এমনি বরষা ছিল সেদিন
মৌমিতা মিত্র
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
আর
মাত্র কয়েকদিন বাকি। এতো অল্প সময়ে মাকে রাজি করানো যে মুখের কথা নয়, সেটা
মেঘ খুব ভালো জানে। রাকা শুধু এক কথা বারবার বলে চলেছে। কাকিমা এ বয়সে
যেভাবে গাইছেন তুই সারাজীবন সাধনা করলেও পারবিনা। তুই শুধু শ্রোতা হয়েই
থাক। কাকিমা ঠিক জিতবেন, তুই দেখে নিস। মায়ের প্রশংসা শুনে মেয়ের কি হওয়া
উচিত, খুশি? খুশি হলেও মাকে কীভাবে রাজি করানো যায় মাথায় আসছেনা মেঘের।
বাবা চলে যাবার পর মাকে মেঘ হারমোনিয়ামের সামনে বসতেই দেখেছে শুধু, কখনও
গাইতে শোনেনি। সুমনা পরম যত্নে হারমোনিয়াম, তানপুরা মুছে রাখে নিয়মিত, ঠিক
যেভাবে রোজ ভোরবেলা স্নান সেরে ঠাকুরঘর সাজিয়ে পুজো করে। গানের সামগ্রী আর
পুজোর উপকরণ যেন অভিন্ন। মেঘ গান গাইতে বললে সুমনা হেসে বলে, গান নিয়ে
বসলেই হল? বোকা মেয়ে, বলে মেঘকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, গান সাধনা ছাড়া হয়না।
গলায় সুর কোথায় আমার? তোর পেছনে চেঁচিয়ে কথাটুকু বলতে পারছি এই অনেক,
বুঝলি?
এদিকে রাকা ওর
গানের স্কুলের প্রোগ্রাম নিয়ে যারপরনাই উত্তেজিত। ওর বিশ্বাস এবারের
কম্পিটিশন একটা চমক। মেঘ বলেছিল, প্রতিভা অন্বেষণ আজ আর নতুন কোনো কনসেপ্ট
নয়। টিভি চ্যানেলগুলির দৌলতে বিষয়টি এখন পথ চলতি যে কোনো লোক বলে দিতে
পারে। রাকা মাথা নেড়ে বলল, নো নো, মিস ক্লাউড, এখানে কেসটা একটু আলাদা।
ট্যালেন্ট হান্ট কথাটা ঠিক। কিন্তু এখানেই টুইস্ট। সিক্রেটটা তোকে বলতেই
পারি, তবে আমার একটা কন্ডিশন আছে। মেঘ বিরক্তির সাথে বলল, বল, কি খাওয়াতে
হবে তোকে, রাক্ষস।
রাকা হেসে বলল, কি মাথা রে তোর,
ঠিক ধরেছিস। ওনলি কাকিমার হাতের মাটন বিরিয়ানি। মেঘ দেখল বিষয়টা পুরো
জানতেই হবে ওকে, নইলে মায়ের হাজারো প্রশ্ন ওকে নাজেহাল করে দেবে। বলল, ঠিক
আছে, হবে। এবার বল। রাকা বেশ সিরিয়াস এবার। বলল, দেখ, পুরো আইডিয়াটা আমার
গানের স্যার, পন্ডিত অনিমেষ বসুর। তিনি বলেছেন, এবার প্রতিযোগিতায় প্রতিভার
খোঁজ হবে ঠিকই, কিন্তু সেটা নতুন প্রতিভা নয়, সুপ্ত প্রতিভার। মেঘের মুখে
অগাধ বিস্ময়। বলল, সেটা আবার কি? রাকা বলল, যে সকল মহিলারা নানা কারণে গান
গাইতে পারলেন না, কেউ বাধ্য হলেন গান ছেড়ে দিতে অথচ একসময় তারা যথেষ্ট
প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, তাদের জন্য এই মঞ্চ।
মেঘ
বুঝতে পারছে না, দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস ছাড়া কি করে এঁরা গান গাইবেন? রেওয়াজ
ছাড়া গান হয় না, মা যে বলে! রাকা বলল, ঠিক এই প্রশ্নটাই আমি স্যারকে
করেছিলাম। বললেন, ভালোবাসা থাকলে যে কোনো অসম্ভব কে সম্ভব করা যায়। সত্যি,
রাকা গতদিন যখন ওর স্যারের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যায়, মেঘ অবাক হয়ে
দেখেছে, মানুষটা যেমন দেখতে তেমনি কি অসাধারণ কথা বলেন। মেঘের বারবার বাবার
কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বাবা বলত, মানুষ যত বড় হয় তত বিনয়ী হয়। কতদিন বাবাকে
দেখে না মেঘ, বাবা বলে ডাকেনা। এই ভাবে ওকে একলা ফেলে কেমন আছে বাবা না
ফেরার দেশে? এই যে বাবাকে ওর দেখতে ইচ্ছে হয়, তখন কি যেন একটা কষ্ট দানা
বাঁধতে থাকে ওর মনে। এই কষ্টের কোনো নাম আছে? মেঘ জানে না। মা যে ভালো গান
গায় সেটা কি করে জানল রাকা? ও তো বলেনি এবিষয়ে কিছু রাকা কে! রাকাকে এই
প্রশ্নটা করল মেঘ। প্রশ্ন শুনে রাকা বলল, তোদের বাড়িতে যেদিন ফিজিক্সের নোট
আনতে গিয়ে তোর পড়ার ঘরে বসেছিলাম তখন কাকিমা গুনগুন করে গাইছিলেন,
'বেঁধোনা ফুলমালা ডোরে....'কি মিষ্টি গলা। আর গানটায় যে সরগমের অংশটা আছে
সেটাও কি অনায়াসে গেয়ে ফেলেছিলেন কাকিমা। তুই তো সারাদিন কানে হেডফোন গুঁজে
থাকিস, তুই শুনবি কি করে? কথাটা শুনে মেঘের একটু খারাপ লাগল। মায়ের কাছে
থেকেও এটা মিস করে গেল কি করে। কিন্তু মাকে কম্পিটিশনের কথা বললে মা রাজি
নয় কিছুতে। এ বয়সে আমায় নিয়ে লোক হাসাতে চাস? ধমকের সুরে বলে দিয়েছে সুমনা।
কীভাবে মাকে রাজি করানো যায় বলত রাকা, আমার মাথা কাজ করছে না। একটু ভেবে
রাকা বলল, সেটার একটা উপায় আমি ভেবেছি। স্যারকে বলে দেখলে হয় না? উনি
সুন্দর করে বোঝাতে পারেন। অনেককেই শুনলাম রাজি করিয়েছেন। মেঘ দেখল হতেও
পারে, শেষ চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কলকাতা যেতেও তো মা রাজি হবে না।
রাকা হেসে বলল, কলকাতায় কে যেতে বলেছে? কম্পিটিশন এখানেই হবে। মেঘ এবার
হতবাক। বলল, এখানে মানে? এই লাটাগুড়িতে? ইয়েস, এখানে মানে লাটাগুড়িতেই, বলল
রাকা। সব ব্যবস্থা স্যার করে ফেলেছেন। বিচারক, বাইরে থেকে আসা
প্রতিযোগিদের জন্য আর প্রোগ্রামের জন্য দু'তিনটে রিসর্ট বুক করা হয়েছে।
সুদেবকাকু, দুলালকাকুরা তো খুব খুশি। ওদের রিসর্টগুলো অতিমারির জন্য বন্ধ
ছিল এতোদিন। ওরা সবরকম সাহায্য করবে স্যারকে, বলেছে। একদিন সবাই গরুমারায়
ঘুরতেও যাবে। সবকিছু ঠিক করে ফেলেছেন স্যার। রাকার কথা শুনে মেঘের চোখদুটো
উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আবার এই ছোট্ট শহরটায় আনন্দের ছোঁয়া লাগবে। মানুষগুলো
বুকভরে একটু নিঃশাস নিতে পারবে। রাকার হাতদুটো ধরে বলল, প্লিজ, মাকে রাজি
করা। যা খেতে চাস তাই পাবি। রাকা হেসে বলল, ওই যে একদিন খাইয়েছিলি তোর
ফেবারিট মিষ্টি, কাজুবাদামের বরফি, সেটা। মেঘ হেসে বলল, পাবি। যতোগুলো তোর
ইচ্ছে, খাস।
মাঝে আর মাত্র দুদিন। মেঘের মন চঞ্চল
হয়ে আছে সকাল থেকে। ফোনটা আসবে তো? হঠাৎ ওর মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠতে দেখল
রাকার দেওয়া অনিমেষ বসুর নাম্বার। এক দৌড়ে মায়ের হাতে দিয়ে খুব আস্তে বলল,
কথা বলো, রাকার গানের স্যার। সুমনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোনটা ওর হাতে
দিয়ে পড়ার ঘরে দৌড়ে চলে গেল মেঘ। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ
থেকে আওয়াজ ভেসে আসল, কেমন আছো সুমনা? চিনতে পারছো, আমি অনিমেষ বলছি। এই
গলার স্বর শুধু একটি মানুষের আছে, চিনবে না সুমনা? কিন্তু প্রায় তিরিশবছর
পর সেই গলা শুনলে সুমনা যে অবাক হবে। কলকাতা থাকতে অনিমেষের বাবার কাছেই
সুমনার গান শেখার হাতেখড়ি। সেই সূত্রে অনিমেষ আর সুমনা একে অপরের কাছে আসতে
শুরু করে। অনিমেষ তখনও পড়াশোনা শেষ করেনি। কিন্তু সুমনার বাবার অসুস্থতার
কারণে হঠাৎই সুমনার বিয়ে হয়ে যায় লাটাগুড়ির হেমন্তের সাথে। হেমন্তের বাবা
আর সুমনার বাবা বন্ধু ছিলেন। ফেলে আসা সেই সবদিনের কথা কিছুকি ভুলেছে
সুমনা, নাকি ভুলতে চেয়েছে? গোপনে লালন করেছে সব স্মৃতি। তারমানে রাকার
গানের স্যার, যার কথা মেঘ এতো বলেছে, সে অনিমেষ। ইস্ একবারও নাম জানতে
চায়নি সুমনা। ওপাশ থেকে শব্দ ভেসে আসছে, তোমার মেয়ে বলছে তুমি গান গাইবে না
বলেছো, এটা ঠিক নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে সুমনা বলল, এসব ছেলেমানুষী এখন
সাজে? গান এখন আর গাই না। পাবলিক পারফরম্যান্স করা তো অসম্ভব। অমিমেষ বলল,
প্রথমদিন রাকার কাছে শুনেই বুঝতে পেরেছি, ও তোমার কথা বলছে। দেখো সুমনা,
জীবন তো একটাই, তুমি গান গাইতে এতো ভালোবাসতে, একবার চেষ্টা করেই দেখো না।
আমার বিশ্বাস, তুমি গান ছাড়লেও গান তোমায় ছাড়েনি। সুমনার চোখ হঠাৎ ঝাপসা
হয়ে উঠল। মনের ভেতর হাজারো স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন কাছের মানুষ হঠাৎই
দূরে চলে যায়, আবার হঠাৎই ফিরে আসে অসময়ে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকে দূরত্বের
ব্যবধান, সুমনা বুঝতে পারে না। কিছু বলবার আগেই অনিমেষ বলল, আমার এই
রিকোয়েস্ট তুমি রাখলে খুশি হব। তুমি গান গাইতে এসো সুমনা। আর কিছু না বলেই
ফোন রেখে দিল অনিমেষ। মাথাটা যেন হঠাৎই ঘুরে গেল সুমনার। মেঘকে ডেকে ফোনটা
দিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল। মা কিছু বলল না রে। কেমন মুখ ভারী করে ঘরে চলে
গেল, রাকাকে ফোনে জানাল মেঘ। সেদিন মেঘ দেখল, মা সারাদিন কেমন চুপচাপ হয়ে
আছে। বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ জমছে। বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির শব্দ মেঘের খুব
প্রিয়। হেডফোনটা নামিয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়াল মেঘ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে
বাইরে। বৃষ্টি হলে মা গরম গরম পেঁয়াজি ভাজে, চায়ের সাথে খেতে খুব ভালবাসে
মেঘ। কিন্তু আজ মায়ের মন খারাপ যেন, তাই আব্দারটা সে গোপন রাখল। হঠাৎ শুনতে
পেল কে যেন উদাত্ত গলায় গাইছে, 'যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে,সে কথা আজি
যেন বলা যায়...... 'শিহরিত হয়ে উঠল মেঘ। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মায়ের
গলা। উত্তেজনায় মেঘ যেন কেঁপে উঠল। ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু
মাকে এখন বিরক্ত করা ঠিক নয়, গানটাই বরং শুনছে মেঘ। কি অসাধারণ মায়ের গলা,
মেঘের খুশির যেন কোনো সীমানা নেই আজ। খুশিতে ওর চোখ ভিজে যাচ্ছে। ছোটবেলায়
মেঘের চোখে জল দেখলে মা আদর করে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলত, তার প্রাণের মেঘ নাকি
বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ। মেঘ এখন বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে আনন্দে। মেঘের মন
জুড়ে এখন বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ। ফোনটা নিয়ে রাকার নাম্বার ডায়াল করল মেঘ।।