সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

এক নিরলস চিকিৎসক

এক নিরলস চিকিৎসক
জয়িতা রায় চৌধুরী মল্লিক
^^^^^^^^^^^^^^^^

বহু বছর আগের এক পাড়া গাঁয়ের গভীর রাত। হঠাৎ দরজায় তুমুল কড়া নাড়ার আওয়াজ। অঞ্জনা তখন বেশ ছোট। আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই তাকিয়ে দেখে মায়েরও ঘুম ভেঙে গেছে। বাবা ঘুমোচ্ছে অঘোরে, সারাদিন খাটুনি গেছে খুব। এই গ্রামের health center এর চার্জে আছেন তিনি, কয়েকবছর হল। অঞ্জনা দেখেছিল অনেক ডাক্তারই যখন আসতে চায়নি এই গ্রামে, বাবা এককথায় কেমন রাজী হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর তল্পিতল্পা, ভাইবোন সহ অঞ্জনারা মা-বাবার সাথে গ্রামটির স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোয়ার্টারে এসে উঠেছিল। ওখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল অঞ্জনা। দাদা দিদিরা ওখানকার একমাত্র হাই স্কুলে। বাবা ছিলেন চিকিৎসা কাজে নিবেদিত প্রাণ, তাই ওরকম একটা নির্জন গ্রাম, যেখানে যাতায়াত, পড়াশুনা ইত্যাদি কোনকিছুরই সুব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও উনি চলে এসেছিলেন শুধুমাত্র অভাব অনটনে কাবু হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের শুশ্রূষা করবার জন্য। যাহোক, ওদিকে কড়া নাড়ার আওয়াজ বেড়ে চলেছে। অঞ্জনা বাবার গায়ে হাত দিয়ে আস্তে ডাকল, বাপি, বাপি, কারা যেন ডাকছে। ঘুম ভেঙে তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন তিনি। সেসময় ঐসব এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। তাই অঞ্জনারা সবাই আতঙ্কিত হয়ে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বসেছিল। বাবা কোনকিছু না ভেবে সটান গিয়ে দরজা খুললেন। প্রায় জনা কুড়ি মানুষ তখন বাইরে দাঁড়িয়ে। একজন এগিয়ে এসে বললেন, আপনাকে এখুনি যেতে হবে, আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। বাথরুমে যেতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যান। তারপর থেকে অজ্ঞান হয়ে আছেন। মানুষগুলো কে কারা। অত রাত বিরেতে কোথায় কতদূর যেতে হবে কিছুই ভাবলেন না ডক্টর রায় চৌধুরী। ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলেন, ওদের সাথে, গরুর গাড়ি চেপে। অঞ্জনার মা সারারাত জেগে বসে রইলেন, দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে। ভোরবেলা তিনি ফিরলেন। পরে ঐ রোগীটি সুস্থ হয়ে দেখা করে গিয়েছিলেন অঞ্জনার বাবার সাথে।
খুব অল্প সংখ্যক স্টাফ নিয়ে তিনি ঐ সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালাতেন। দু একজন স্টাফ ছুটিতে বসে গেলে নিজে হাতে ইঞ্জেকশন দেওয়া, মামুলি কাটাছেঁড়ায় ওষুধ লাগানোর মত কাজগুলি নির্দ্বিধায় করতেন তিনি। অঞ্জনা ভীষণ অবাক হত, যখন উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও, বাপিকে ছোটখাট অপারেশন নিজে হাতে করতে দেখত। মা যখন বলতেন, জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি পাঠিয়ে দিলেই তো হয়, বাবাকে বলতে শুনেছে অঞ্জনা, ওদের অতদূর যাওয়ার ক্ষমতা কোথায়? তাছাড়া খুব বড় কিছু হলে তখন তো পাঠাতেই হবে, যেটুকু বিনা খরচে ওদের করে দেওয়া যায়, সেটুকু করে দিই। অঞ্জনা ভাবত, আশ্চর্য মানুষ বটে বাপি!
খুব সকালে উঠে পড়ত অঞ্জনারা। বাপিই ডেকে তুলতেন সবাইকে। তারপর পড়তে বসত হত। নিজে সময় করে সন্ধ্যা বেলা ভাই বোনদের নিয়ে বসতেন পড়াতে। সকালে কোয়ার্টারের লম্বা বারান্দা ভরে থাকত গ্রামের রোগীদের দিয়ে। তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের চিকিৎসা করতেন। কোন কোনদিন এমন হয়েছে উনি খাওয়ার সময়টুকুও পাননি। ঐসব রোগীদের কাছে কোনদিন বাবাকে পারিশ্রমিক নিতে দেখেনি অঞ্জনা। ওদের সে সামর্থ্যও ছিলনা, তাছাড়া বাবাকেও কখনও এসব নিয়ে কথা বলতে দেখেনি সে। আজ যখন সব ডাক্তাররা এত এত fees নিয়ে রোগী দেখেন, তখন বাপিকে ভীষণ মনে পড়ে অঞ্জনার। নতুন করে মাথা নত হয়ে আসে, শ্রদ্ধায়।
বর্ষাকালে বন্যায় ভেসে যেত আশে পাশের বহু এলাকা। তখন ছুটে যেতেন তিনি যৎসামান্য চিকিৎসা সামগ্রী নিয়েই, ঐসব বন্যায় আক্রান্ত মানুষগুলোর কাছে। অঞ্জনাও গেছে বহুবার তার বাপির সাথে। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে তার শ্রদ্ধার, ভালবাসার, কর্মে নিমগ্ন বাপিকে।
এরপর আরও বেশকিছু জায়গার বেশকিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বদলি হয়েছিলেন তিনি। রিটায়ার করবার কিছুদিন পর বিয়ে হয়ে যায় অঞ্জনার। বাপি তখনও নানাভাবে চিকিৎসা কাজে যুক্ত। এরপর অঞ্জনা গর্ভে চারমাসের সন্তানকে নিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে তার বাপি নাওয়া খাওয়া ভুলে সুস্থ করে তুলেছিল অঞ্জনাকে, নিজের কাছে রেখে। অন্যান্য ডাক্তাররা যখন প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে ওষুধ দিতে দ্বিধা করছিলেন, বাপি বলেছিলেন, মা যদি সুস্থ না হয় তাহলে বাচ্চাকে বাঁচানো কি সম্ভব? সবাই একমত হয়েছিলেন। ওষুধ পড়ল। আজ অঞ্জনার সেই ছেলে অনেক বড়, সুস্থ। অঞ্জনার বাপির আশির্বাদ রয়েছে যে ওর মাথার ওপর।
অঞ্জনার ছেলে হওয়ার একবছরের মাথায় বাপি অসুস্থ হলেন। বুকের প্রচণ্ড ব্যথা অনায়াসে চেপে রেখে, নিজে কিসব ওষুধ খেয়ে, অঞ্জনাকে খবর পাঠালেন, তুমি কাল চলে এসো, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে। অঞ্জনার মন চঞ্চল হয়ে উঠল যাওয়ার জন্য। শ্বশুর বাড়িতে তখন অতিথি সমাগম। শ্বশুরমশাই বললেন, দুদিন পরে যাও। বুক ভেঙে আসছিল অঞ্জনার। অঞ্জনার দাদা ততক্ষণ বাপিকে শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেছে। ওখানে বেড নেই, বাপিকে নীচে শুইয়ে রেখেছে। ডাক্তাররা গাফিলতি করছেন। পরদিন ভোরে অঞ্জনা খবর পেল, বাপি নেই। শেষ দেখা হল না। আর কোনদিন সে তার বাপিকে দেখতে পাবে না, কোথাও। বুক ভাঙা চীৎকার ভেসে গেল বাতাসে, বাপির কাছে পৌঁছতে পারল না। শেষবারের মত বাপির সেই দেখতে চাওয়া, আজও অঞ্জনার বুকে গভীর আঘাত হানে।
নিজের জন্য কোনদিন চিন্তা না করে, অন্যের জন্য নিবেদিত প্রাণের মানুষগুলোর পরিণতি বোধহয় এরকমই হয়। নইলে সারাজীবন অন্যের চিকিৎসায় গাফিলতি তো করেননি বরং নিজের দিকে না তাকিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন অপরের জন্য, অথচ নিজে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সেভাবে চিকিৎসা পেলেন না, চলে গেলেন।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri