অস্থিরচিত্তে দোতলার বারান্দায় পায়চারি করছিলেন বিবেকবাবু - বিবেকানন্দ দত্ত, রাজনগরের দত্তবাড়ির কর্ণধার তথা শহরের নামকরা ব্যারিস্টার। সুস্থির হয়ে বসবেনই বা কি করে! হাতে তো মাত্র দিন পনেরো, তারপরই দেবীর বোধন! অথচ হন্যে হয়ে খুঁজেও 'কুমারী পূজা'-র উপযুক্ত 'ছয় বছরের কুমারী' এখনও পাওয়া গেল না! বাপ-ঠাকুর্দার আমলের রীতি, তা তো আর অবমাননা করা যায় না! তাই চা-আয়েসী বিবেক বাবুর চা পড়ে রইলেও সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না তার। কাপ নিতে এসে হরি খবর দিয়ে গেল ইসমাইল গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। তৈরি হয়ে নামতেই বাগানে প্রজাপতির পিছু নেওয়া ছোট্ট মেয়েটির ওপর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল বিবেকবাবুর। ইসমাইলের কাছে জানতে পারলেন মেয়েটি তার ভাগ্নি মাসুদা, বয়স ছয় বছর। কোনোরকম রাখঢাক না করেই ব্যারিস্টার সাহেব জানতে চাইলেন মাসুদাকে যদি 'কুমারী' রূপে পূজা করা হয় তবে ইসমাইলের কোন আপত্তি আছে কিনা ? দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভার ইসমাইল সাগ্ৰহে বলে উঠলো "মুঝে কোই দিক্কত নেহি হ্যায়, লেকিন পুছনা পড়েগা!" বড়বাবুর কথামতো বুক পকেট থেকে ফোন বের করে, মাসুদার মা-বাবার সাথে কথা বলে তাদের সম্মতির কথাও তক্ষুণি জানাল ইসমাইল। 'ইউরেকা' বলেই হন্তদন্ত হয়ে খাবারের টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে আবেগমথিত কন্ঠে তার মা'কে ডাকলেন প্রৌঢ়। প্রাত:রাশের টেবিল থেকে উত্তর এল মায়ের। একে-একে সমবেত হল বনেদি বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারের সকলে। মা, রিনা, তার দুই ভাই, ভাতৃবধূদ্বয়, ছেলে-ভাইপো-ভাইঝি সকলের সামনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাসুদা-কে মহাষ্টমীতে 'কুমারী' রূপে পূজা করবার সিদ্ধান্তের কথা দৃপ্তকণ্ঠে জানালেন বিবেকবাবু। আজীবন বড়ছেলের সকল সিদ্ধান্তের সস্নেহ সমর্থক অন্নপূর্ণা দেবী 'কুমারী পূজার' কথা শোনামাত্রই তীব্র বিরোধিতা করে বললেন, তিনি বেঁচে থাকতে দত্ত বাড়ির ঠাকুরদালানের চৌহদ্দি কোন ম্লেচ্ছ মাড়াতে পারবে না। বাধ্য ছেলের সুখ্যাতি থাকলেও এই বিষয়ে বিবেকবাবুও মায়ের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন। পন্ড হলো জলখাবারের আসর।
রাতে বাড়ি ফিরে বিবেকবাবু জানতে পারলেন 'কুমারী পূজার' সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে জলস্পর্শ করবেন না তার মা। হাত-মুখ ধুয়ে, খাবারের থালা হাতে নিয়ে দরজা ঠেলে জ্যেষ্ঠপুত্র মায়ের ঘরে প্রবেশ করতেই, পাস ফেরেন অন্নপূর্ণা দেবী। নতশিরে মায়ের পাশে বসে, পরম মাতৃস্নেহে মুখ খোলেন বিবেকবাবু "জানো মা! তুমি যার গুণমুগ্ধ, পরিবারের অমত সত্বেও যার নামে আমার নাম রেখেছিলে সেই 'বীর সন্ন্যাসী' বিবেকানন্দ-ই বেলুড়মঠে কুমারী পূজার প্রচলন করেছিলেন। তিনি প্রথম 'কুমারী পূজা' কোথায় করেছিলেন জানো? কাশ্মীরে! সেখানে ৭-৮ বছরের এক মুসলিম কন্যাকে দেবীরূপে পূজা করেছিলেন স্বামীজি। মেয়েটির নাম ছিল সাহিবা।" উঠে বসেন অন্নপূর্ণা দেবী। বলে চলেন তার ছেলে, "কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। সে কোন ধর্মের তাতে কি কিছু যায় আসে মা? তবে এরপরেও যদি তোমার অমত থাকে আমি কালই ইসমাইলকে মানা করে দেবো, কারণ জন্মদাত্রীকে অবজ্ঞা করে 'জগন্মাতার' আরাধনায় আর যাই হোক, সিদ্ধিলাভ হয় না মা!" এবারে নীরবতা ভাঙেন বিবেকবাবুর মা, রাশভারী কন্ঠে বলে ওঠেন "মাসুদা-ই মহাষ্টমীতে পূজিতা হবে কুমারী রূপে।" স্মিত হাসি ফুটে ওঠে মা-ছেলের ঠোঁটের কোণে।
মহাষ্টমীর সকালে আম্মু-আব্বুর হাত ধরে প্রথমবারের মতো দত্তবাড়ির চৌকাঠ ডিঙোয় ছোট্ট মাসুদা। রক্তবর্ণা-বেনারসি, মুকুট, ফুলের মালায় তাকে নিজের হাতে সাজান রিনা দেবী।কপালে রক্তচন্দনের টিপ আর পায়ে লাল আলতা পরিহিতা ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটি সিংহাসনে বসে যখন তার দিকে চোখ ফেরায় তখন আঁচলের খুঁট দিয়ে আনন্দাশ্রু মুছতে থাকেন অন্নপূর্ণা দেবী।