ক্লিক
ক্লিক
প্রসেনজিৎ চৌধুরী
-------------------------
পাঁচটি মঙ্গল ঘট। ফুল-পল্লব সজ্জিত। ঘরের গায়ে নানান রঙের নক্সা আঁকা । সুলেখা সযত্নে সাজিয়েছে । মাঠের এক পাশে উৎসবের নামাঙ্কিত ফ্লেক্স । ছোট একটা জায়গাকে টব, গাছ, ফিতে, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে স্টেজ বানানো হয়েছে। থালা ভরা নানা রঙের আবীর রাখা। সুলেখা হলুদ শাড়ি। কিছু ফুলমালা। খোঁপাতেও গোঁজা কিছু।মাঠের গুছিয়ে বসে টব সাজাতে ব্যস্ত সুলেখা। মগ্ন। একটু পরেই রংখেলা শুরু হবে। এলাকার গাইয়ে-নাচশিল্পীরা মঞ্চ মাতাবে। হাল্কা ফাগুনবাতাসে উড়বে আবীর। গান বাজনার তালে তালে নড়বে পা। দুলবে শরীর। মাতবে মন । ভালোলাগার মানুষেরা রং মাখাবে একে অপরকে। আনন্দ ভাগ করবে সবাই। সুলেখাও।
গালে চাপ দাড়ি। চোখে রোদচশমা। মাথায় ফেট্টি। রঙিন পাজামা পাঞ্জাবী।অনুভব। কোভিড পরিস্থিতি। একবছর বাড়িতে। বিশ্বভারতী সহ সারা রাজ্যের কলেজ বন্ধ। গতবছর কি একটা কারণে "বসন্ত উৎসব" বন্ধ ছিল। তবু অনুভব রং মেখেছিল। ছড়ানো আবির আর রবিগানে মেতেছিল ওর ডিপার্টমেন্ট। সেই সন্ধ্যার গৌড় প্রাঙ্গণে জোছনা যেন নাইতে নেমেছিল। দোলরাতে চাঁদের আলো গভীর হলে, কজনায় গীটার হাতে গিয়েছিল,,,, 'ফুলের আগুন লাগল,,লাগল,,,'। এবার চলচিত্র আলাদা। অনুভব মাঠে প্রবেশ করে। ততক্ষণে মঞ্চে 'ফাইভ- স্ট্রিং ব্যান্ড '। বিতানের উদাত্ত কন্ঠে, অয়নদের তালে নাচছে মেঠো- যৌবন। উড়ছে আবির। মোহময়। অনুভবের হাতে DSLR ।
সুলেখাকে চেনাই যাচ্ছে না। যে যখন আসছে সুলেখাকে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । উৎসবের মাঠে এখন ফাগ ফোয়ারা । সুলেখা আমুদে তবে উত্তাল না । বেশ কজন মাঠে গোল করে বসে আছে। ওরা সবাই সুলেখার সাথেই কলেজে পড়ে। আরো কয়েকজন ওদের ঘিরে পা মিলিয়ে নেচে চলেছে। বাতাসে আবীর উঠছে। প্রত্যেকেই রাঙানো ।ভালো করে না দেখলে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। এই তো উৎসব। ফাগুনের আগুনে পুড়বে মন, আর তার ফাঁকে উড়তে থাকবে ভালোলাগার আবির।
'লেন্স এডজাস্ট' করে অনুভবএর ক্লিক চলছে। নানা মানুষের রকমারি রকমারি অভিব্যক্তি । আবির খেলা চলছে মাঠজুড়ে ।লাল নীল হলুদ গোলাপি । রঙিন আকাশ। Portraiture খুব পছন্দের। অনুভবে ক্লিক থামল স্টেজ এর পাশে বসে থাকা দলটির ওপর। সারা মাঠ জুড়ে চলছে আবির উৎসব। আনন্দ। 'লেন্স অ্যাডজাস্ট' করে নিজের মতো ছবি তুলে যাচ্ছে অনুভব । পারফেক্ট ব্যাকগ্রাউন্ড। রঙিন। একেবারে দুর্ধর্ষ ।এত সুন্দর মুখ। Flattering Focal Length ঠিক করতে হবে । সাথে aperture priority। Face expose করে চোখদুটোকে Focus করল অনুভব । ক্যামেরায় উঠে এল রকমারি এক্সপ্রেশনে সুলেখা । অনুভব আপ্লুত ।সুলেখার হাসি, অভিব্যক্তি অতুলনীয়। হাজার ভিড় উৎসবে যেন অনুভব খুঁজে পেল তার সবচেয়ে প্রিয় মুখ। নানা রঙের এক মুখ ।
ভিড় ঠেলে অনুভব সুলেখার দিকে এগোলো। কথা বলার সাহস নেই। অনুমতি ছাড়া কারো ছবি তোলা অন্যায়, তার ওপরে মহিলা বলে কথা । অনুভব বুঝতে পারে না । তবু বুকে সাহস নিয়ে একেবারে সুলেখার সামনে গিয়ে হাজির।
--আমি অনুভব ! রঙিন শুভেচ্ছা ।
-- আপনাকেও, দোলের শুভেচ্ছা ।
--আমি অনুভব ,অনুভব মিত্র। নতুন পাড়ার। বিশ্বভারতীতে পড়ি ।
কোন উত্তর নেই। বান্ধবীদের মধ্যে থাকলেও সুলেখা একটু আলাদা। ওদিকে লগ্নজিতার গান বেজে চলেছে ---'বসন্ত এসে গেছে'!! খানিকটা এলেবেলে অনুভব বলে উঠল --
--অনুমতি না নিয়েই আপনার ছবি তুলেছি ! দেখবেন?
--অন্যায় করেছেন, তবে আজ রাগ করব না! দেখি।
ছবিটা বের করে 'screen show' করে অনুভব। একমনে নিজের ছবিগুলো দেখতে থাকে সুলেখা। ওদিকে মনে মনে খুশি হলেও তার প্রকাশ নেই । আনমনে ডান পায়ে হাত রাখে সুলেখা। অনুভব নানা অছিলায় সুলেখার চোখে চোখে রাখে। দুজনে কাছাকাছি বসা। কোথাও একটা ভালো লাগার আবেশ। একসময় একটু হলুদ আবির নিয়ে অনুভব সুলেখার গালে ছুঁয়ে দেয়। সুলেখা আরো রঙিন হয়ে ওঠে। আপনি থেকে কথায় কথায় দুজনেই তুমিতে এসে দাঁড়ায় । অনুভব আলগোছে বলে উঠে
--যাবে ওই গাছটার নিচে? এখানে বড্ড রোদ আর হট্টগোল!!
--এই আনন্দ ছেড়ে গাছের নিচে ? সে তো অনেকটা দূর। তাছাড়া.....
- তাছাড়া কি ? চল না!!
সুলেখার মুখে হাসি । সে হাসিতে বসন্ত আছে তবে রং নেই বোধহয় ।
এই এক জায়গাতেই বসে আছে সুলেখা অনেকক্ষণ।
মঞ্চের ঠিক পাশটায়। ইতিমধ্যে অনুভব ছবি তুলতে মাঠের নানা প্রান্তে চলে যাচ্ছে। তবে যেখানেই যাক না কেন চোখ যেন মাঝেমধ্যেই সুলেখার দিকে। ওকে খুঁজে নিয়ে নিশ্চিন্ত হচ্ছে অনুভবএর দৃষ্টি । হাজার বলা সত্বেও সুলেখা ওঠেনি বসা অবস্থা থেকে। অবশ্যই বা কেন প্রথম পরিচয় যদি মেয়েরা ছেলেদের সাথে মত মেলায় তবে ওজন দাড়ির ব্যাঘাত ঘটে বোধহয়।
অনুভব দুটো আইসক্রিম নিয়ে ঘুরে ফিরে সুলেখার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসিমুখে দুজনে পাশাপাশি বসে। কথা চলতে থাকে। সময়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে একটা অনুরাগএর জন্ম নেয়। সময় খুব কম। তবু যেন অনুভব কোথাও একটা ভালোলাগা জন্মেছে। অনুভব বলে -
--একটা কথা ছিল, যদি ওই গাছের নিচে যেতে একটু!!
-কেন এখানে বলা যায় না? না যাব না, যা বলার এখানেই বল, তাছাড়া বলার তো কিছু নেই । গান শোনো, রং খেলো, ছবি তোল ব্যাস। পরিচয় হল। এমন কিছু তো কথা নেই যে ওদিকে গিয়ে বলতে হবে? তোমায় তো সেভাবে আমি চিনি না!! অনুভবের রাগ হল। বিরক্ত হল বোধহয় একটু। কঠিন স্বরে বলে উঠল, -এতবার বলছি তবু শুনছ না। থাক তবে চললাম। দেখা হবে পরে।
--বসন্তের আস্তিনে আগুন। আগুন ফুলের নয় । আমি তোমায় ডাকিও নি। বসতেও বলিনি। কাজেই জ্বলে উঠবার প্রশ্ন নেই কোথাও।
-'সুলেখা দি,, ও সুলেখা দি!! বাড়ি যাবে না ?
নমি সুলেখার থেকে বয়সে ছোট। রং উৎসবে এসেছে সবাই। দু-একটা বাড়ি পরে ওদের বাড়ি। অবসর সময়ে সুলেখার সাথী। সুযোগ পেলেই সুলেখার পাশে ঘুরঘুর করে। যখন যা দরকার এগিয়ে দেয়। এমন সম্পর্ক, অদেখা একটা স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্ক ।
--যাব রে , তোরা কি এখন বাড়ি যাবি ?
-- হ্যাঁ অনুষ্ঠান তো প্রায় শেষ!
চলো এবার ।।
সুলেখা ওর হাতে হাত না রাখলে উঠতে পারবে না। এক ছুটে মঞ্চের পেছনে থেকে বৈশাখীকে নিয়ে আসে নমি।
'Spina Bifida' --ডাক্তার বাবু নানা পরীক্ষার পর বলেছিলেন। জন্ম থেকেই ক্রমে অসাড় ডান পা। আজন্ম বোঝ। এই একজোড়া বৈশাখী ভরসা। মা, বাবার, বোনের চোখের জল, নিজের অজান্তে বিরক্তি। নিদারুণ অপারগতা । হাজার ভিড়ে নিজে একা। এরপর এভাবেই টেনেটুনে শৈশব কাটানো। হাজারো মানুষের হাজারো করুণা । সবকিছুতে এ এক অন্য বসন্ত ।
নমির সাথে সুলেখা এগুতে থাকে রাস্তার দিকে। উৎসব শেষ । প্রায় সকলেই বাড়ি ফিরতে চলেছে। রঙের মাঠের শূন্যতায় বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অনুভব।। ক্যামেরায় চোখ । ক্লিকিং চলছে। উইন্ডোতে চোখ রেখে স্তব্ধ অনুভব। মাঠ থেকে রাস্তার দিকে হেঁটে চলেছে সুলেখা। দুই হাতে শক্ত করে ধরা বৈশাখী। যার ওপর ভর করে টেনে টেনে চলেছে সুলেখা। সব রং মিশে গেল যেন। রঙে রং মিশে গেলে যে রং হয় তার কিন্তু কোনো নিজস্ব রং নেই। বসে পড়ে অনুভব। উৎসব যেন তার রঙ হারাল। একটা চাপা শ্বাস পাঁজরের খিল খুলে বেরিয়ে যেতে চাইল। মুহূর্তের বসন্ত আকাশ যেন সব রঙ হারিয়ে ফেলে ধূসর হয়ে উঠল। তবে কি এ কারণেই সুলেখা গাছের দিকে যেতে চাইল না,? প্রায় নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে অনুভব শুধু ভাবল ঠিকানাটা জানা হল না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴