সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
27-November,2022 - Sunday ✍️ By- দীপ্তি রায় 504

গরম ভাতের গন্ধ

গরম ভাতের গন্ধ
দীপ্তি রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
 
ঝর্ণা কলসিটা মেঝেতে ঢক করে নামিয়ে রেখেই নিজের অদৃষ্টকে মনে মনে গাল দিল।  কপাল দোষে মিলনপল্লীর বস্তির এই ঘরটায় বাধ্য হয়ে  আজ মা -মেয়েকে থাকতে হচ্ছে।  ত্রিপল দিয়ে আটকানো ছোট্ট ঘরটা  ঘটঘটে সিমেন্ট দিয়ে মেঝে গাঁথা। তক্তপোশ,   হাঁড়ি,কড়াই,ছোটখাটো জিনেসের ভিড়ে ঘরটায় নিশ্বাস নেওয়ার জো  নেই।  ঘরটার পেছনে পাওয়ার বোর্ডের ময়লাটে হলুদ দেওয়াল। মা-মেয়ে মিলে মাথা গোজার ঠাঁইটুকু আজ এখানেই। বৃষ্টির দিনে খুব কষ্ট হয় মা -মেয়ের। তাও তো প্রায় একযুগ হয়ে গেল। মানিয়ে নিয়েছে ঝর্ণা সবকিছু।একদিন ঝিনুকের বাবা ফুসলিয়ে গ্রাম থেকে এই বস্তিতে এনে তুলেছিল। সেই লোকটাই তো  আজ আর সাথে নেই। ঝর্ণার  নাক দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস  বেরিয়ে এলো অজান্তেই। 

তবে একটা সময় ছিল যখন এই ঘরটাতেও যত্নের ছাপ থাকতো। গরম গরম ভাতের গন্ধ পাওয়া যেত দুবেলা। হাসি -ঠাট্টার আসরও বসতো  মাঝেমাঝে। অভিশপ্ত জীবনের মত রঙ হারিয়ে ফেলেছে ঝর্ণা ও মেয়ে ঝিনুকের জীবন। যবে থেকে ঝিনুকের বাবা পাশের বস্তির ময়নাকে নিয়ে আলাদা ঘর বেঁধেছে, তবে থেকে হারিয়ে গেছে ভালোবাসার রাস্তা।

আজ ভোর থেকেই মেঘলা আকাশ।শেষরাত থেকেই বৃষ্টিটা নেমেছে। এই অবিশ্রান্ত  বৃষ্টি ধারার  থামার যেন বিরাম নেই। সবুজ পাতার ফাঁকে আশ্চর্য এক আলো হাওয়ায় ছোটাছুটি করছে মেঘগুলো। আকাশের কোথাও মেঘ জমেছে টুকরো টুকরো। আজ সকাল থেকেই ত্রিপলের ফুটো দিয়ে আকাশটাকে দেখার চেষ্টা  করছে ঝিনুক। ত্রিপলের এলোমেলো ভাঁজে অল্প একটু বৃষ্টির জল জমে আছে। জল একটু বাড়লেই একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। তারপর আবার কিছুক্ষণ  জমতে থাকে। আবার গড়িয়ে পড়ে। ত্রিপলের উপর দীর্ঘ গ্রীষ্মের জমে থাকা ধুলো বৃষ্টির জলের নাচনে তার কিছু কিছু ধুয়ে গিয়ে এক অদ্ভূত নকশা তৈরি করছে। ঝিনুক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ত্রিপলের কিছু কিছু জায়গায় ফুঁটো হয়ে গেছে। ফুটো বেয়ে তক্তপোশ ভিজিয়ে দিচ্ছে, তবে সেদিকে ঝিনুকের খেয়াল নেই। মুগ্ধ হয়ে সে বৃষ্টি দেখছিল আর  মনে মনে কবিতা আওড়াচ্ছিল ---

"বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান,
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল তিন কন্যা দান।
এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন এক কন্যা খান,
এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি যান।"

হঠাৎ করে মা  ভিজে সপসপে হয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই  কবিতায় ছন্দপতন ঘটল। ঝিনুক ক্লাস ভাইভে পড়ে। হাজার কষ্টেও ঝর্ণা ওকে পড়াশুনা করাচ্ছে। এখন লকডাউন চলছে, তাই স্কুলে যেতে হচ্ছে না। তবে আর কতদিন পড়াতে পারবে ঝর্ণা জানে না। খাওয়াই জোটে না তো পড়া।  মায়ের রুদ্রমূর্তি দেখে ঝিনুক প্রমাদ গুনল।বস্তিতে থাকলেও ঝর্ণা শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাছাড়া সে ক্লাস ফোর পর্যন্ত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা করেছে। 

তোর কি কোনদিন কান্ডজ্ঞান হবে না। ঘর ভেসে যাচ্ছে এদিকে মেয়ের হুঁশ নেই। সদ্য জ্বর থেকে উঠলি এখন আবার জ্বর বাঁধালে এবার তো মরে যাবি। আপন মনে  গজগজ করতে করতেই ভিজে গায়েই কাপড়টাকে বাইরে একটু নিংড়ে নিয়ে ঘরের হাড়ি-পাতিল
বের করে বৃষ্টির জল ধরতে লাগল। 

ঝিনুক বড় বড় চোখ মেলে চুপ করে জলপড়া দেখতে লাগল। বৃষ্টির তেজ তখনো কমেনি এমন সময় ঝিনুক বায়না ধরল --মা, গরম ভাত খাব। ভাতের কথা শুনেই ঝর্ণা কান্ডজ্ঞান হারালো। দুম করে ঝিনুকের পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিল। "নবাবজাদি আমার, গরম ভাত খাবে? তোর বাবা ভাত নিয়ে আসবে?
উনি ঘরে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবেন আর মহারানীর জন্য আমি  আকাশ থেকে ভাত নিয়ে আসব।" বলতে বলতে ঝর্ণা একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বৃষ্টির জোরকে পাত্তা না দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল। ঝিনুকের শান্ত চোখ দিয়ে শুধু কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল নীরবে। 

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছিল। তার মাঝে হনহনিয়ে উদভ্রান্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে ঝর্ণার হঠাৎ ওঠা রাগটা আস্তে আস্তে পড়ে গেল। হু হু করে কাঁদতে লাগল আঁচলে মুখ চেপে। অসুস্থ মেয়েটা অনেকদিন ধরে ভাত খেতে চাইছে। চালের যা দাম....এই বাজারে গরম ভাত কি সোজা কথা? এই কয়েক দিন  
জ্বরের মধ্যে ভুলিয়ে ভালিয়ে একটু সাবু বার্লি রেঁধে খাইয়েছে, নিজেও খেয়েছে। আজ কিছুতেই সাবু বার্লি খাবে না। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা করোনায় তিনবাড়ির কাজ হারিয়েছে ঝর্ণা। এতদিন যেটুকু জমানো টাকা ছিল  মা- মেয়েতে আধপেটা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। 

মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না ঝর্ণা। ওটুকু মেয়ে কত বুঝদার হয়েছে! প্রথম প্রথম খাওয়ার জন্য খুব বায়না করতো। এখন আর খুব একটা করে না। মেয়েটা খুব ভাবুক প্রকৃতির হয়েছে। আকাশের দিয়ে তাকিয়ে কি যে এত ভাবে?

 আসলে ঝিনুক মাকে কিছু বুঝতে দেয় না। এখন  খিদে ভুলে থাকার বুদ্ধি বের করেছে সে। আনমনে সে আকাশের মেঘ দেখে  একেকটা মেঘ দেখতে একেক রকম। কোনটা দেখতে যেন তিন ঠ্যাংওয়ালা মানুষের মতো, কোনোটা আবার যেন চার চাকার গাড়ি। মাঝে মাঝে ঝিনুক  ত্রিপলের ফুটো দিয়ে উঁকি দেওয়া আলোর নকশা দেখে। স্কুলে শেখা ছড়াগুলো জোরে জোরে পড়ে। এমনি করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যে হলে মা কাজ থেকে ফিরে এলে কাজের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ভাত  মা-মেয়েতে ভাগ করে খায়। এভাবেই দিনগুলো এক এক করে কেটে যায় ঝিনুকের। আজ কতদিন হলো...গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত চোখেই দেখে না ঝিনুক। এই ঝুম বৃষ্টিতে বেশ ঘুম ঘুম ভাব হতে লাগল ঝিনুকের... কল্পনাতে ভাতের ঘ্রাণ  নিতে নিতেই ঘুমিয়ে পড়ল।

এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে ঝর্ণা ভেবে পায় না সে কি করবে? তাঁর খুব অনুশোচনা হচ্ছে, অসুস্থ মেয়েটাকে এইভাবে 
রাগের মাথায় মারা ঠিক হয়নি। মেয়েটার দুটো ভালোমন্দ খাবার সুযোগ কই? 
মেয়েটা এখনো এইসব বুঝতে শেখেনি। আর তাছাড়া দিনের পর দিন আর কতদিন না খেয়ে থাকবে? এখনো বোকার মতো গরম ভাতের আব্দার করে। বৃষ্টির সাথে সাথে ঝর্ণার কান্নার বেগও বাড়তে লাগল। আর ভুখা মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হলো। 

আজ সে যেভাবেই হোক মেয়েটার মুখে গরম ভাত তুলে দেবেই। চুরি করে হোক, ভিক্ষা করে হোক মেয়েকে আজ গরম ভাত রেঁধে খাওয়াবেই। প্রথমে ভাবল ষ্টেশনে যাবে ভিক্ষা করতে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল ট্রেন তো এখন বন্ধ। যাত্রীশূন্য ষ্টেশনে গিয়ে তো কোন লাভ নেই। তারপর সিদ্ধান্ত নিল সে  বস্তির মুদির দোকানে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে যদি কিছুটা চাল পাওয়া যায়। যদিও  মুদির দোকানেও অনেকটা ধার বাকি রয়েছে। অনেক অনুনয়- বিনুনয়ের পরেও দোকানদার চাল দিতে রাজি হল না। উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল। পথ চলতি দু একজন মানুষ ছাতা মাথায় দিয়ে উদাসীন ভাবে রাস্তা পেরোচ্ছে। ঝর্ণার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।

 ঠিক ওই সময়  ফলবিক্রেতা রতন বস্তিতে ফিরছিল। ঝর্ণাকে ওইভাবে হাত পেতে ভিক্ষে করতে দেখে থমকে দাঁড়াল।  ভদ্র, স্বল্পভাষী ঝর্ণাকে বিপত্নীক রতন মনে মনে ভালোবাসে কিন্তু সাহস করে বলার সুযোগ হয়নি কোনদিন।  এরকম একটা মেয়েকে কেন যে ওর স্বামী ছেড়ে চলে গেছে আজও বুঝতে পারে না 

 তবে ঝর্ণাও যে  রতনের মুগ্ধতা বুঝতে পারে না, তা নয়।  কিন্তু  পাত্তা দেয় না। পুরুষ জাতটার প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে। আজ রতনকে দেখে ঝর্ণা মাথা নীচু করল। রতন ঝর্ণার পাশে এসে বলল, বাড়ি চল। হাঁটতে হাঁটতে দুজনের মুখেই কোন কথা নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর রতন নীরবতা ভেঙ্গে  কথা শুরু করল। সব পুরুষ একরকম নয় ঝর্ণা। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি তোমাকে ঠকাবো না। আমাকে বিয়ে করবে? মেয়ে বড় হচ্ছে ওর তো একজন অভিভাবক দরকার। বস্তির পরিবেশ তো জানো।

 আর শোনো আমার তো তিনকুলে কেউ নেই, রোজ রোজ হাতপুড়িয়ে রান্না করতে ভালো লাগে না। 
আজ আমায় একটু রেঁধে খাওয়াবে?
আজ তোমার, আমার আর ঝিনুকের বর্ষাার পিকনিক।  এই দেখো বাজার থেকে সস্তার গরিবের খোকা ইলিস, চাল, ডাল ডিম এনেছি। আজ ঝাল ঝাল খিচুড়ি আর খোকা ইলিশ ভাজা করো। বলেই হো হো করে হাসতে লাগল। গরিব বলে কি আমরা ইলিশ খাব না। জ্বর মুখে ঝিনুকের খেতে ভালো লাগবে। 

আর  শোনো চাপ নিও না। ভেবে চিন্তে উত্তর দিও। বিয়ে না করো, বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াতে দিও। যতদিন কাজগুলো ফিরে না পাও, আমার রান্নাটা রেঁধে দেবে ঝর্ণা? একটা রান্নার লোক রাখলেও তো মাইনে দিতে হবে। তোমাকে না হয়, মাইনের পরিবর্তে গরম ভাত দেব। 

ঝর্ণা ফ্যালফ্যাল করে রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঝর্ণার সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । চোখের সামনে ধোঁয়াওঠা খিচুড়ি, খোকা ইলিশ মাছ ভাজা, ভুখা মেয়ের মুখ। সে সিদ্ধান্ত নিল রতনকে বিয়ে করবে। মনে হল সব পুরুষ খারাপ না। 

ঝর্ণার ঘরের দোরগোড়ায় এসে রতন  বাজার থেকে কিনে আনা সমস্ত জিনিসপত্র নামিয়ে দিয়ে ঝর্ণা কে বলল, তুমি পরিষ্কার হয়ে রান্না চাপাও, আমি পরিস্কার হয়ে আসছি। তারপর বাপবেটিতে জমিয়ে খাব।
এই কথা বলেই রতন জিভ কামড়াল আর ঝর্ণা  মুচকি হেসে ঘরে ঢুকল। তাড়াতাড়ি রান্না চাপতে হবে। 

ঝিনুক ওঠ মা। গরম ভাত খাবি না? ঝিনুক কি স্বপ্ন দেখছে? গোটা ঘরটা আজ  খিচুড়ি আর ইলিশের গন্ধে ম- ম করছে। আর রতনকাকুও ওদের সঙ্গে খাবে নাকি? এই রতনকাকুটা  খুব ভালো। কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে ফল দিয়ে গেছে  ওকে। মা বকবে বলে, মাকে বলতে মানা করে দিত। খুব ভালো লাগছে ওর রতনকাকু ওদের সাথে খাচ্ছে দেখে। 

আচ্ছা ঝিনুক মা কাল থেকে রোজ যদি তোর মা আমাদের দুজনের জন্য গরম ভাত রান্না করে দেয় কেমন হবে?  কি মজা, খুব ভাল হবে। আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে ঝিনুক। 
সত্যিই ঝর্ণার মনে হল, ঘরটা আজ থেকে আগামীর ভাতের গন্ধে ম -ম করছে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri