেচ্ছ গালাগাল করে। মুখে কুলুপ এঁটে দীনেশ ভ্যান সোজা করে বাইক রাখার জায়গা করে দেয়। বাইরের লোকের খিস্তিখেউড় গায়ে মাখা কী সবসময় মানায়!
জামা প্যান্ট পড়ে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। একমনে প্যাডেল চালায়। কিভাবে যে বাড়ির সবার জামা কাপড় জোগাড় হবে এখন এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
নয় বছরের মেয়ে ছোট ভাইয়ের হাত ধরে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। তাদের নতুন জামা দেখে এসে মায়ের কাছে অনুযোগ করে
–মাও , নতুন জামা কুন দিন কিনিম? গেরামের সগায় কিনির ধইচ্চে।
পূজার তিন দিন বাকি। নতুন কাপড় কিনতে না পারার অক্ষমতা ঢাকতে মালতী ধমক দিয়ে বলে
–মাইনষের জিনিস দেখি বেড়াইস শরম নাগে না তোর? নিজের যদু ছিড়া কাপড় থাকে তো তাই পিন্দি ঠাকুর দেখবু। ফির যদু মাইনসের ঘরৎ যাবু তো ঠ্যাং ভাঙি দিম্।
বাচ্চা দু'টো জড়োসড়ো হয়ে ঠাম্মার আড়ালে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে।
এবার লকডাউনের জন্য বেশ কয়েক মাস বিড়ি বাঁধা হয়নি, উপরন্তু কিছু টাকা ধার করতে হয়েছিল। লকডাউনে তিন মাস দীনেশের মালিকও দোকান বন্ধ রেখেছিল। মাইনে কাটেনি ঠিকই তবে জানিয়েছে এবার বোনাস দেবে না। তাই দীনেশের ওপর ভরসা নেই।
মালতী উনোনে খড়ি ঠেলে আর ভাবে, ধার শোধ করার পর হাতে আটশো টাকা আছে। হিসেব করে দেখে সেই টাকায় বাচ্চা দুটোর জামা আর শাশুড়ির জন্য ব্লাউজ কিনতে পারবে। বুড়িটা আর ক'দিনই বা বাঁচবে, ইচ্ছে ছিল একটা ভালো শাড়ি কিনে দেওয়ার, তা আর হবে না। স্বামীর স্যান্ডেলজোড়া ছিঁড়ে গেছে বহুদিন আগেই। সেলাই দিয়ে চলছে। সব কেনার পর একশোটা টাকা হাতে থাকলে একজোড়া হাওয়াই চপ্পলও কেনা যাবে। একটু আগে মেয়েকে বকাবকি করে নিজেরই দু'চোখ ভিজে উঠছে। আহা রে ওইটুকু বাচ্চা। ওরই বা কী দোষ! সবই কপাল।
গত দু'দিন ধরে দীনেশ এবং মালতী একটু বেশিই চুপচাপ। প্রয়োজন ছাড়া তাদের কথা নেই।
আজ ষষ্ঠী। রোজকার মতো আজও চা খেয়ে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা বেলায় গ্রামীণ আড়ম্বরতায় সাজানো পূজা প্যান্ডেলে জ্বলতে থাকা আলো বাড়ির উঠোন থেকে দেখা যাচ্ছে। গান ভেসে আসছে "....ঢাকের তালে কোমর দোলে খুশিতে নাচে মন...."
গত দুদিন একটু রাত করে বাড়ি ফিরলেও আজ সন্ধ্যার পরপরই ফিরে আসে। হাতে বড় দুটো প্লাস্টিকের প্যাকেট দেখে আহ্লাদে বাবার কাছে ছুটে যায় বাচ্চা দুটো। দীনেশ হাত পা ধুয়ে প্যাকেট খোলে। মায়ের হাতে হালকা রঙের একটা সুতির ছাপা শাড়ি দিয়ে প্রণাম করে। তারপর বাচ্চাদের জামা প্যান্ট জুতো আর মালতীর জন্য জড়ি-চুমকি বসানো একটা গোলাপী-সবুজ ফুলছাপ শাড়ি বের করে দেয়। বাড়ির সকলের মুখে একসাথে অনাবিল খুশির স্রোত। নির্মল এক প্রশান্তিতে দীনেশের বুকটা জুড়িয়ে যায়। মালতী খেয়াল করে আপন ভোলা স্বামীটি তার নিজের জন্য কিছুই আনেনি। আশ্চর্য হয়, এত টাকাই বা সে পেল কোথায়! কথায় কথায় জানতে পারে মালিকের কাজ ছাড়াও দু'দিন ধরে সারাদিন ভ্যান চালিয়েছে। যাকে বলে ওভারটাইম। তাই আজ দুর্গা পুজার আনন্দ ঘরের ভেতর, মনের ভেতর।
পাড়ার পূজা প্যান্ডেলে ঢাক বাজছে। দীনেশ বলে
–মা আসি গেইচেরে। বোধোন হবার নাইগছে। চল্ চল্ ভক্তি জানেয়া আইসি।
দীনেশ ছেলেকে কোলে তুলে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পরে।
রাতের খাওয়া শেষ। শোবার আগে দীনেশের হাতে আটশো টাকা গুঁজে দিয়ে মালতী বলে
–একনা কতা কই মাইনোর বাপ। কালি সকাইলে আপনার জইন্য একনা শাট আর জুতা কিনি আনেন।
দীনেশ তার বলিষ্ঠ দু'খানি হাতের পাতায় যুবতী স্ত্রীর মুখটি তুলে ধরে, কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আরো নিবিড় করে কাছে টেনে বলে
–মোর কিছু নাইগবে নারে। তোরা ভাল্ থাক্ তায় হোবে মোর।
এভাবেই গুনে গুনে হিসাব করে চলে যায় মালতী-দীনেশের লাল-নীল সংসার।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri