সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
04-December,2022 - Sunday ✍️ By- শুক্লা রায় 229

কুসুমী/শুক্লা রায়

কুসুমী
শুক্লা রায়
========

বিকেলের ঘুমচোখে দু'এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো কেমন একটা মনখারাপের রঙ চরাচর ছুঁয়ে জেগে থাকল। মেয়েটা যেতেই চাইছিল না। যেন জোর করেই টোটোতে চেপে বসল। ব্যাগবুগ তুলে দিয়ে বাসুদেবও চড়ে বসল। শনিবারিয়া ধূপগুড়ি হাট থেকে কিনে আনা নতুন জামায় সঙ্গের কচিদুটো টগবগ করে ফুটছিল। মুখ চলছে অর্নগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মামাকে কথায় আর প্রশ্নে অস্থির করে তুলল। কুসুমী এসব দেখছে না। ভাবলেশহীন চোখে রাস্তাটার দিকে চেয়ে আছে। মা চাইছিল যাওয়ার আগে মেয়েটার মুখটা আর একবার দেখে। টোটো চলতে শুরু করল, উদ্দেশ্যহীন বাতাসের স্রোতে ছোট্ট শব্দটা ভেসে এলো 'যাই'।
সন্ধ্যার গায়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার জমে উঠছে। মেয়ের যাওয়ার পথে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে নেই। অমঙ্গল হয়। শ্বাসটাকে চেপে গিলে ফেলল মমতা। অকারণেই ঘোমটাটা একটু টেনে কলপাড়ে গেল। তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দিয়ে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকল বাড়ির দরজার কাছে। ছোটো ছেলের ফিরবার এখনো অনেক দেরী আছে। ওবাড়িতে নিশ্চয়ই তাকে রাতে খেতে বলবে।
ঠিক অষ্টমী তিথিতে জন্ম বলে মেয়েকে দুগ্গা বলেই ডাকে বাপ-মায়। কিন্তু ওর স্কুলের নাম কুসুমী। সেবার আর ঠাকুরের মুখটুকুও দেখা হল না দুগ্গার মায়ের। এ গল্প কম করে হাজারবার শুনেছে দুগ্গা। পাড়ার সবাইকে একবার করে শোনানো চাই এ গল্প। আসলে অষ্টমী তিথিতে জন্ম মেয়ের, বড় সৌভাগ্যের কথা। এ কথা দশজনকে না শোনালে চলে! এ মেয়ে যে নিজেরও ভালো করবে পরেরও। তার প্রমাণ তো পেয়েছেই। ওর জন্মের বছর ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। ওটাই কী বড় প্রমাণ নয়! আরো আছে। ওদের গাইটার সেবার দুধ বেশি হয়েছিল। দুধ বেচেই রান্নাঘরের চালাটার মেরামত হল। মাধ্যমিকটা পাশ করতেই ভালো সম্বন্ধ দেখে কুসুমী পাত্রস্থ হল। ছেলে বিয়ে পাশ করেছে। জমি-জমাও আছে। প্যান্ট-সার্ট আর হাতে সোনালী রঙের ঘড়ি পড়া ছেলেকে খুব সহজেই কুসুমীর পছন্দ হল। তবে বাবা-মা ভাই, এই গ্রাম ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল কুসুমীর। কেঁদে ভাসিয়ে মারুতিতে উঠেছিল। বরযাত্রীরা সব অবশ্য টোটোতে এসেছিল। এখানে এসে হাফ ওয়াল বড় পাকা ঘর কুসুমীর ভেতর একটা খুশির রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিল।
প্রথম সন্তানের মা হল যখন কুসুমীর বয়স আঠারো ছুঁই ছুঁই। মেয়ে দেখতে একদম বাপের দিকেই গেছে। শাশুড়ি বললো ভগবান দিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে সমান। কিন্তু মুখের রেখায় খুব একটা খুশি ধরা পড়লো না। পরেরটাও মেয়ে হতেই বাইরের আবরণটুকু খসে পড়ল। কুসুমীর শিক্ষিত স্বামীও বুঝে গেল পরপর মেয়ে হওয়ার জন্য আসলে অপয়া কুসুমীই দায়ী। মেয়ে দুটো বাড়িতেই জন্মেছে। দাই কী সব চিহ্ন দেখে হিসেব করে অব্যর্থ গলায় জানালো আরো দুটো মেয়ে জন্মানোর পর তবেই কুসুমীর ছেলে হবে।
বাড়ি থেকে ফিরে কুসুমীই রান্না করল। ভাই আর টোটোওয়ালা খেয়ে-দেয়ে ফেরার পথ ধরল। রাতে শোয়ার পর কুসুমী ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কাঁদলো। কাকুতি-মিনতি করলো। কিন্তু রজত নির্বিকার। একমনে ফোন ঘাঁটছে। কুসুমীর আসলে ভয় করছে খুব। সেবারের ঘটনাটা বিভীষিকার মতো শক্ত নখের আঁচড়ে ফালা ফালা করছে বুকের ভেতরটা। কিন্তু কথার পিঠেই কেবল কথা ভাসানো যায়। নীরবতার গায়ে তো শুধুমাত্র ধিকিধিকি আগুনের মতো জ্বলে ওঠা যায় অন্ধকারে জেগে থাকা বাঘিনীর চোখের মতো।
তিন নাম্বার সন্তান তখন পেটে। রাতে রান্নার আয়োজন বেশ ভালো করা হয়েছে। কুসুমী বুঝতে পারছে না কেউ আসবে কিনা। শাশুড়ি নিজে ওর সঙ্গে রান্নার তদারকিতে আছে। রান্না প্রায় শেষের দিকে উঠোনে চারখানা পা এসে থামলো। মধ্যবয়স্ক মানুষটির সঙ্গে বৌ। সবাই খুব খাতিরদারি করছে দেখে কুসুমীও বুঝতে পারল বিশেষ কেউ। খাওয়া হতে শাশুড়ি ওকে একটা ছেঁড়া শাড়ি পড়ে নিতে বলল। অতিথি মহিলা কী একটা ওষুধ খাইয়ে দিল। গোয়াল ঘরের পাশে বাছুর রাখার চালাটায় চটের উপর সারারাত যন্ত্রণায় কাতরাল কুসুমী। মনে মনে। শাশুড়ির কড়া হুকুম মুখে শব্দ করা চলবে না। ব্যথায় নীল হয়ে গেলেও কুসুমী তাই ঈশ্বরের ভরসায় নিজেকে ছেড়ে দিল। জীবনের থেকেও সংসারে টিকে থাকার লড়াই বেশি বড়। অমানুষিক যন্ত্রণার পর ভোর রাতে জলস্রোতের মতো রক্তস্রোতের সাথে একদলা মাংসপিন্ড বেরিয়ে তাকে মুক্তি দিয়েছিল। তাদের বংশকে মুক্তি দিয়েছিল। সে বিভীষিকার কথা মনে পড়লে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কুসুমী। বাপ-মাকে বলেছিল, আমি আর ওই বাড়ি যাব না। আমাকে বাঁচাও। আসতেই চায়নি আর। সেবার শুধু দু মাসের ছিল মোটে। এবার পাঁচে পড়েছে। সেই কবিরাজই আসছেন। তবে দেরী হল, লকডাউনে কোথায় গিয়ে ফিরতে পারছিলেন না। নিজের বুকের ভেতর সন্তানের স্পন্দন অনুভব করছে কুসুমী। কিন্তু বাবা-মা আর পাঁচজনের মতোই শ্বশুরবাড়ির সিদ্ধান্তই সঠিক বলে দায় এড়িয়ে গেল।
ওনাদের আগের মতোই সবাই খাতিরদারি করলেও কুসুমী কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারল না। রাতে সামান্যই মুখে দিল। এবার আর পুরনো ছেঁড়া শাড়ি নয়। মায়ের দেওয়া নতুন শাড়িটাই পরল। দেখে শাশুড়ির পিত্তি জ্বলে গেল। কিন্তু কুসুমী একেবারে নির্বিকার। আজ অষ্টমী। পুজোয় পড়ার শাড়ি একদিন পরেই বিসর্জন দেবে। অভিমানে বুকটা ভার। মা দেখুক।
ভোরবেলা যখন উঠোন শিউলিতে ভরে উঠল কুসুমীর বুকের ভেতর থেকে একটি মরণ চিৎকার বেরিয়ে এল যেন। অপুষ্ট মৃত পুত্র সন্তানটির মুখও দেখা হল না আর। ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে শরীর। রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়নি। হাসপাতালে নিয়ে গেলেই পুলিশ কেস। দূরে বহুদূরে ধীরে ধীরে পৃথিবী জেগে উঠছে নিজের মতো। নতুন শাড়িতে জড়ানো কুসুমীর শরীর তার সমস্ত উষ্ণতা পৃথিবীকে ফিরিয়ে দিয়ে চিতায় ওঠার অপেক্ষায়। । ঠান্ডা পায়ে লাল আলতা আর কপাল জুড়ে লাল সিঁদুরের রঙ ছুঁয়ে জেগে উঠছে চিতার আগুন। দাউ দাউ করে। সাদা ধোঁয়ায় মুহূর্তে ঢেকে গেল নদীপাড়ের কাশবন। ঢাকের আওয়াজের সাথে মিশে গেল এক অনুচ্চারিত হাহাকার।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri