কাশবন, শিউলি ফুলের গন্ধ আর স্বপ্নহীন ঘুম
অলক পর্না সেনগুপ্ত ব্যানার্জী
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সকাল সকাল ফেসবুক দেখতে গিয়ে একটা খবরে চোখ আটকে যায় তুলসীর, এবার তরাই ডুয়ার্সের সব চা বাগানেই বিশ পার্সেন্ট বোনাস দেওয়া হবে। চা বাগানের কোনো খবর দেখলেই মনটা উদাস হয়ে যায় ওর। তাহলে তো এইবার মা, ভাই ভাল টাকা পাবে। ওদের পূজার বাজার ভাল হবে। কয়েক বছর আগে বাবা দারু খেয়ে খেয়ে মরার খবরটাও জানে কিন্তু এখন আর কোনো খবর নাই। মাটা কেমন আছে কে জানে, চন্দাদিদির কাছ থেকে আগে খবর পেত এখন তো ওও আসে না মৌসির সাথে খুব ঝগড়া লাগছিল একদিন। তারপর থেকে আসা বন্ধ।
আজকের খবরটা পড়ে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ওর বাবা ছিল চা বাগানের লেবার, মা টেম্পোরারি কাজ করত বাগানে, ওরা বলত বিঘা লেবার। ওর মার মা বাঙালি ছিল বাবা আদিবাসী তাই মা মনে মনে একটু বাঙালি ঘেঁষা ছিল। নিজে পড়াশোনা না করতে পারলেও ওদের তিন ভাইবোনকে বাগান থেকে চার কিলোমিটার দূরের বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। ভাইদের পড়ায় মন ছিল না তেমন কিন্তু তুলসীর খুব ভাল লাগত পড়তে। সারা বছর ওরা অপেক্ষায় করত পূজা বোনাসের। পূজার বোনাস পেলেই মা বাবা ওকে আর ওর ছোট দুই ভাইকে নিয়ে বাজারে যেত। মা ওদের নতুন জামা কিনে দিত। দোকানে গিয়ে সিঙারা মিষ্টি খেয়ে বাড়ি আসত। বাগানে একটাই পুজো হত, ওতেই খুব আনন্দ করত ওরা। বাগানের বাবু মাইজি, সাহেব, মেমসাহেব সবাই আসত পূজা মন্ডপে। এক স্কুলে পড়ত বলে, কয়েকজন বাবু স্টাফের মেয়েরা ওর চেনা ছিল। একটা দুরত্ব থাকলেও ওর মিষ্টি স্বভাবের জন্য সবাই ওকে পছন্দও করত।
হঠাৎ নীচে চিৎকার চেঁচামেচিতে বর্তমানে ফেরে ও। জানলা দিয়ে নীচে উঁকি মারে, সকাল সকাল রাজুর সাথে নীচের পানদোকানের রহিমচাচার ঝগড়া মারামারি হচ্ছে, বিরক্ত মুখে চেঁচিয়ে একটা খিস্তি দেয় ও। নীচে রাজু কটমট করে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে – চুপ কর শালি রান্ডি….
- তু উপর আ আজ, বনাতি হুঁ তুঝে…. - - - - -হারামি…
পাল্টা জবাব দিয়ে দড়াম করে রাস্তার দিকের জানালাটা বন্ধ করে দেয় তুলসী। রাজু ওদের সবার ফাইফরমাশ খাটে, এখানে এ রোজকার ব্যাপার। জামাকাপড় হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবে, ওর মুখ এখন খোলা ড্রেনের মতো হয়ে গেছে, দশ বছর আগে ও নিজে স্বপ্নেও ভাবতে পারত না!! স্নানঘরের সামনেও নিত্য ঝগড়া। দোতলার কুড়ি পঁচিশ জনের জন্য একটাই বাথরুম বরাদ্দ। কোনও রকমে স্নান করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে তুলসী, এখন ওর ঘুমোনোর সময়। রাস্তার দিকের জানালাটা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, মহা ব্যস্ত জি বি রোড, সার দেওয়া গা ঘেঁষাঘেঁষি করা তিন-চার তলা বাড়ি। একতলায় রকমারি দোকান আর ওপরতলায় আরেকরকম দোকান যার বেসাতি শুরু হয় সন্ধ্যার পরে।
দাদির কাছে গল্প শুনেছিল অনেক দিন আগে নাকি কোন এক সাহেব এই শহরের ছড়ানো সব কোঠাকে এক জায়গায় এইখানে বসিয়েছিল ওই সাহেবের নামেই এই রাস্তার নাম, নামটাও দাদি বলেছিল ভুলে গেছে এখন। এই শহরের সবথেকে বড় লালবাত্তি এরিয়া জি বি রোড।
বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তুলসী, আবার মনে পড়ে আগের কথা, দূর্গা পূজার আগে হঠাৎ বাগান বন্ধের নোটিশ দিয়ে ম্যানেজাররা চলে গেল। সেইবার পূজা-টূজা সব বন্ধ। কত মিটিং মিছিল, রোজই ওরা আশা করে থাকত বাগান খোলার খবরের। ছয় সাত মাস হয়ে গেল, বাবা বাইরে বাইরে কাজের ধান্দায় ঘুরত, ছোট জায়গায় কাজ কম। এর মধ্যেই ছোট ভাইটার অসুখ ধরা পড়ল। পায়ে একটা ঘা বাড়তে বাড়তে বড় হয়ে গেল ডাক্তার দেখানোর পয়সা কোথায়!! মা ভাইকে নিয়ে দিনের পর দিন সরকারি হসপিটালে পড়ে থাকত। ওর বাবা তখন থেকেই নেশা করা ধরল। এর মধ্যেই একদিন চন্দাদিদি আসল বাবার কাছে, ও তখন দিল্লি তে থাকত। তুলসীর তখন চোদ্দ বছর হবে। ওর সাথে নিয়ে যাবে বলল তুলসীকে, তুলসীর বাবা মা কেউ রাজি ছিল না কিন্তু তুলসী জোর করেই চলে আসল দিল্লিতে। রোজগার করে সংসার চালাবে অসুস্থ ভাইকে সুস্থ্য করার আশায়। চন্দা ওকে নিয়ে তুলল এই জি বি রোড এরিয়ায়। তুলসী এরকম ঘটবে ভাবতে পারেনি, বড়োলোক বাড়িতে বাচ্চা দেখার কাজ করতে হবে, এই বলেই চন্দা নিয়ে এসেছিল ওকে। ও অবাক হয়ে দেখত ওরই চোদ্দ বছরের শরীরটা দিয়ে প্রতিরাতে ভোজ সারত নতুন নতুন শ্বাপদের দল। প্রতিবাদ বা পালানোর চেষ্টা করলেই শাস্তি দ্বিগুণ। যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে বাড়ির কথা মনে পড়ত শুধু, তবে বেশিদিন না, পোষ মানতেই হয়েছিল, নিজের জন্যই। বেঁচে থাকার মায়া যে বড় মায়া!! নরকের মধ্যেও বেঁচে থাকতে চায় পাঁকে ডুবতে ডুবতেও শ্বাস নিতে চায় প্রাণ। তবে চন্দা দিদি একটা উপকার করেছিল, ওর হয়ে প্রতি মাসে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাত। বলেছিল পরে ফেরত দিয়ে দিবি।
ও এখানে আসার কয়েক দিন পরেই ভাইটা ক্যান্সারে মরে গেল। বাবাও সারাদিন নেশা করতে করতে শেষ হয়ে গেল। বাবাকে খুব ভালবাসত ও, বাবাও ভাইদের থেকে ওকেই যেন বেশি ভালবাসতে। ইচ্ছে তো করত বাড়িতে যেতে… একবার। বাগান খুলে যাওয়ার খবর শুনে খুব খুশি হয়েছিল তুলসী, ভেবেছিল মা বাবার কাছে যাবে, কতবছর দেখেনা!! কিন্তু মা জানিয়েছিল তুলসী যেন ওদের সাথে আর যোগাযোগ না রাখে। ঘরে কোনোদিন তুলসীর জায়গা হয় না। শুনে খুব কেঁদেছিল তুলসী। কিন্তু আর ফোন করেনি। তাও চন্দা দিদি আসলে একটু খবর পেত এখন তাও পায়না। চন্দা দিদি ফোনও ধরে না।
এই আলোবাতাসহীন ঘুপচি ঘরে কখন যে শরৎ আসে আবার চলে যায় তুলসী টেরও পায় না। স্কুলে একবার একটা সিনেমা দেখেছিল দুই ভাইবোন কাশফুলের মধ্যে দিয়ে ট্রেন দেখার জন্য দৌড়াচ্ছে, দিদিটা পরে মরে গেল .…কি নাম টাম সব ভুলে গেছে কিন্তু কাশবন এখনও মনে আছে ওর। বাগানের শেষ মাথায় নদীর ধারেও কাশফুল ফুটত। ওরা তুলে এনে ঘরে সাজাত। ওদের পাশের বাড়িতে একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল, রাত্রে ঘুমের মধ্যে ফুলের গন্ধ ভেসে আসত। ভোর হলেই ফুল কুড়োতে দৌড়াত।কত বছর শিউলি ফুল দেখেনি ও!! সেই গন্ধ ভুলে গেছে কবেই। এখন মদের গন্ধ, মাংসের গন্ধ, পারফ্যুমের উগ্ৰ গন্ধ সব মিলিয়ে এক উৎকট গন্ধের মধ্যে ওর বেঁচে থাকা। যেখানে কোন ও প্রেম নেই, ভালোবাসার অনুভূতি নেই, আছে শুধু যতদিন পারে এই শরীরটা দিয়ে টাকা কামিয়ে নেওয়ার তাড়া না হলে ভাগাড়ে পড়ে থাকতে হবে।
ভাবতে ভাবতে দু চোখের পাতা জড়িয়ে আসে তুলসী ওরফে টিনার। চাবাগানের সবুজ, বাবা, মা, স্কুল, দুর্গামন্ডপ, ওদের লেবার লাইন ধূসর কুয়াশা মেখে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর স্বপ্নেও আসে না ওরা। ঘুমের ওষুধ খেয়ে গভীর কালো জলের মতো স্বপ্নহীন ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে ও।