কলমিলতার দেশে
কলমিলতার দেশে
মালবিকা মালবিকা
~~~~~~~~~~~
একটা সুর। ..., উঠছে নামছে ডুবছে জাগছে! ছোঁয়া যাচ্ছে অথচ ধরা যাচ্ছে না! একটা খু...ব চেনা গন্ধ!
সে হেঁটে চলেছে, বালি ছুঁয়ে ছুঁয়ে। নদী খানিক দুরে। কতকাল ...! বোধ নেই তার। হঠাৎ দু কাঁধে প্রবল ঝাঁকুনিতে এক্কেবারে থমকে চমকে তাকাল।
....সক্কলে মিলে চিৎকার করছে, আর আপনার কানেই যাচ্ছে না! - খুব বিরক্ত হয়ে লোকটি বলল।
শিঞ্জিনী নির্বাক চোখ তুলে তাকিয়ে রইল।
....সামনেই চোরাবালি। এক্কেবারে তলিয়ে যেতেন যে!! এত্তো আনমনা কেউ থাকে?
...আনমনা! ওহ! সরি।
একটু দূরত্ব রেখে পুরুষটি তার সাথে হেঁটে ফিরতে ফিরতে প্রশ্ন করল ....কোথায় উঠেছেন?
....ওই তো সামনের কটেজটায়। উত্তর দিয়ে শিঞ্জিনী তাকাল লোকটির দিকে। না, বয়েস বেশি নয়। হয়তো বত্রিশ বা তেত্রিশ! তার থেকে অনেকটাই ছোট।
একটা নামী কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার শিঞ্জিনী। কাজের প্রেসারে শরীর মন যখন বিধ্বস্ত থাকে তখন এমনি নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে সে। একা।
একারই জীবন তার। এমনি জীবন নিয়ে পরিচিত-অপরিচিত সকলেরই চোখে চোখে কথা। শুধু সে নীরব। বিজনেসের সূত্রে এবং প্রয়োজনে বহু পুরুষের সাথেই তার সম্পর্ক হয়েছে। দূরে এবং কাছ থেকে। কিন্তু সেসব যেন চলমান রাস্তায় পিছনে সরে সরে যাওয়া গাছ মাত্র। সে বোঝে ... তার মধ্যে একটা খোঁজ চলে। কী সে খোঁজে! চিনে ফেললেই অস্থির হয়। বাঁধন আলগা হয়। আর ধরে রাখতে মন চায় না। তখন তার সে .. .ই ছোট্ট মাটির বাড়ি মনে পড়ে। মনে পড়ে উঠোনের নিম গাছ। নীল কলমি ফুলে ভরা পুকুর। পাড়ে ডুমুর গাছে দোয়েলের জন্যে হাঁড়ি বেঁধে রাখা। বিশাল একটা মাটির উঠোন গোবড় লেপা। ...অস্পষ্ট একটা সুর। আর .. আর বকুল ফুলের বীজের একটা ঘুঙুর।
সূর্য ডোবার বেলায় নদীর চরে বসে এসব গল্পই সে বলে চলেছিল ছেলেটিকে। রক্তিম সূর্য তখন কেঁপে কেঁপে উঠে নদীর জলে ডুবছে। অথচ ছেলেটি বড় স্থির।
ছেলেটি বাঁশি বাজায়। শিঞ্জিনী আবদারের সুরে বলল .... শুনব আপনার বাঁশি।
...বেশ তো। আসুন সন্ধের পর।
....না। কোথাও যাব না। এই নদীর চরেই শুনব আপনার বাঁশি।
..নির্দিষ্ট সময়ে দুজনে এসে বসল। ছেলেটি বাঁশি তুলে নিল হাতে। ঝোলা থেকে একটা ঘুঙুর বের করে পরে নিল পায়ে। ঠিক সে সময় বুঝি আকাশের সব তারার আলো শিঞ্জিনীর চোখে এসে থেমেছিল। ছেলেটি বাঁশিতে ফুঁ দিল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো ধুন! নদীর জল শিরশির করে উঠল। এক ঠাট থেকে আরেক ঠাটে, এক রাগ থেকে আর এক রাগে শিঞ্জিনী ভেসে যেতে লাগল....।
জলছাপ শাড়ির পরিপাটি ভাঁজ এলোমেলো করে উঠে আসছে জলজ গন্ধ। জেগে উঠছে কলমিলতার দল। পাতারা জলের স্রোতে ডুবছে ভাসছে। থোকায় থোকায় নীলচে ফুল ফুটে উঠছে। রসের ভারে কলমির ডাঁটারা হেলে হেলে পড়ছে। একটা শাদা হাঁস তার লম্বা ঠোঁট অনবরত ঘষে চলেছে।
শিঞ্জিনী উঠে দাঁড়াল। ছেলেটির পা থেকে ঘুঙুর খুলে পরে নিল নিজের পায়ে। শরীরের প্রতিটি অনু-পরমাণু জুড়ে খেলে যেতে লাগলো নাচের মুদ্রা।
বাঁশির সুর, ঘুঙুরের তাল, নোনা বালির চিকন আদুল গা দুজনকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধরল। অবয়বহীন সুরটা শিঞ্জিনীর কাছে এখন স্পষ্ট।
.........
.........
ভোর বুঝি এমনি হয়! এমনি আবছায়া রঙ এর। আলো-মাখা! দুজনে ভোর মেখে জেগে উঠল।
সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে একে অপরকে দেখলো।
তারপর চলে গেল নিজ পথে।
শুধু ঘুঙুরটি বাঁধা থাকল শিঞ্জিনীর পায়ে॥
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴