কুয়াশাবৃত্তান্ত
অমিত কুমার দে
===============
১
ধর্লা নদীর ধারে কুয়াশা পোড়ায়
এলোমেলো এক ফকিরি বালক
শুকনো শালের পাতা, ভাঙা ভাঙা ডাল
আর কিছু ভেজা ভেজা পাখির পালক
জুটিয়ে রেখেছে তার হাত ও হাতায়
‘কুয়াশা কুয়াশা’ বলে আর্তনাদ ছিল গতকাল
কুয়াশা জমেছে তার বাঁধানো খাতায়
যতবার মুছেছিল ততবার জল জল দাগ
কুয়াশা পোড়াতে এসে পুড়িয়েছে ক্ষত-অনুরাগ!
২
কুয়াশা তখন গেছে সর্ষের ক্ষেতে
কাঁচারঙ লেগেছিল ধোঁয়াটে জামায়
আবছায়া সুতি-ফ্রক হঠাত থামায়
মিহিন গলায় বলে – ‘চিনেছ আমায়?’
নিজেকে চিনি কি আমি?
চেনা যায় নিজের পুরোকে?
কীভাবে চিনব আমি পুরোপুরি তোকে?
কুয়াশাশরীর আমি যেই ছুঁতে যাই
কিছু কিছু পাতা ওড়ে, তুই শুধু নাই!
৩
পাখির গেরস্থালি কচিগম ক্ষেত
রাত্রে সেখানে নামে কুয়াশার প্রেত
কুয়াশা গুছিয়ে রাখে লক্ষ গমচারা
মধ্যরাতে কুয়াশাই দিয়েছে পাহারা
কুয়াশায় ডুবেছিল নকল মানুষ
কুয়াশার সহবাসে জমির পুরুষ
তাঁবুটাও ভিজে গেছে কুয়াশার জলে
গমক্ষেত রাত্রিবেলা প্রেতের দখলে
কবে যেন সেই ক্ষেতে বুনে দিই চাঁদ
তখন থেকেই আমি পুরো বরবাদ
পাখিরা সকালে এসে কুয়াশা পরায়
যে পরেছে সে চাদর, কীভাবে সরায়?
৪
কুয়াশা-সরণি ধরে হেঁটে গেছি বাহান্ন বছর
বাষ্প দিয়ে বুনে তুলি কুয়াশার ঘর
কুয়াশার ছাউনি দিয়ে ঢেকে আনি কুয়াশার খড়
তারপর নিজেও কুয়াশা হই
তোমাকেও কুয়াশা বানাই
ঘর জুড়ে বেজে যায় অস্পষ্ট কুয়াশা-সানাই
কুয়াশার জানালায় প্রতি ভোরে তোমাকেই পড়ি
কুয়াশা-নন্দিনী তুই, রাজ-রাজেশ্বরী!
৫
আমাদের আছে এক কুয়াশা-বসত
কুয়াশা-বাগানে ফোটে কুয়াশার ফুল
কেঁপে ওঠে কষ্টের কুয়াশা-বকুল
অল্প অল্প ঘ্রাণ চিনচিনে ব্যথার মতন
দু’হাতে সরাতে থাকি ঘন আস্তরণ
কুয়াশায় লেখা হয় কিছু ভুলচুক
কুয়াশার হৃদপিণ্ডে তীব্র ধুকপুক
কেউ কি কখনো শোনে? কুয়াশার গান
পৌষালি হাওয়া ছুঁয়ে ভাসে টানটান!
৬
একটা অবাক সাঁকো, নিচে তার গোপনীয় জল
বোনা বাঁশ, বাঁশগুলি যেন অবিকল
আমারই পাঁজর আর কিছু হাড়গোড়
সাঁকোটি হাঁটছে? নাকি আমি হেঁটে যাই?
কুয়াশায় ঢেকে থাকা অনেক কবর
আমাকে শেখায় কিছু মৃত্যু-স্বরলিপি
বাম ডান সামনে পেছনে নাই, কেউ নাই
কুয়াশা ডানায় রাখে এক জলপিপি
পদ্মপাতায় রাখা সেই শৈশব
হারিয়েছে কুয়াশায়, পড়ে আছি শব!
৭
তবু তো অরণ্যে যাই কুয়াশার সাথে
কখনো পড়ন্ত দিন, কখনো প্রভাতে
গাছগুলো ঝুঁকে থাকে নীরব ঠান্ডায়
বিগত তারিখ লেখা বাকলের গা-য়
কুয়াশা সরাতে গিয়ে খুঁজেছি দোয়াত
আমাকে আগলে রাখে কুয়াশার হাত
প্রবীণের করতলে এত শীত থাকে?
প্রবীণের ঝাপসায় মেলাই আমাকে
প্রবীণ-পাতাকে ছেঁড়ে কুয়াশা-আঙুল
আমাকে ঘেরাও করে কুয়াশার উল!
৮
সে কি জানে আনে আমি তার এত উপাসক?
এমন কুয়াশাদিনে যাবতীয় শোক
তারকাঁটা বেঁধা হাতে তিনিই সরান
কুয়াশার মধ্যে বসে আমাকে পড়ান
কোন এক বাইবেল, মলাটে করুণা লেখা
পাতায় পাতায় শুধু রক্ত ছোপ ছোপ
বুকের ভেতরে বাড়ে কুয়াশা-প্রকোপ
কোনো এক গীর্জায় বেজে ওঠে বেল
কুয়াশা-গভীর থেকে বুকে টানলেন
কিছু নেই, গাঢ় হয়ে বেজে যায় শুধুই – “আমেন”!
৯
কুয়াশা প্রবল হলে নদীদের বড় ঘুম পায়
পাখনা টিপে টিপে মাছ সাঁতরায়
উজানে যাবার কোনো তাড়া নেই কারো
গুটিসুটি হয় স্রোত, ঘুম পায় তারও
ঘুমের গহনে থাকে কুয়াশার বাসা
‘কুয়াশার প্রতিশব্দ শুধু ভালোবাসা’
লিখতে লিখতে ওড়ে একাকী ডাহুক
তবু কেন বিঁধে থাকে বেদনার হুক!
১০
কুয়াশার সঙ্গে মেশে প্রভাতী কীর্তন
কুয়াশার সঙ্গে মেশা গুম্ফার চূড়া
কুয়াশা আমাকে দেয় সাদা নামাবলী
কুয়াশাই ধরিয়েছে অলৌকিক সুরা
না-দেখা আঁকড়ে ধরে খেলে চলি হোলি
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঢাকে দু’চোখের তারা
কুয়াশাসড়ক ধরে হেঁটে যাই মৃত্যুর দিকে
নিজেই নিজের কাছে অস্পষ্ট হই, হই ক্রমে ফিকে
কুয়াশায় খুন হই, কুয়াশাতে লাশের পাহারা
আমি এক কুয়াশাপিয়ন, বয়ে যাই কুয়াশার ব্যাগ
এক হাতে ভেজার প্রহর, অন্য হাতে গৈরিক ত্যাগ!
আমি এক কুয়াশাপ্রেমিক
কুয়াশাদোতারা নিয়ে দরিয়া বাজাই
আমি এক কুয়াশার ডোম
কুয়াশা-শ্মশানকাঠে চিতাও সাজাই!
______________________________________
ছবিঋণ : কৃষ্ণ চন্দ্র দাস