একটি ভাইরাল ভিডিও এবং লাল বলটি
একটি ভাইরাল ভিডিও এবং লাল বলটি
শুক্লা রায়
-----------------------------------------------
চোখদুটো শক্তভাবে বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকল বাসু। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মায়ের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। চুপি চুপি চোখটা খুলে ফেলল এবার। অবাক কান্ড! কেমন একটা নীলচে আলো ঘুরে বেরাচ্ছে ঘরময়! চোখদুটো অমন বেয়াক্কেলের মতো বন্ধ করে রাখার ফল! কিছুক্ষণ চোখটা বন্ধ করল আবার আলতো করে। নাহ্! আলোটা তবু আছেই। এবার ঘরের দক্ষিণ কোণে। আবার চোখ বন্ধ করল, খুলল, বন্ধ করল, খুলল! বেশ মজা লাগছে। বিকেলে খেলতে যেতে না পারার দুঃখ আপনা থেকেই ভুলে গেল বাসু। কখন খাট থেকে নেমে আলোটা ধরতে গেছে, আলোটাও ওকে পেয়েছে তেমনি! সামনে এসে নাচতে থাকে। ধরতে গেলেই ফুস!
সন্ধ্যা দিতে যাবার আগে মা ওকে ঘুম থেকে ডেকে দিল। এসময় মায়ের গা থেকে কেমন একটা মা মা গন্ধ পাওয়া যায়। বাসু মাকে ছাড়তে চায় না। ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতে থাকে। আজ কাঁদল না। প্রথমত বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে ও ঘুমোচ্ছিল। ও তো খেলছিল! তবে ঘুমালো কখন? ওর এই গভীর ভাবনার মধ্যেই মায়ের সন্ধ্যা দেওয়া হয়ে গেল। শঙ্খ বা মায়ের উলু কোনোটাই বাসুর কানে এল না আজ। ওর খালি মনে হচ্ছে ও তো ঘুমোয়নি!
দুধ হরলিক্সটা খেয়েই পড়তে বসে গেল। পড়ছে না ছাই। চোখদুটো বইয়ের খোলা পাতায় রেখে মনে মনে একটু বল প্র্যাকটিস করে নিল। তারপর খুব অবহেলায় একলাইন পড়ে নিয়েই কৌস্তভের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল। সবসময় ওর বল করায় ভুল ধরে। তুমুল একচোট হয়ে গেল। ব্যাপার শুধু এটাই যে ঝগড়াটা কেউ দেখতে পেল না। কারণ সবটাই মনে মনে। কাল দেখা হলেই ও ঠিক কৌস্তভকে একহাত নেবে। এতটা সময় বইয়ের সঙ্গে বসে থেকে আর ভালো লাগছিল না। বিছানা থেকে নামতেই বাবার সঙ্গে চোখাচুখি। বুকটা ধ্বক্! চোখ নামিয়ে শান্তভাবে উত্তর দিল 'বাথরুমে যাব'। মা চেঁচাল, 'আসতে দাও। একঘন্টা হয়ে গেল একা একা পড়ছে।' মা টা আমার এজন্যই অ্যাত্ত ভালো। পড়েনি তো মোটেই, বাসু শুধু একাই জানে ও খেলছিল। মুখটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বাথরুমের দিকে হাঁটা দিল। বাবার চোখের আড়াল হতেই দিক বদল, অন্যদিকে টার্ণ! চুপিসাড়ে টমটমের কাছে চলে গেল। ওর পোষ্য। মা দেখতে পারে না। বাবা একটু। ঠাম্মার একেবারেই সহ্য হয় না। তবু টমটম আছে এ বাড়িতে, নইলে বাসু হুলুস্থুল করে ছাড়বে। ঠাম্মা ওকে কোলে নিয়ে অনেক বুঝিয়েছে, দাদুভাই কুকুর কী কেউ পোষে? দ্যাখ তো ওরা কত্ত নোংরা থাকে!' বাসু মাথা নেড়ে বলেছিল টমটম রোজ স্নান করে ঠাম্মা। নদীতে। আমি নিজে দেখি। ও তোমার পুজোর ফুলটাও তুলে দিতে পারবে। এরপর আর কিছু বলতে হয় না, ঠাম্মা ওকে এক ধাক্কায় কোল থেকে নামিয়ে দেয়। মেঝেতে ছিটকে পড়েই বাসু দৌড় দেয় মাঠের দিকে। সঙ্গে সেই টমটম।
সেই সবার অপছন্দের টমটমের গলা জড়িয়ে গল্প করল দশমিনিট। অন্যেরা সে শব্দ ভাষা না বুঝে অজ্ঞতাবশত পাগলের প্রলাপ মনে করলেও আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ওরা ঠিকই নিজেরা নিজেদের মতো কথা বলে। তাপর গুটিগুটি ঠাম্মার ঘরের দিকে পা বাড়াল। টমটমের সঙ্গে ওর এই আদিখ্যেতা দেখলে ঠাম্মা এতক্ষণ কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিত। দেখেনি বলে খুব কন্ফিডেন্সের সঙ্গে ঠাম্মার কাছে গেল। চুপি চুপি বলল 'বাবার ফোনটা চাও। একটু পিসিমণির সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু আমার কথা বলবে না!' ঠাম্মা গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়ল, 'যামিনী, একটু তপতীকে ফোন কর তো। কথা বলব।' ব্যস! বাসু খুব শান্ত হয়ে ঠাম্মার কোলে। খুব বেশী পাঁচ মিনিট কথা বলল মা-মেয়েতে। এবার ফোন বাসুর দখলে। ওর দুষ্টুমীটা ঠাম্মা ধরতেই পারে না। আয়েশ করে ঠাম্মার কোলে শুয়ে গেম এ ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
স্কুল থেকে ফিরেই মাঠের দিকে দৌড় দিল বাসু। টমটম কোথায় গেছে! বাড়িতে নেই। ওর জন্য অপেক্ষা করতে মন চাইল না। যথারীতি মা পেছনে খুব চিৎকার করল, 'একটু ঘুমিয়ে নে বাসু, সন্ধ্যাবেলা মাষ্টার আসবে। তখন ঘুম পেলে বাবা পিঠের চামড়া তুলে নেবে।' ভয় যে না করছিল তা নয়, তবে রোজ রোজ খেলার সময়টায় ঘুমোতে একটুও ভালো লাগে না। মাঠে এসে দেখল এসেছে সবাই, কিন্তু যে যার বাবার অথবা মায়ের ফোন নিয়ে। বাসুর ফোন নেই। বাবা দেয় না। রাতেই যা একটু ঠাম্মার ঘাড়ে বন্দুক রেখে গেম খেলতে পারে। অন্য সময় ওর খেলতেই ভালো লাগে। কিন্তু কারো খেলার মন নেই। যার নিজের ফোন নেই সে ও কারো না কারো ফোনে মাথা ঢুকিয়ে বসে আছে। এক অদ্ভুত বিকেল। মাঠ আছে, বল আছে, ক্রিকেটের ব্যাট বলও আছে। খেলার জন্য ছেলেও আছে মাঠে। কিন্তু কেউ খেলছে না। নানান ভঙ্গিতে বসে সব মোবাইলে ডুবে আছে। নেশাগ্রস্তের মতো। বাসুর ভালো লাগছিল না। একাই বল ড্রিবলিং করতে লাগল। টমটম থাকলেও খেলতে পারত দুজনে। ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক হয়ে নদীর দিকে তাকাল। মাঠের ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে ডুডুয়া নদী। ভাদ্রের ডুডুয়া কিছুটা শান্ত হলেও জল বেশ গভীর। একটানা একটা সুন্দর ছন্দে বয়ে চলেছে। শিশুমন সহজেই নদীর দিকে আকূষ্ট হল।
বাসু বল ফেলে প্রাণপণ ছুটতে লাগল নদীর দিকে। নবীন কাকার ছোট ছেলে বিজু মানে বিজয় জলে ডুবে যাচ্ছে। একবার ডুবছে, আবার ভেসে উঠছে আর ওর সামনে সামনে একটা লাল বল। এক্ষুণি না তুললে তো মরেই যাবে বাচ্চাটা। বাসু নিজেও ছোট, মোটে ক্লাশ ফাইভ। কিন্তু তখন আর এসব মনে নেই। যে করেই হোক বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে। বাসু দৌড় শেষ করে নদীর গভীর জল লক্ষ্য করে একটা বিরাট লাফ দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বাঁ দিক থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা টমের শক্ত কামড়ে ওর গেঞ্জিতে একটা ঝটকা টান। দুজনেই গড়িয়ে পড়ল মাঠে। এত বড় ঘটনাটা ঘটে গেল কিন্তু দু একজন ছাড়া সবাই মোবাইলে মুখ গুঁজে তখনো। বাসু লক্ষ্য করল নবীন কাকা নিজে ওর সামনে দাঁড়িয়ে। মাথা ন্যাড়া। বিষন্ন চেহারা। বাসু এসব খেয়াল করল না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল 'কাকা, তোমাদের বিজয় জলে ডুবে গেল যে, আমি ঝাঁপ দিচ্ছিলাম। টমটম আটকে দিল। যাও যাও! ওকে নদী থেকে তোলো! ভেসে যাবে যে!' নবীন কাকা কিছু বলল না। নদীর দিকে ছোটারও কোনো তাড়া দেখাল না।চোখ মুছতে মুছতে বাসুকে জড়িয়ে ধরল বুকে।
বাড়িতে ঘটনার বর্ণণা শুনে মা ডুকরে উঠলেন। দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ঠাম্মা তাঁর চিরাচরিত ঠাকুর ঘরে পনের মিনিট কাটিয়ে দিল। এবং বাসুকে অবাক করে দিয়ে টমটমের গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। বাবা শুধুমাত্র শান্ত। কিন্তু শান্ত কী! একহাতে ওর একটা হাত শক্ত মুঠোয় নিয়ে অন্য হাত ওর মাথায় রাখা। বাড়িময় একটা অদ্ভুত রহস্য। নবীন কাকা যায়নি। বারান্দায় বসে তখনো। মাথা নীচু। কিছুটা অপরাধী গলায় বলল, 'আগামী অমাবস্যার আগে অস্থিটা নিয়ে গিয়ে গয়ায় পিন্ড দিয়ে আসার কথা বৌদি।' বাসু কেমন অবাক হল। কার? নবীন কাকাই উত্তর দিল, 'তুমি ভুল দেখেছ বাসু, বিজয় আজ দশদিন হল ওখানেই জলে ডুবে মারা গেছে।' তারপর একটু থেমে বলল, 'সেদিনও মাঠে প্রচুর ছেলে-পিলে ছিল। বিজয় জলে ডুবে যাচ্ছিল, চিৎকার করে বাঁচার চেষ্টা করেছিল। কেউ দেখেনি, সে চিৎকার শোনেওনি। শেষমুহূর্তে যারা দেখেছে তারা নাকি সাঁতার জানে না, তাই কয়েকজন ওর ডুবে যাওয়ার শেষ দৃশ্যটাকে ভিডিও করে ফেসবুকে দিয়েছে। আমার আর ওর মায়ের কান্নার ভিডিও ও এখন নাকি ভাইরাল না কি হয়েছে! বাসু এবার কেঁপে উঠল। টমের প্রতি রাগ মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। ও বুঝল টমটম না থাকলে ওর ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটাও এতক্ষণ ভাইরাল হয়ে যেত!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴