সকালের পেপারটায় চোখ বোলাতে গিয়ে চশমাটা খুঁজে পেলেন না কিছুতেই। পষ্ট মনে আছে ছোট টেবিলটায় রেখেছিলেন। কিন্তু হলে কী হবে, এরমধ্যে পিনুর বাবা কম করে দশবার এ ঘর ঘুরে গেছেন! পিত্তি জ্বলে গেল। গম্ভীর কন্ঠে হাঁক পাড়লেন 'মনা!' তারপর আর কিছু বলতে হল না, মনার সাথে সাথে গোটা বাড়ি তাঁর রুমে ঢুকে গেল। বেচারা দোষী পিনুর বাবা অর্থাৎ সমরেশবাবু মুখ কাঁচুমাচু করে গিন্নীর মুডের দিকে তাকিয়ে। কখন ঠিক হয়! অবশেষে আধঘন্টার চেষ্টায় তাঁর কোল থেকেই চশমাটা আবিষ্কৃত হল। আসলে
চশমাটা টেবিল থেকে কোলে নিয়ে পেপারটা হাতে নিয়েছিলেন। এরমধ্যেই চশমা গায়েব! একটুও লজ্জা না পেয়ে মৃন্ময়ী দেবী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, 'কী করে জানব উনি চশমাটা নেননি? সবসময়ই তো আমার চশমা পরে বসে থাকবেন!' সমরেশবাবুর মনে পড়ল কোনো এক মন্দ মুহূর্তে নিজের চশমা খুঁজে না পেয়ে গিন্নীরটা চোখে দিয়েছিলেন! সে অপরাধ এখনও ক্ষমার অযোগ্য!
আসলে কিছুদিন আগেও মৃন্ময়ী এরকম ছিলেন না। বেশ হাসি-খুশী, আনন্দে থাকতে ভালোবাসতেন। সুন্দরী বলে মনে মনে প্রচ্ছন্ন একটা গর্ববোধ করলেও আচরণে কখনো তা প্রকাশ করতেন না। এমনি ভালোমানুষ তিনি! এরকম খিটখিটে বদমেজাজী হয়ে গেলেন মাত্র কিছুদিন আগে থেকে। শরীরটা ক'দিন থেকে ভালো যাচ্ছিল না। ছেলেরা সময় পায়না, বড় বৌমা নিয়ে গেল পাড়ার ছোকরা ডাক্তারের চেম্বারে। তখনি মৃন্ময়ীর পছন্দ হয়নি! ওনার ছোট ছেলের থেকেও তো বাচ্চা! সে আবার মুখটুখ গম্ভীর করে চেক আপ টেক আপ করে ব্লাড টেষ্ট লিখে দিল। ব্যাস হয়ে গেল! উনি জানলেন ওনার প্রেসার সুগার দুটোই হাই। বিশ্বাস হয়! হয়না। সেজন্য ভোরবেলা লাইন দিয়ে শহরের ব্যস্ততম ও বিখ্যাততম ডাক্তার ডক্টর বসুর কাছে নাম লেখানো হল। হলে কী হবে! উনিও কিনা একই কথা বললেন! মৃন্ময়ী ভেবে পাননা, তার সুগার হয় কী করে! মিষ্টির প্রতি আকর্ষণ কম ছিল বলে, তাছাড়া কতকটা ফিগার ঠিক রাখতেও সারাজীবন উনি মোটেই মিষ্টি খাননি। ইদানিং অবশ্য মিষ্টির প্রতি লোভটা একটু বেড়েছে। তাই বলে সুগার হওয়ার মতো গাদাগুচ্ছের মিষ্টি উনি মোটেই খাননা। কিন্তু এই সামান্য কারণে বাড়িসুদ্ধ লোক এমন উঠে পড়ে পেছনে লাগবে এটা ভাবা যায় ! বিধি নিষেধের ঠ্যালায় মনে হচ্ছে এর থেকে মরে গেলেই ভালো ছিল। আজন্মকাল থেকে জানেন সধবা মানুষ খাওয়ার পর একটু পান মুখে দিলে সংসারের কল্যান হয়। ওমা! এরা পানটাও খেতে দেবে না! শুধু তো পানই, আর তো কিছু নয়! তবে হ্যাঁ ওই একটু সুপুরিকুচির সাথে এক চিমটি জর্দা মিশিয়ে নেন। তাতেই হয়ে গেল মহাভারত অসুদ্ধ। বলে কিনা নেশা! সত্যিই বাঁচতে ইচ্ছে করে না। সেই থেকেই তার মুখটা সবসময় নিমপাতা সেদ্ধ হয়ে থাকে। কটু কথা বলতেও এখন তার মোটে আটকায় না।
কিন্তু শুধু একা একা রাগ করে তো কোনো লাভ নেই। মনের কথা বলারও তো একটা লোক চাই! এখন কেমন যেন গোটা বাড়িটাই তার শত্রুপক্ষ হয়ে গেছে। পিনুর বাবাকে যে বলবেন, সে তো কিছুই শোনে না! সবসময়ই মনের আনন্দে কীর্তন করে যাচ্ছে। আসলে পুরুষমানুষ মাত্রই কোনো কম্মের নয়। অগত্যা কাজের মেয়ে মনাকেই দুঃখের কথা শোনান। এই যে বড় বৌমা, কত্ত ভালোবাসতেন তিনি। অথচ এখন? সব খাবার তো বড় বৌমাই আগে বন্ধ করে দিল। এমনকি তার প্রিয় চাটনিটা পর্যন্ত একটু মুখে দিতে দেয় না! মনা ঘাড় নাড়ে। একদম ঠিক। 'তুই বল মনা, রোজ রোজ কী ওই তেতো দিয়ে খেতে শুরু করতে ভালো লাগে!' মনা ঘাড় নাড়ে আবার। 'তা লাগে না-ই তো! ঠিক'। তারপর ফিসফিস করে বলে, 'এই স্যুপটা একটু খেয়ে নাও গো। নইলে বড় বৌদি আবার বকবে আমাকে।' হুঃ! খুব গিন্নী-বান্নি ভাব দেখায় এখনি। যেন বাড়ির সবকিছু এখন ওর দখলে। এখনও মৃন্ময়ী বেঁচে আছে। কিন্তু সে কথাই বা কাকে বলবেন! বড় দুই ছেলে তো সারাক্ষণই ব্যস্ত। তাদের সময় নেই কোনো কথা শোনার। সেজন্যই ওদের বৌদের এত বাড়-বাড়ন্ত! ছোটোটা তো চিরকালের ভ্যাগাবন্ড! বাপের মতোই কোনো কম্মের না। মৃন্ময়ীর তো খুব সন্দেহ, কলেজে গিয়ে ও ছেলেদের পড়ায় নাকি ছেলেরাই ওকে পড়িয়ে দেয় কে জানে! আর প্রেম করে কিনা একটা হতকুচ্ছিত কালো মেয়ের সাথে! সে নাকি আবার কোন বিষয়ে পি এইচ ডি করছে। শেষ হলেই বিয়ে। মৃন্ময়ী ঠিক করেছেন কিছুতেই ওই মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন না। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞাও তার রইল না।
হঠাৎ পয়লা জানুয়ারী বলে কিনা পিকনিক করবে। করবে! মনার মুখে জানতে পারলেন ওই দিন তার খাওয়া নিয়ে ততটা বিধি নিষেধ থাকবে না। চাটনি, মিষ্টি সবই পাবেন, তবে অল্প করে। এটা যে আসলেই একটা ফাঁদ, তিনি বুঝবেন কি করে! আহা! ছেলেদের আব্দার বলে কথা! মৃন্ময়ী খুশীই হয়েছিলেন। তবে মনে মনে চাইছিলেন ওই কালো মতো কাগের ছা যেন কিছুতেই না আসে। তা আসেনি। সন্ধ্যাবেলা খাওয়া-দাওয়া। বিকেল থেকেই সব মিলে রান্না চলছে। উনি একটু বিশ্রাম নেবেন বলে নিচে গেলেন। একটুখানি গড়িয়ে নিতেই চোখটা লেগে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি উপরে এসে দেখলেন সব কমপ্লীট। খাওয়ার আগে একটু গান। নাহ্ , সে মেয়েকে বলা হয়নি নিশ্চয়ই। শান্ত পরিবেশ। মৃদু অথচ মায়াবী আলোয় পরিবেশ স্নিগ্ধ এবং রহস্যময়। ছাদে অনেক গাছ ওদের। কতকটা তার নিজের শখ, কতকটা বড় বৌমার। দুজনে মিলেই যত্ন করেন। গাছগুলোর ফাঁকফোকরে আলো আরো রহস্যময় যেন। হঠাৎ কেউ গেয়ে উঠল। একদম খালি গলায়। মৃন্ময়ী বড্ড গান ভালোবাসেন। একের পর এক তার প্রিয় গানগুলি করে যাচ্ছে মেয়েটি। গান শেষ হতেই তিনি সব ফেলে ছুটলেন। শিল্পীকে জড়িয়ে নিলেন বুকে। তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেই, সেই মেয়েটিই! কিন্তু ফাঁদে পা দিয়েই দিয়েছেন! আর তো ফেরার উপায় নেই। স্নিগ্ধ ও লাবন্যময় মুখটি দুহাতে তুলে ধরে কপালে চুম্বন আঁকলেন। তারপর ভ্যাগাবন্ডটাকে খুঁজলেন চারদিকে। পাশ থেকে শুনলেন মেজবৌমা বলছে, 'এ তোমার সেই কাগের ছা।' আপ্লুত মৃন্ময়ীর তখন এসব শোনার মন নেই। এমন গুণী মেয়েকে বুকে পেয়ে আনন্দে ভাসছেন। তা সেই থেকে তার অমন প্রতিজ্ঞাও ওখানেই শেষ।